বাংলাদেশের ফুটবলে ভুলে যাওয়া নাম সত্তুর দশকের শার্প শ্যুটার সুলতান

বড় দলের জার্সি গায়ে না খেললে অথবা কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে গুনগান না গাইলে মনে হয় দেশের কোন ক্রীড়া পুরষ্কার ভাগ্যে জোটে না।

৭৪ বছরের বয়জেষ্ঠ ষাট ও সত্তুর দশকের মাঠ কাঁপানো তারকা ফুটবলার পুরান ঢাকার সন্তান জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার মোহাম্মদ সুলতান আহম্মেদ আক্ষেপ করেই বলছিলেন তার দুই দশকের খেলোয়াড়ী জীবনে কোন পুরষ্কার না পাওয়ার দুঃখের কথা।

১৯৬৩ হতে ১৯৮১ একটানা প্রায় দুই দশক ঢাকা ফুটবল লীগ খেলে অবসরে যাওয়ার চার দশক পেরিয়ে গেলেও তার ভাগ্যে কোন পুরষ্কার না পাওয়ার হতাশায় মোহাম্মদ সুলতান বললেন, “এখন ৭৪ বছরে পা রেখেছি। ফুটবলের পেছনে নিজের জীবন-যৌবন বিলিয়ে দিয়েছি। নিজ দল পাড়ার ক্লাব রহমতগঞ্জকে ভালবেসে সত্তুর দশকে বড় দলগুলোর অফার পাওয়ার পরও কোনো দিন দলবদল করিনি। রহমতগঞ্জ ১৯৬৩ সালে প্রথমে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলা শুরু করে ওই বছরই চ্যাম্পিয়ন হয়ে ২য় বিভাগে। পরের বছরও ২য় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে উন্নিত হয়।“

১৯৬৬ সালে ঢাকার ফুটবল লীগে তখন ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাব, ইপিআইডিসি, ওয়ারী ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোটিং ক্লাবের দাপট। পাড়া ভিত্তিক ক্লাব রহমতগন্জ তেমন শক্তিশালী নয়। বেশীরভাগ ক্লাবগুলোতেই অবাঙালী-মাকরানি খেলোয়াড়দের দাপট। ১৯৬৩ থেকে ১৯৮১ প্রায় দুই দশকে নিজ দল, প্রাদেশীক জাতীয় ফুটবল ও যুব চ্যাম্পিয়ানশীপ বা স্বাধীনতাত্তোর জাতীয় ফুটবল মিলিয়ে দুই আড়াই শ”র বেশী গোল করেছেন তিনি। এরই মধ্যে ১৯৭৩থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত রহমতগঞ্জ দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন সুলতান।

সুলতান বলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই ষাট ও সত্তুর দশকে আমাদের ফুটবল খেলার কথা হয়তো আজকের পুরষ্কার নির্বাচক কমিটি অথবা নাম পাঠানোর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের মনে নেই। তাদের অনেকের হয়তো জন্মও হয়নি ওই সময়ে। তাই শেষ বয়সে এসে মনে হয় বড় দলে না খেলার কারনেই আমাদের ভাগ্যে কোন জাতীয় পুরষ্কার জুটেনি। পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ হাজী বাল্লু রোডের বাসায় এই প্রতিনিধির সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় তিনি আরো বলেন, ফুটবলের সেই স্বর্নযুগ আর এখন নেই। কালো টাকা আর মাফিয়া চক্রের কবলে দেশের ফুটবল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মাঠে নেই দর্শকদের উচ্ছাস-আনন্দ। নেই পাড়া-মহল্লায় বয়োবৃদ্ধ, শিশু কিশোর ও তরুণদের মাঝে মোহামেডান- আবাহনীর মতো জনপ্রিয় দলগুলোকে নিয়ে আনন্দ উল্লাস। দেশের ফুটবল এখন টাকার আবরণে ওপরে চাকচিক্য থাকলেও বিদেশী খেলোয়াড়দের পায়ে বন্দী দেশের ফুটবল। খেলোয়াড়দের মধ্যে নেই কোন স্কীল মেধা ও গুণাবলি। নেই টিম ওয়ার্ক। যার ফলে দেশের ঘরোয়া ক্লাব কেন্দ্রীক ফুটবলে সাফল্যের ঝুলি ভরলেও বিদেশের মাটিতে বিভিন্ন টুর্ণামেন্টগুলোতে দেশী খেলোয়াড়দের ব্যর্থতার গ্লানি বহন করতে হচ্ছে।

