মোহাম্মদ সহিদ এর জন্ম পুরান ঢাকার লালবাগের নুরফাতা লেনে। ছোটবেলা থেকেই পাড়ার আর দশজন কিশোরের সঙ্গে স্কুল শেষে ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়তেন। পড়ালেখার চেয়ে ফুটবলেই যেন বেশী মনোযোগী হয়ে পড়েন। আর হবেনই না কেন? কারণ সময়টা ছিলো বাংলাদেশের ফুটবলে উন্মাদনার আশির দশক। সেই সময় মোহামেডান-আবাহনীকে ঘিরেই দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা ছিলো ফুটবল পাগল। শিশু কিশোরদের আদর্শ ফুটবল তারকা ছিলেন সালাউদ্দিন, চুন্নু, নান্নু, মঞ্জ ,বাদল রায়, সালাম, খোরশেদ বাবুল, ওয়াসিম, গাফ্ফার, আনোয়ার ও মহসিন, বাবলু। কিশোর-তরুণরা স্বপ্ন দেখতেন তাদের মতো ফুটবলার হওয়ার। কারণ রেডিও-টিভির ধারা বিবরণী আর সংবাদপত্র আর জনপ্রিয় ক্রীড়া পাক্ষিক ক্রীড়া জগতের রঙ্গিন ছবিতে ঢাকার মোহামেডান-আবাহনী আর ব্রাদার্সের তারকা ফুটবলাররা ছিলেন গ্লামারবয়। পুরান ঢাকার কিশোর মোহাম্মদ সহীদও এমন স্বপ্ন দেখতেন ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল লীগ ও বড় দলে খেলার। তাই ফুটবল নিয়েই পরে থাকতেন মাঠে।
সহীদের বয়স যখন ষোল তখন পাড়ার পাইওনিয়ার লীগের দল ওরিয়েন্ট ক্লাবে নাম লেখান লীগ খেলতে। যদিও ওই সময় চতুর্থ বিভাগ ফুটবলে পাইওনিয়ার লীগে অংশ নেয়া খেলোয়াড়দের বয়সের কোন সীমাবদ্ধতা ছিলো না। তাই ওরিয়েন্টে নাম রেজিষ্ট্রেশন হলেও বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিশোর সহীদ নিয়মিত খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। তাই জেদ করেন আরো কঠোর অনুশীলনে মনোযোগী হয়ে বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দলে নিয়মিত স্থান দখল করার। কিন্তু দূর্ভাগ্য পরের বছর পাইওনিয়ার ফুটবল লীগের খেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই অপেক্ষা করতে হয় আরো একটি বছর।
১৯৮২সালে পাড়ার দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের দল লালবাগ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। প্রাক্তন ফুটবলার ও কোচ মোহাম্মদ মালা ছিলেন লালবাগ স্পোর্টিংয়ের কোচ। তিনি সহীদকে লালবাগ স্পোর্টিং ক্লাবে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে সিলেক্ট করেন। দুই বছর বর্তমান হকি স্টেডিয়াম ও তৎকালীন আউটার স্টেডিয়ামে খেলার পরই সহীদের স্বপ্নের ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলার সুযোগ আসে অফিস ক্লাব সাধারণ বীমা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে। ৮৪ সাল থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত একটানা পাঁচ বছর খেলেন সাধারণ বীমা ক্রীড়া সংস্থায়। এরই মধ্যে ১৯৮৮ সালে সাধারণ বীমার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। কোচ মালার প্রশিক্ষণে সহীদ খেলায় আরো দক্ষতা অর্জন করেন।
সহীদ প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে এক দশকে মাত্র দুটি দলের হয়ে খেলেছেন। সাধারণ বীমা ছাড়াও খেলেছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে। ১৯৮৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যোগদানের পর ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত খেলেন মুক্তিযোদ্ধার রক্ত লাল-সাদা জার্সি জড়িয়ে। এরপর প্রতিযোগিতা মূলক ফুটবল থেকে অবসর নিলেও মাঠ ছাড়তে পারেননি। পুরান ঢাকার বৃহত্তর লালবাগের অবসরপ্রাপ্ত ফুটবলারদের নিয়ে লালবাগ প্রভাতি সংঘের মাধ্যমে বছর জুরেই মেতে থাকেন এই ক্লাব আর ফুটবল নিয়ে। মাসে, সপ্তাহে বা কোন খেলোয়াড়ের মৃত্যু বার্ষিকীতে আয়োজন করেন শোকসভা, প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ বা দিনব্যাপী টুর্নামেন্ট। ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পর গত তিন দশক এভাবেই ফুটবল নিয়ে মেতে আছেন ষাট বছরের প্রবীণ ফুটবলার মোহাম্মদ সহিদ।
