পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প

পূর্ব বাংলার ফুটবল বলতেই কোলকাতার ফুটবল লীগসহ নানা টুর্নামেন্ট। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ঢাকার ফুটবল লীগ হয়ে উঠে জনপ্রিয়। ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সময় ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ হতো ডাবল লীগ পদ্ধতিতে।আন্তর্জাতিক মানের টুর্নামেন্ট প্রিন্স করিম আগা খান গোল্ডকাপ, স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো নিয়মিত। এ ছাড়া জেলা বা মহকুমা ভিত্তিক জাতীয় ও যুব ফুটবল টুর্নামেন্ট গুলো ছাড়াও স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট ছিলো সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ফুটবলার তৈরীর কারখানা।পঞ্চাশ দশকে ঢাকার ফুটবল নিয়ে স্মৃতিচারন করতে গিয়ে এমনটাই বলছিলেন প্রাক্তন ফুটবলার আব্দুল জলিল আনসারী ও মোঃ ইউসুফ বক্স।পঞ্চাশ দশকের ঢাকার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট হতে শুরু করে লীগ ফুটবল, বিভিন্ন টুর্নামেন্টের খ্যাপ খেলা,জাতীয় ও যুব ফুটবল টুর্নামেন্টে ফুটবলের সোনালী দিনগুলো ও উন্মাদনার কথা বলতে গিয়ে এই দুই ফুটবলারই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেন।বর্তমান ফুটবলের জনপ্রিয়হীনতা ও দর্শকহীন ফুটবল লীগের করুন অবস্থার জন্য ঢাকায় উন্মুক্ত খেলার মাঠ না থাকা,নিয়মিত স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন না করাকেই দায়ী করেন এই প্রবীণ দুই ফুটবলার।গত সপ্তাহে পুরান ঢাকার জুম্মান ব্যাপারী লেনের বাসভবনে আব্দুল জলিল আনসারীর সঙ্গে ও নারিন্দার শরৎগুপ্ত লেনের বাসভবনে প্রাক্তন ফুটবলার মোঃ ইউসুফ বক্স সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় উঠে আসে পঞ্চাশ দশকে ঢাকার ফুটবল ও খেলাধুলার নানা বিষয়।মোঃইউসুফ বক্স ফরাশিদের আবাস ও বানিজ্যিক এলাকা ফরাশগঞ্জের হয়ে ফুটবল লীগে খেলা শুরু করেন।আর আব্দুল জলিল আনসারী ঢাকার অফিস ক্লাব ফায়ারসার্ভিস এর হয়ে ঢাকার ফুটবল লীগে খেলেন বেশ দাপটের সঙ্গে।তবে দুজনেরই ঢাকার ফুটবলের হাতেখড়ি স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে।পঞ্চাশ দশকে ঢাকার জনসংখ্যার তুলনায় মাঠ ছিলো অনেক বেশী। বিশেষ করে রেসকোর্স ময়দান( বর্তমান সারোয়ারদী উদ্যান)পল্টন ময়দান, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বর্তমান উদয়ন স্কুলের স্থানে বিশাল খেলার মাঠ,এ ছাড়া পুরান ঢাকার জুবেলী স্কুল খেলার মাঠ,ইস্ট এন্ড ক্লাবের ধূপখলা মাঠ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠসহ গোটা ঢাকার একটি বৃহৎ অংশই ছিলো উন্মুক্ত খোলা মাঠ।তাই পাড়া মহল্লায় শিশু কিশোর ও তরুণরা বিকেল হলেই বল নিয়ে মাঠে নেমে পরতেন।বিকেলে ঢাকার সবগুলো মাঠই হয়ে উঠতো শিশুকিশোরদের কলরবে উৎসব মুখর। ছিলো না কোন পরিবেশ দূষণ, ইটপাথর দালন কোঠার রুদ্ধশ্বাস অবস্থা আর যানবাহনের শব্দ দূষণ। ঢাকা ছিলো এক নির্মল সবুজের প্রাকৃতিক সুন্দরয্যময় চমতৎকার শহর।ঢাকা ফুটবল লীগে রক্ষণ ভাগের দুই অতন্দ্র প্রহরী ডিফেন্ডার আব্দুল জলিল আনসারী ও গোলরক্ষক ইউসুফ বক্সের কথা তুলে ধরছি ফুটবল উন্মাদনার এই পর্বে।

পঞ্চাশ ষাট দশকে ঢাকার ফুটবল মাঠে রক্ষণ ভাগের দুই ফুটবলার ইউসুফ বক্স আর জলিল আনসারী।দুইজন একই দলে না খেললেও ঢাকার ফুটবলে এরা ছিলেন অতিপরিচিত নাম।