ষাট ও সত্তুর দশকের মাঠ কাঁপানো তারকা ফুটবলার সুলতান দেশের জনপ্রিয় বড় কোন দলে না খেলেও নিজের মেধা যোগ্যতা ও অসাধারণ নৈপুণ্যের মাধ্যমে ৭০ দশকে ঢাকার লীগ ফুটবলে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমান দিয়েছেন। লীগ ফুটবলে জনপ্রিয় মোহামেডান বা আবাহনীতে না খেললেও দুই দলের হয়েই দেশে- বিদেশের মাটিতে খেলেছেন মোহামেডান- আবাহনীর জার্সি গায়ে। স্বাধীনতার পর ৭৫এ ঢাকা মোহামেডানের হয়ে আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে এবং ১৯৭৪ এর লীগ চ্যাম্পিয়ান আবাহনী ক্রীড়া চক্রের হয়ে ভারতের আইএফশিল্ডে খেলেছেন সুলতান।

মোহামেডান- আবাহনীর মতো জনপ্রিয় দলের হয়ে লীগ না খেলার কারণ হিসেবে তিনি বললেন, বাপ-দাদা ও পাড়ার ক্লাব রহমতগঞ্জকেই বেশী ভালবাসতেন। নিজ পাড়ার সম্মান বৃদ্ধি ও বড় দলকে হারাতে পাড়া একটা বিরাট গৌরবের বলে মনে করতেন তিনি। ওই সময় খেলায় টাকা-পয়সা কোন ফ্যাক্টর ছিলো না, ছিলো সম্মান ও বড় দলের সঙ্গে মর্যাদার লড়াই। বড় দলের বিরুদ্ধে গোল করলে বা হারাতে পাড়লে নিজদল বা পাড়ার আনন্দ ছাড়াও বড় দলের সমর্থকরাও মনে রাখতো এর আনন্দটাই আলাদা। যা কোটি টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় না। যেমন ১৯৭৫ সালের লীগ ফুটবলে ঢাকা মোহামেডান একটি মাত্র ম্যাচেই হেরে সেই বছর লীগ চ্যাম্পিয়ান হলেও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হতে বঞ্চিত হয়েছিলো ঢাকা মোহামেডান। মুলত সুলতানের দুইটি গোলেই মোহামেডান রহমতগঞ্জের কাছে হেরে ছিলো ২ গোলে। সেই দিনের ম্যাচটি আজও তার স্মৃতিতে স্বরণীয় হয়ে আছে। সেই খেলার কথা মনে হলেই স্মৃতিতে ফিরে যান ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠে।

পুরান ঢাকার প্রায় ৯০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ক্লাব রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটিতে দুই দশক ফুটবলের জন্য যৌবন উৎসর্গ করে খেলেছেন ফুটবলার সুলতান। ব্রিটিশ শাসনামলে খেলাধূলায় পুরান ঢাকায় মুসলিম ঐক্যের সেতুবন্ধন গড়তেই রহমতগঞ্জ এমএফএস “র জন্ম। পাড়া ভিত্তিক ক্লাব হিসেবে রহমতগঞ্জ অল্প সময়ের মধ্যেই ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ব্যাডমিন্টনসহ নানা খেলায় যুবসমাজের সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। পুরান ঢাকার বানিজ্যিক এলাকার এই ক্লাবটি মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠে আদি ঢাকাবাসীর কাছে। ফুটবলার সুলতানের পূর্ব পুরুষদের নেতৃত্ব দেয়া পাড়ার এই ক্লাবে খেলাটা ছিলো একটি গৌরবের বিষয়। তাই কিশোর বয়সে পাড়ার বড় ভাই আওয়াল, আমিন, ওয়াহেদ, সাঈদ, মনির, সামাদ, সালেহ, রমিজের মতো সুলতান স্বপ্ন দেখতেন পাড়ার ক্লাবের হয়ে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার। তাই বাড়ি থেকে অল্প দুরত্বে থাকা নবকুমার স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ক্লাস শুরুর আগে ও ছুটির পরই কখনো ফুটবল বা কখনো ক্রিকেট নিয়ে মাঠে নেমে পড়তেন। ক্রিকেটে প্রতিপক্ষকে আউট করা, ক্যাচ ধরা বা চার/ছয় মারার একটা আনন্দ থাকলেও এক/দেড় ঘন্টার ফুটবল খেলাই তাকে আকৃষ্ট করে বেশী। তাই সুলতানের প্রিয় খেলা ক্রিকেট হলে আস্তে আস্তে ফুটবলের প্রেমে পড়ে যান তিনি। কিশোর বয়সেই কখনো স্কুলের মাঠে কখনো রহমতগঞ্জে বাড়ির পাশের মাঠে ফুটবলে মেতে থাকতেন। তার খেলোয়াড়ী জীবনে সবচেয়ে বেশী অনুপ্রেরণা যোগাতেন তার বড় ভাই মোঃআবু তাহের। পাড়ার বড় ভাই আওয়াল, সংগঠক আমিন ও তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক নুর হোসেন স্যারের অবদানের কথা তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। স্বাধীনতার পর১৯৭৩সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত মূলত নুর হোসেনই স্যার রহমতগঞ্জের কোচের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