সিটিজি সংবাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপকালে এভাবেই তার ফুটবলার হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করছিলেন মোহাম্মদ সহিদ।ফুটবলের নেশায় জড়িয়ে পড়ায় পড়ালেখায় এগোতে পারেননি। তাই ফুটবলার না হলে ব্যবসায়ী হওয়ার ইচ্ছা ছিলো সহীদের।লালবাগের নুরফাতা লেনে পৈতৃক নিবাস হলেও বাড়ি করেছেন পুরান ঢাকার হাজারীবাগের বোরহানপুর লেনে। ২০০৩সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী বকুল আক্তার, দুই ছেলে মোহাম্মদ আজান ওরফে সালিদ ও স্বাদ আয়ান।
সহীদ বললেন, শখ হিসেবে যখন ফুটবল খেলা শুরু করি তখন ঢাকার ফুটবল ছিলো অসম্ভব জনপ্রিয়। তখন সবাই কিশোর-তরুণ বড় মাপের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। আমিও সেই স্বপ্ন দেখা ফুটবলারদের একজন ছিলাম। ছোটবেলায় একা একা বল নিয়ে মাঠে অনুশীলন করলেও দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলার সময় প্রথম কোচ হিসেবে পাই মালা ভাইকে। মূলতঃতিনি আমার ফুটবল গুরু বা উস্তাদজি। যা কিছু শিখেছি ও প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলার সুযোগ পেয়েছি মূলতঃ তার জন্যই।
সহীদ বললেন, ১৯৮৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২৬তম এশীয় যুব ফুটবলে বাংলাদেশ জাতীয় যুব দলের হয়ে খেলি। তখন আমাদের কোচ ছিলেন বেকেল হপ্ট। সাদেক ভাই ছিলেন সহকারী কোচ। ৭নং গ্রুপের বাছাই পর্বের শেষ সময়ে নেপাল অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকায় উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দুই পর্বে দুটি ম্যাচ খেলতে হয়েছিলো। প্রথম পর্বে আমরা ড্র করি। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় আমরা ০-৫ গোলে হেরে যাই। সহীদ বললেন, ১৯৮৪ সালে সাধারণ বীমার হয়ে ফরাশগঞ্জের বিরুদ্ধের ম্যাচটি ছিলো ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের প্রথম ম্যাচ। সেই ম্যাচটি ড্র হয়েছিলো। আক্রমণভাগের রাইট আউট পজিশনের খেলোয়াড় সহীদ জানান, তার স্মরণীয় ম্যাচটি হচ্ছে ১৯৮৯ সালে মুক্তিযোদ্ধার হয়ে ঢাকা আবাহনীর বিরুদ্ধে। বৃষ্টি ভেজা কর্দমাক্ত মাঠের ওই ম্যাচে আমার দেয়া গোলে মুক্তিযোদ্ধা ১-০গোলে এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত আমরা জয়টা ধরে রাখতে পারিনি। খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়েছিলো। সেই দিনের ম্যাচটি আজও আমার কাছে স্মরণীয় ও দুঃখজনক দুটিই।
সহীদ ১৯৮৬ সালে সাধারণ বীমার হয়ে ভুটানের কিংস কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেছেন। ১৯৮৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের হয়ে ভারতে অল ইন্ডিয়া ফুটবল টুর্ণামেন্টে খেলেছেন। ১৯৮৪থেকে ১৯৯৩ একদশক ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে সাধারণ বীমা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের হয়েই খেলেছেন। পারিশ্রমিক হিসেবে সর্বনিম্ন ৪০ হাজার হতে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়েছেন।
পরিচ্ছন্ন ফুটবলার সহীদ ঢাকার লীগে এক দশক খেললেও কখনও হলুদ বা লাল কার্ড দেখেননি। প্রতি বছর লীগের টার্গেট থাকতো বছরে অন্তত দুটি করে ম্যাচ মোহামেডান ও আবাহনীর বিরুদ্ধে নিজেকে উজাড় করে সেরা খেলাটি খেলার।
কারণ ওই দুটি ম্যাচে সেরা খেলাটি খেলতে পারলে বড় দুই দল ও তার সাপোর্টারদের কাছে নিজকে পরিচিত করে তোলা ও অনেক সময় ওই দলে খেলারও আমন্ত্রণ পাওয়া যেতো।