জলিল আনসারীঃ প্রায় সাড়ে পাঁচ ফিট উচ্চতার বিশাল দেহের অধিকারী।পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে রক্ষন ভাগের এই খেলোয়াড়ের অঘোষিত রাজত্ব ছিলো।বাঘা বাঘা স্ট্রাইকারদের পা থেকে বল ছো মেরে ছিনিয়ে দল কে বিপদ মুক্ত করাই ছিলো তার কাজ।

পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি ইষ্ট বেঙ্গল স্কুলের হয়ে ইন্টার স্কুল ফুটবল দিয়ে প্রতিযোগিতা মূলক ফুটবলে যাত্রা শুরু।এরপর জলিল আনসারী ঢাকার এসএম হলের বেশীর ভাগ খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত ঢাকা স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগ খেলা শুরু করেন।মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সেই রক্ষণ ভাগের এই কিশোর ফুটবলার তার অসাধারণ দক্ষতায় লীগ ফুটবলে সবার নজরে আসেন।ওই বছর ঢাকা স্পোর্টিং ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে PWD”র সঙ্গে হেরে রানার্সআপ হয়।ডিসিমিল ঢাকেশ্বরী কটন মিল চ্যাম্পিয়ান হয়।১৯৫৭ সালে ঢাকা স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে রহমতগঞ্জের বিরুদ্ধে ঢাকার ওয়ারী গ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত( বর্তমান মহানগর নাট্য মঞ্চে)র মাঠে জলিল আনসারীর খেলায় মুগ্ধ হয়ে খেলা শেষে তাকে ঢাকা মোহামেডানের শাহজাহান ভাই জলিল আনসারীকে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে ফুটবল খেলার আমন্ত্রণ জানান।যদিও জলিল আনসারী তখন ঢাকা মোহামেডানের হয়ে ক্রিকেট লীগ খেলতেন।পরের বছর ১৯৫৮ সালে জলিল আনসারী ঢাকা মোহামেডানের রক্ষণ ভাগের দায়িত্ব নেন।দলের গোল সিমানায় কোন স্ট্রাইকার কে প্রবেশ করতে না দেয়াই যেন তার কাজ ছিলো।গোল করে যতটা সহজে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় রক্ষণ ভাগে গোল করার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে জনপ্রিয় হওয়া ততটা সহজ ছিলো না বিধায় ডিফেন্ডার হিসেবে জলিল আনসারী কঠিন লড়াইয়ে থাকতে হয়েছে ততকালীন বিখ্যাত বাঘা বাঘা মাকরানি স্ট্রাইকারদের প্রতিরোধে। এসময় ঢাকা মোহামেডানে জলিল আফসারীর সহযোদ্ধা ছিলেন,কবির,আশরাফ,মারী দাদা,গজনবী ও নবী চৌধুরী প্রমুখ।ওই বছর ঢাকা মোহামেডান আইএফ শিল্ড ট্রফিতে অংশ নিতে কোলকাতা যায়।কিন্তু রহস্যময় কারনে জলিল আনসারীসহ কয়েকজন খেলোয়াড়কে প্রথম একাদশে রাখা হয় না।এতে তিনি মনক্ষুন্ন হয়ে কোলকাতা থেকেই সিদ্ধান্ত নেন বড় দল হলেও তিনি ঢাকা মোহামেডানে খেলবেন না।পরের বছর ৫৯ সালে দল বদল করে ঢাকার আরেক ঐতিহ্যেবাহী ক্লাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে যোগদান করেন।এ সময় গোলরক্ষক মনজুর হাসান মিন্টু তার পেছনে গোলবার আগলে রাখতেন আর পাকিস্তানি গফুর বেলুচ স্টপারে স্ট্রাইকার রেমন ছিলো দুর্দান্ত।জহির ভাই তখন পুলিশে সার্জেন্টের চাকরি নিয়ে চলে যান।এক বছর ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে খেলার পর ১৯৬০ সাল থেকে ৬৩ পর্যন্ত চার বছর তিনি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের রক্ষণ সীমানা প্রহরার দায়িত্ব নেন।চার বছর তার সহযোদ্ধা হিসেবে লীগ ফুটবলে দাপিয়েছেন,এজাজ রসুল,গোলপোস্টে রনজিৎ দাদা,টাঙ্গাইলের মুক্তা ভাই,আবু তাহের বাটু( চট্টগ্রামের জমিদার)এহতেশাম প্রমুখ। এ সময় আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব একবার লীগ চ্যাম্পিয়ান হয় তবে সালটি তিনি মনে করতে পারেননি।৬৪ তে তিনি অফিস ক্লাব ফায়ারসার্ভিসে যোগদান করেন।তখন ঢাকার অনেক দামি নামি ফুটবলারাই ফায়ারসার্ভিসে খেলেছেন।যাদের অন্যতম,বজলুর রশিদ,রনজিৎ দাদার ভাই,সিতাংশু,মজিবুর ওরফে কালেখা মজিবুর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন।আমান, বিমলদা, সারফুদ্দীন, মমতাজ, গফুর, মুন্সিগঞ্জের মোতালেব, মেজর হাফিজ, দুলাল, পুলিশের নিহত হওয়া এসি ফজলুল করিম, স্ট্রাইকার ইকবাল(মুন্সিগঞ্জের), সিরাজগঞ্জের আব্দুল ওয়াহাব, নরসিংদীর সামাদ, ময়মনসিংহ এর দুই ভাই আব্দুর রাজ্জাক ও হালিম, তামিম, অ্যাথলেট আবুল হাসান ও মনু ভাই। এ ছাড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামানের নাম না বললেই নয়। এরা সবাই তখন ফায়ারসার্ভিসের খেলোয়াড়। আর ফায়ারসার্ভিস ছিলো ষাট দশকের জায়ান্ট কিলার দল হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৮ সালে জলিল আনসারী পুরান ঢাকার ঐতিহ্যেবাহী ক্লাব রহমতগঞ্জে যোগদান করেন।৬৮ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত রহমতগঞ্জে খেলেই অবসর গ্রহন করেন।

