শোকাবহ আগস্ট : আবাহনীর খেলোয়াড়দের রাতের অন্ধকারে অনুশীলন করতে হতো

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতিরজনক সপরিবারে নিহত হলে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের শূন্যতায় পরে দলটি। অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির এই ক্লাবের খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের মাঝে আতংক বিরাজ করে। বঙ্গবন্ধুর খুনী কতিপয় সেনা সদস্য মালয়েশিয়ার মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্ট হতে দেশে ফিরে আসা জাতীয় দল ও আবাহনী ক্রীড়া চক্রের খেলোয়াড়দের বাড়িতেও হানা দিয়েছিলো। যার ফলে ১৯৭৪ এ প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ান আবাহনীর খেলোয়াড়রা আতংকিত হয়ে পড়েন। মালয়েশিয়া থেকে জাতীয় ফুটবল দল দেশে ফিরে আসলেও ১৫ আগস্টের পর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগও বন্ধ হয়ে যায়। আকষ্মিক দেশের এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের ফুটবল লীগে খেলা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

দলের এমন এক দুঃসময়ে শেখ কামালের আবাহনীর হাল ধরেন দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের ফুটবল ও হকি খেলোয়াড় আব্দুস সাদেক। ওই সময় তিনি ধানমন্ডি ঈদ গা মাঠের পাশেই থাকতেন। তার দ্বিতল আন্ডার কনস্ট্রাকশন ভবনটিতে রাতে সকল খেলোয়াড়রা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেকোন মূল্যে লীগে অংশগ্রহণের। দিনের বেলায় মাঠে অনুশীলন ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় সন্ধ্যার পর রাতের অন্ধকারে বর্তমান স্টার কাবাব এর উল্টো দিকে মাঠের এক পাশে খেলোয়াড়রা অনুশীলন করতেন। অনেক ভয় আর আতংকের মধ্যে তাদের অনুশীলন করতে হতো। ধানমন্ডি, কলাবাগান, শংকর, রায়েরবাজারসহ আশপাশে থাকা স্থানীয়রাও ও বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাসা থেকে খেলোয়াড়েরা মাঠে আসতেন। যার অন্যতম,জাহাঙ্গীর শাহ্ বাদশা, আনোয়ার, সালাউদ্দিন, টুটুল, আশরাফ, অমলেশ, নিজাম, সোহরাব, ঝন্টু, নান্নু, ফুয়াদসহ অনেকেই। আব্দুস সাদেক খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিতেন। দলের এই চরম দুঃসময়ে মূলত শেখ কামালের স্বপ্ন আবাহনী ক্রীড়া চক্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই খেলোয়াড়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের জন্য খেলেছেন এমনটা বলছিলেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাকালীন ফুটবল ও ক্রিকেট খেলোয়াড় জাহাঙ্গীর শাহ্ বাদশা।

১৫ আগষ্ট ৭৫ পরবর্তীকালে আবাহনীর দুঃসময় নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ধানমন্ডির বাসিন্দা ও শেখ কামালের বন্ধু বাদশা বলেন, আমরা শেখ কামালের বন্ধু হয়েও তার জন্য কিছু করতে পারিনি এটা ধানমন্ডির বাসিন্দা হিসেবেও আমি লজ্জিত। ৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর সাদেক ভাই আবাহনী ক্রীড়া চক্রের ফুটবল ও হকি দলটি ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সেই সঙ্গে ধানমন্ডির এলাকার বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরাও আবাহনীর চরম দুঃসময়ের দলকে নানাভাবে গোপনে হলেও সহযোগিতা করেছেন। এদের কেউ খেলার সরঞ্জাম বুট, জার্সি, খেলোয়াড়দের ঢাকা স্টেডিয়ামে যেতে বাসের ব্যবস্থা করে দলকে বাঁচিয়ে রাখতে এগিয়ে এসেছেন। ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট পরবর্তী সময়ে ধানমন্ডির খায়রুল কবিরের ছেলে আজমল কবির, সাব্বির ইউসুফ, ইব্রাহিম সাবের, মোঃমহসিন ভাই, ধানমন্ডি ১৯ এর মন্টু ভাই, সোনালি ব্যাংকের সেন্টু ভাই, ফোকলা ভাই, সাতমসজিদের শিল্পপতি শামসুল ইসলাম, কামাল ইবনে ইউসুফ, দৈনিক ইত্তেফাকের মানিক মিয়ার ছেলে সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ভাই ও তার স্ত্রী তাসমীমা হোসেন, সালমান এফ রহমান, কর্নেল সাহেদ, চিত্র নায়ক রাজ্জাক, আলমগীর, চট্টগ্রাম কাস্টমস ও আয়কর বিভাগের অনেক কর্মকর্তা যাদের মধ্যে আবুল হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, খায়রুল সাহেব আবাহনীর দুঃসময়ে দলকে আর্থিক ও নানাভাবে সহয়তা করেছিলেন। এছাড়া টাঙ্গাইলের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আবাহনীর ক্রীড়া চক্রের দুঃসময়ে সহায়তা করেছেন। খেলোয়াড় ও সংগঠকদের সাহস দিয়েছেন লীগে খেলার জন্য। এছাড়া হারুন ভাইয়ের ভগ্নীপতিও আবাহনীর খেলোয়ারদের তার বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলায় অংশ নিতে আবাহনীর খেলোয়াড়দের যাতায়াতের জন্য ফিরোজ ভাই নামে একজন বাস পাঠিয়ে দিতেন। শেখ কামালের শূন্যতায় ধানমন্ডির এই শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া অনুরাগীরা এগিয়ে এসেছিলেন আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও শেখ কামালের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে।