সহীদ বললেন, ফুটবলের সেই সোনালী যুগে মোহামেডান-আবাহনীর বিরুদ্ধে নিজের সেরা খেলাটি দলকে উপহার দেয়ার জন্য বাকী সব দল ও খেলোয়াড়দেরই টার্গেট থাকতো। বড় দলের কাছ থেকে পয়েন্ট কেড়ে নেয়ার আনন্দ ছিলো। ঢাকার লীগে ওই সময়ের আর্কষণ ও আমেজ ছিলো। সারা দেশের ফুটবলারদের স্বপ্ন থাকতো ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলার। এখন ফুটবলে সেই আর্কষণ আর নেই। নামেই শুধু পেশাদার লীগ। ফুটবল আগের মতো দর্শক না টানার কারন হিসেবে প্রবীণ ফুটবলার সহীদ মনে করেন, নানান কারনেই আজ মানুষ ফুটবল বিমুখ।
সাংগঠনিক ব্যর্থতার পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ইন্টার প্রতিযোগিতাগুলো না হওয়া, ঢাকাসহ সারা দেশের নিয়মিত লীগ আয়োজন না হওয়া, ঢাকার কেন্দ্রস্থল ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে ফুটবল চলে যাওয়া এবং পাড়া মহল্লায় আগের মতো ফুটবলের জন্য নিবেদিত ক্রীড়া সংগঠক না থাকার কারনেই আজ ফুটবলের করুণ অবস্থা। ক্রীড়াঙ্গনে এখন সৎ ও ভাল মানুষের সম্মান ও মূল্যায়ন নাই। ধান্দাবাজ, বাটপার আর বেয়াদবের আখাড়ায় পরিনত হয়েছে ক্রীড়াঙ্গন। গুটিকয়েক ধান্দাবাজের কাছে দেশের ফুটবল আজ জিম্মি। দেশ-বিদেশ সব জায়গায়ই আজ বাংলাদেশের ফুটবলের মান নিয়ে সংগঠকরা সমালোচিত। এক করপোরেট প্রতিষ্ঠান দেশের গোটা ফুটবলের অক্সিজেন সাপ্লাই দিয়ে ফুটবলকে বাঁচিয়ে রাখছে। কিন্তু এভাবে আর কত বছর চলবে?এই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান না থাকলে দেশের ফুটবল অচল হয়ে যাবে,পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে লীগ বন্ধ হয়ে যাবে। যেহেতু এখন আর আগের মতো স্কুল, কলেজ ও ইন্টার ইউনিভার্সিটি ফুটবলও নিয়মিত নাই তাই জেলায় জেলায় ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেখানে ফুটবলেই অগ্রাধিকারের সঙ্গে শিশুকিশোর ও তরুণদের পড়ালেখার সুযোগ থাকবে।
ষাট বছরের প্রবীণ ফুটবলার সহীদ ১৯৯৩ সালে ঢাকার লীগ ফুটবল থেকে অবসর নেন। লালবাগের সকল প্রবীণ ফুটবলারদের একটি প্লাটফর্মে ধরে রাখতে ২০১৭ সালে গঠন করেন লালবাগ সোনালী অতীত ক্লাব। বর্তমানে লালবাগ সোনালী অতীত ক্লাবের সভাপতি মোঃ সহীদ ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাশেদ দায়িত্ব পালন করছেন।
ফুটবলে তিনি রহমতগঞ্জের এজাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন
কবর খোদক ফুটবলার রজব’র অজানা গল্প
ফুটবলারদের শাস্তিঃ তদন্ত কর্মকর্তা আলোচিত ওসি কুদ্দুস যা বললেন
সামরিক আদালতে ফুটবলার আনোয়ারের বিচারের অজানা কথা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া ফুটবলার বাবুল গুমের মর্মস্পর্শী কাহিনী
মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সাংবাদিক খন্দকার তারেকঃ ক্রীড়াঙ্গনের জীবন্ত দলিল
ক্রীড়াঙ্গনে আজিমপুর কলোনীঃ জুডো কন্যা সুমির সাফল্যের গল্প
৫১ বছর পর পরিচয় উদঘাটন: বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার প্রতিরোধে পুলিশ নয়, প্রথম শহীদ ফুটবলার খোকন
ষাটের দশকে ফুটবলে খ্যাপের ওস্তাদ ফায়ারসার্ভিসের বিমল দাদা এখন ইতিহাসের সাক্ষী
শোকাবহ আগস্ট : আবাহনীর খেলোয়াড়দের রাতের অন্ধকারে অনুশীলন করতে হতো
পঞ্চাশ দশকঃ কায়দে আজম ট্রফিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটার মিন্টুর গল্প
ফুটবলার ইকবালের স্বপ্ন ভেঙেছে একটি রাফ টেকলিং
গ্যালারি মাতানো পাগলা মুজিবর আবাহনী সমর্থক হওয়ার পেছনের গল্প – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের ফুটবলে ভুলে যাওয়া নাম সত্তুর দশকের শার্প শ্যুটার সুলতান – CTG SANGBAD24
ঢাকার ফুটবল উন্মাদনাঃ কসাইদের মোহামেডান আর রহমতগঞ্জের ডাইলপট্টির কথা – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি – CTG SANGBAD24
পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প – CTG SANGBAD24
ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু – CTG SANGBAD24