ডিফেন্ডার জলিল আনসারী ঢাকার মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন শুধু ফুটবলেই নয় তিনি ঢাকা মোহামেডানের হয়ে ক্রিকেট লীগে তারা তিন ভাই একসঙ্গে খেলেছেন দাপটের সঙ্গে।আপন ভাই লতিফ আনসারী, চাচাতো ভাই নুরুল ইসলাম রাঙ্গা।কোন এক ভাই আউট হলে কর্মকর্তা বা মাঠে থাকা দর্শকরা বলতেন তিন ভাইয়ের এক ভাই না এক ভাই দলের হাল ধরবেনই।

জলিল আনসারীর সাথে স্ত্রী হোসনে আরা

জলিল আনসারী ততকালে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ না একাধারে তিনি ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট, হকি, সাঁতার, শটবল খেলেছেন। ক্রিকেটে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে ১৯৫৫ থেকে ৫৮ সাল পর্যন্ত খেলেছেন দাপটের সঙ্গে এসময় ৫৮ সালে ঢাকা মোহামেডান তার ফুটবলের প্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব কে হারিয়ে লীগ চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করে।একই বছর জলিল আনসারী ততকালীন আমেরিকার পূর্ব পাকিস্তান দূতাবাস শটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করলে তিনি আমেরিকার আইসিএ একাদশের হয়ে অংশ নেন।তখন এই শটবল টুর্নামেন্ট হতো ঢাকা ক্যান্টমেন্টের আর্মির মেডিকেল ও ইন্জিনিয়ারিং কোরের মাঠে।ঢাকার নটরডেম কলেজ,সেন্ট গ্রোগেরি স্কুলসহ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোই মূলত এই টুর্নামেন্টে অংশ নিতো।শটবল অনেকটা ক্রিকেটের মতোই।বহুমুখী প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ আব্দুল জলিল আনসারী ইন্টার স্কুল কলেজ সাঁতার ও ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেছেন ইস্ট বেঙ্গল স্কুল ও জগন্নাথ কলেজের হয়ে। ৫৭ সালে স্যার এফরহমান শিল্ড ও গর্ভনর নুন কাপ টুর্নামেন্টে জগন্নাথ কলেজ চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করে।এ ছাড়া তিনি হকি খেলেছেন কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে এসময় সাদেক,প্রতাপ শংকর হাজরা,সোনা মিয়া,ইব্রাহিম জবাবের,আব্দুল কাদের ও রহমানের সঙ্গে তিনি হকি খেলেছেন।ফুটবল,ক্রিকেট, হকি,সাঁতার, অ্যাথলেট ও শটবল সহ বহুমুখী ক্রীড়া প্রতিভার অধিকারী আশি বছরের প্রবীন ক্রীড়াবিদ বেচে আছেন প্রায় সাত দশকে ঢাকার ফুটবল ও ক্রীড়াঙ্গনের নানা স্মৃতি নিয়ে।আব্দুল জলিল আনসারীর স্ত্রী হোসনে আরা,চার মেয়ে, তানিমা,ফাহিমা, সিমা ও সুরমা আনসারী আর নাতি-নাতনীদের নিয়ে পুরান ঢাকার বংশিবাজার জুম্মন ব্যাপারী লেনে বসবাস করছেন।তার দাদার নামেই জুম্মন ব্যাপারী লেন।পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জলিল আনসারী বললেন
তাতকালে এই সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো ঢাকা হল হিসেবে পরিচিত বর্তমান শহিদুল্লাহ হল পুকুর,বর্তমান মহানগর নাট্য মঞ্চ হিসেবে পরিচিত ততকালীন উয়ারী গ্রাউন্ড পুকুরে।তখন খোলা পুকুরে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হতো।এ ছাড়া রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সাহরোয়ার্দী উদ্যান,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএমহল মাঠ, উদয়ন স্কুলের স্থানে উন্মুক্ত খোলা মাঠ,পল্টন ময়দান,উয়ারী গ্রাউন্ড, ধুপখোলা মাঠ, জুবিলী স্কুল মাঠসহ ঢাকার অর্ধেক অংশই ছিলো খোলা উন্মুক্ত মাঠ আর গাছগাছালির বাগান।আরও খেলোয়াড়দের চলাচল মাঠে প্র্যাকটিসে বেশীর ভাগ খেলোয়াড় সাইকেল চালাতেন এতে শারীরিক ফিটনেসতো থাকতো।ফুটবলে আর আগের মতো উন্মাদনা না থাকায় দুঃখ প্রকাশ করে জলিল আনসারী বলেন,ইট-পাথরের এই শহর এখন বানিজ্যিক নগরী।কোথাও খোলা মাঠ চোখে পড়ে না।বাচ্চারা খেলবে কোথায়? আমাদের নাতিনাতকুরদের জন্য হয়তো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