জাহাঙ্গীর শাহ্ বাদশা বলেন, স্থানীয়দের প্রথম ক্লাব ছিলো ধানমন্ডি ক্লাব। যেখানে শেখ কামাল, শেখ জামালসহ সবাই জড়িত ছিলেন। ৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর আবাহনীর দুর্দিনের অভিভাবকহীন ধানমন্ডির আবাহনী ক্রীড়া চক্রের পাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন শেখ কামালের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাদশা বলেন, আজকে লাখ লাখ ভক্ত ও সমর্থক। কিন্তু আবাহনীর সাফল্যের পেছনে ওই লোকগুলোর অবদানের কথা না বললেই নয়।

জাহাঙ্গীর শাহ্ বাদশা বলেন, তখন দলের খেলোয়াড়দের টাকা পয়সার প্রতি কোন লোভ লালসা ছিলো না। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে কোন দিন অর্ধেক পেট ভাত খেয়েও মাঠে খেলতে নেমেছেন। ফুটবল টিমের জন্য সাদেক ভাই ও ক্রিকেট টিমের জন্য অলিউল ভাইয়ের যথেষ্ট অবদান রয়েছে।

নিজের গোডাউনের মাল বেঁচে ক্লাব চালিয়েছে হারুন-অর-রশিদ : এদিকে ১৯৬৬ সালে আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি হতে ১৯৭২ সালে আবাহনী ক্রীড়া চক্র নামে প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকা সংগঠক হারুন-অর-রশিদ বলেছেন, আবাহনী ক্রীড়া চক্র নামে প্রতিষ্ঠাতার অন্যতম শেখ কামাল ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট শহীদ হওয়ার পর ক্লাবটি অনেকটা অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ে। প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশগ্রহণও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিন্তু দলের খেলোয়াড়েরা খেলতে রাজী হওয়ায় দলটি আবারও ঘুরে দাড়ায়। ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট পরবর্তী সময়ে ভয় ও আতংকে কেউই ক্লাবকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে চায়নি।

তিনি বলেন, আমি আমার গোডাউনে থাকা মালমাল বিক্রি করে ক্লাব চালিয়েছি। প্রাণ বাঁচাতে আমাকেও আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। আবাহনীর আজকের অবস্থানে দাঁড়াতে আমাদের তৎকালীন খেলোয়াড়, সংগঠক বিশেষ করে সাদেক ভাই ও সাব্বির ইউসুফের কথা না বললেই নয়। আবাহনীর আজকের সাফল্য ও জনপ্রিয়তার পেছনে তাদেরও অবদান আছে।

পঞ্চাশ দশকঃ কায়দে আজম ট্রফিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটার মিন্টুর গল্প

ফুটবলার ইকবালের স্বপ্ন ভেঙেছে একটি রাফ টেকলিং

গ্যালারি মাতানো পাগলা মুজিবর আবাহনী সমর্থক হওয়ার পেছনের গল্প – CTG SANGBAD24

বাংলাদেশের ফুটবলে ভুলে যাওয়া নাম সত্তুর দশকের শার্প শ্যুটার সুলতান – CTG SANGBAD24

ঢাকার ফুটবল উন্মাদনাঃ কসাইদের মোহামেডান আর রহমতগঞ্জের ডাইলপট্টির কথা – CTG SANGBAD24

বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি – CTG SANGBAD24

পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প – CTG SANGBAD24

ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু – CTG SANGBAD24

আরও পড়ুন