গোলরক্ষক ইউসুফ বক্সঃ পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের বিকেদাস রোডে ইউসুফ বক্সের বাপ-দাদার পৈত্রিক নিবাস হলেও তার জন্ম ফরিদাবাদে।পুরান ঢাকার সন্তান ইউসুফ কিশোর বয়স থেকেই পাড়ার জুবিলী স্কুল মাঠে ফুটবল খেলা শুরু।তখন ঢাকার ফুটবলের ইন্টার স্কুল ও ইন্টার কলেজ ফুটবল টুর্নামেন্ট ছিলো আকর্ষণীয় ও জমজমাট আসর।মাত্র ১৫ বছর বয়সে ইউসুফ স্কুল ফুটবলের পাশাপাশি পাড়ার ক্লাব ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলা শুরু করেন। সালটা তখন ষাট দশকের প্রথম। ৬১থেকে ৬৫ একটা পাঁচ বছর খেলার পর ৬৫তে ফাইনালে উঠে ফরাশগঞ্জ। ততকালীন রেলওয়ে ব্লুজ দলকে ১-০ গোলে হারিয়ে ফরাশগঞ্জ তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ান হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উন্নিত হয়।আর ইউসুফ বক্স ছিলেন ফরাশগঞ্জের গোল রক্ষার দায়িত্বে। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার বিশাল দেহের অধিকারী ইউসুফ গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে।তখন ফরাশগঞ্জ ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ক্রীড়াঙ্গনের নিবেদিত ব্যক্তিত্ব আঃকাদের নবাব।পাড়ার ক্লাব ফরাশগঞ্জের কৃতিত্বের সঙ্গে পাঁচ বছর খেলার পর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের দল পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জে গোলবারের দায়িত্ব নেন ইউসুফ বক্স। ওই সময় রহমতগঞ্জে ছিলেন একঝাঁক দেশ সেরা বাঙ্গালী ফুটবলার।যাদের মধ্যে দিপু,গোলাম সারোয়ার টিপু,কায়কোবাদ,স্কুটার খ্যাত গফুর,আবদুল আজিজ,আরেক গোলরক্ষক অনাথ, হাসনাত, সুলতান, স্ট্রাইকার সাত্তার ( যিনি পরে পুলিশ ক্লাবে খেলে পুলিশের সাত্তার হিসেবে ফুটবল দর্শকদের কাছে পরিচিত ছিলেন), সিতাংশু, বেল্লাল ও লালু প্রমুখ। তিন বছর তিনি রহমতগঞ্জের গোলপোস্টের দায়িত্ব আস্থার সঙ্গে আগলে রাখেন।রহমতগঞ্জের হয়ে খেলার সময় ৬৭/ ৬৮ সালে লীগ ফুটবলে ঢাকা মোহামেডানের মুখোমুখি। মোহামেডান তখন ঢাকা লীগের দূর্ধষ টিম।ইউসুফ বক্স ডি বক্সের মাথায় এসে বল শটে নেন।বল পরে কালা গফুরের পায়ে।গফুর তাতক্ষনিক বল টি সরাসরি ভলি মেরে তার মাথার উপর দিয়ে গোল পোস্টের জালে পাঠিয়ে দেন।গোলরক্ষক হিসেবে এই গোল হজম করা আজও তার কাছে দুঃস্বপ্ন।এখনো সেই গোল তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।সেই দিন মোহামেডান ৩-০ গোলে জয়ী হয় রহমতগঞ্জের বিরুদ্ধে।প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে গোলপোস্ট আগলে রাখাকালে তিনি সব সময় আতংকে থাকতেন মোহামেডানের মুসা,,মাকরানি সিনিয়র ইউসুফের পায়ে বল থাকলেই।৭০ সালে ইউসুফ বক্স রহমতগঞ্জ ছেড়ে পাড়ার ক্লাব ফরাশগঞ্জে চলে আসেন।১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ফরাশগঞ্জেই খেলে মাঠ থেকে অবসর নিলেও কর্মকর্তা হিসেবে ফরাশগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত আছেন এখনো।

১ স্ত্রী, কণ্যা ও নাতনির সঙ্গে ইউসুফ বক্স

ইউসুফ বক্স ঢাকার ফুটবলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ইউসুফ বক্স বলেন,সম্ভবতঃ১৯৬৪ সাল।তখন ইন্টার স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট ছিলো খুব প্রতিযোগিতা মুলুক ও আকর্ষণীয়। ঢাকা স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি জুবিলী স্কুল ও পুরান ঢাকার নবকুমার স্কুল।ইউসুফ জুবেলী স্কুলের গোলরক্ষার দায়িত্বে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ খেলা শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগে রেফারী ননী বসাক আমাদের বিরুদ্ধে পেনাল্টি দিলে মাঠে গোলযোগ শুরু হয়। দুই দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকরা যখন সংঘর্ষে লিপ্ত তখন মাঠে থাকা চ্যাম্পিয়ান,রানার্সআপ ও ব্যক্তিগত ট্রফি গুলো লুট হয়ে যায়।তখন আমাদের স্কুলের সমর্থক মোতালেব চ্যাম্পিয়ান ট্রফির কাপটিক নিয়ে চলে আসেন।সেই চ্যাম্পিয়ান কাপটি আজও ফরাশগঞ্জ ক্লাবে সংরক্ষণ করা আছে।আর খেলা হয়নি।জুবিলী স্কুল কে সাসপেন্ড করা হয়।সেই দিন মাঠ থেকে জার্সি খুলে পশ্চিম দিক দিয়ে পালিয়ে বেঁচে ছিলেন। সেই দিনের ঘটনাটি আজও তার কাছে স্বরণীয়।ষাট দশকের গোলরক্ষক ইউসুফ বক্স ঢাকার হয়ে নিয়মিত খেলেছেন সাব ডিভিশনাল চ্যাম্পিয়ান শীপে।তার সময়ে ঢাকা জেলা বেশ কয়েক বছর চ্যাম্পিয়ান হয়।এ ছাড়া তিনি ঢাকার হয়ে জাতীয় ও জাতীয় যুব ফুটবল সাব ডিভিশনাল চ্যাম্পিয়ান শীপে অংশ নেন নিয়মিত।ইন্টার স্কুল ফুটবল ছাড়াও তিনি জগন্নাথ কলেজের হয়ে নিয়মিত খেলেছেন ইন্টার কলেজ ফুটবল চ্যাম্পিয়ান শীপে।ওই সময় জগন্নাথের ক্রীড়া শিক্ষিক নুর হোসেন স্যার মুলতঃ জগন্নাথ কলেজের ফুটবল,ক্রিকেট সহ সব খেলার দলগুলোরই তার কোচিং ও তত্বাবধানে পরিচালিত হতো।দেশের ফুটবলের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন,উন্মুক্ত খোলা মাঠের অভাব ও স্কুল কলেজ পর্যায়ে ফুটবল প্রতিযোগিতার নিয়মিত আয়োজন না থাকায় ভাল মানের খেলোয়াড় তৈরী হচ্ছে না। স্ত্রী রাশেদা, ও চার কণ্যা,ফারহানা,ফারজানা,রুমানা ও সানজানা। নাতি,নাতনি নিয়ে ইউসুফ বক্স নারিন্দায় বসবাস করছেন।

 

ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু

আরও পড়ুন