মোহাম্মদ সুলতান ৭৪ বছরের প্রবীণ ফুটবলার। ৬০হতে ৭০ দশক পর্যন্ত খেলা নিজ দলের সহযোদ্ধা ফুটবলারদের অনেকেই এখন জীবিত নেই। আওয়াল, আমিন তার চেয়ে বয়সে ১০/১২ বছরের বড় হলেও তাদের অনুপ্রেরণায় পাড়ার ক্লাব রহমতগঞ্জের হয়ে খেলেছেন একসঙ্গে। যাদের নাম না বললেই নয়, নারায়নগঞ্জের আলিম, গেন্ডারিয়ার শাহজাহান, রক্ষণ ভাগের আমিনুর, সালেহ,তমিজ, কালা ইউসুফ, নাবিব, সোহেল, জামান, হাসনাত এরা ছিলো স্বাধীনতাত্তোর রহমতগঞ্জের দুর্দান্ত টিম ওয়ার্ক ও তার সহযোদ্ধা।

১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের প্রথম পর্বের খেলায় তৎকালীন দেশ সেরা দল ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। গোল পোস্টে নুরুল ইসলাম, রক্ষণ ভাগে জাকারিয়া পিন্টু, আইনুল মন্জু, জহির(সম্ভবত ভাই)সহ চীনের প্রাচীর খ্যাত মোহামেডানের ডিফেন্স। সেই ডিফেন্ডারদের আতংক হয়ে উঠেছিলেন সুলতান। সাদা-কালো”র গোল সীমানায় একক নৈপুণ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার হিসেবে আবির্ভূত হয়ে উঠেছিলেন সুলতান। সহপাঠীদের কাছ থেকে বল পেলেই যেন ক্ষিপ্রতায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করতেন সুলতান। মোহামেডানের রক্ষণ প্রাচীর ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছিলেন সেই দিন। মাঝ মাঠ থেকে বল পেয়ে একক প্রচেষ্টায় একে একে দুই তিন জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে মাটি কামড়ানো বুলেট গতির শটে মোহামেডানের গোলরক্ষ নুরুল ইসলামকে পরাজিত করে বলটি যখন জাল স্পর্শ করে তখন গ্যালারিতে থাকা পাড়ার সমর্থকদের উল্লাসের স্মৃতি আজও তার মনে জীবন্ত। এক গোলে পিছিয়ে গোল পরিশোধে মোহামেডান যখন মরিয়া তখন সুলতান আবার আঘাত হানেন সাদা-কালো”র গোল সীমানায়। কর্নার প্রান্ত থেকে একটি মাইনাস সুলতানের কাছে এলে বুকে রিসিভ করে আবারো মাটি কামড়ানো কামানের গোলার আঘাতের মতোই তীব্র ভলি শটে মোহামেডানের গোলরক্ষককে দ্বিতীয় বারের মতো পরাজিত করে জালে পাঠিয়ে দেন বল। দুই দশেকের ফুটবল জীবনে সুলতানের সেই ম্যাচটি আজও ৭৪ বছর বয়সে স্বরণীয় হয়ে আছে। ঢাকার মাঠের ফুটবল উন্মাদনা উত্তাল সময়ের স্মৃতিচারণ করছিলেন ৭০ দশকের ঢাকার শার্প শ্যুটার খ্যাত ফুটবলার সুলতান। এরপর মোহামেডানের গোলসীমায় হ্যাটট্রিক সুযোগটি পেয়েও ঝুঁকি নেননি। ওই দিন খেলা শেষ হওয়ার ১৫/২০ মিনিট আগেই দুই দলের সমর্থকরা মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন যা গ্যালারির ছাড়িয়ে মাঠেও গড়ায় খেলা পরিত্যক্ত হয় কিন্তু ফলাফল পরিবর্তণ হয়নি।তবে সুলতানের আর হ্যাটট্রিক করা হয়নি। শুধু মোহামেডানই নয়, ৭৩ সালে আবাহনী ক্রীড়া চক্রকেও রহমতগঞ্জ ১-০ গোলে হারিয়ে ছিলো। ওই ম্যাচেও মাঠে গোলযোগ হয়েছিলো।

১৯৬৩ সালে রহমতগঞ্জের হয়ে সুলতান তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলা শুরু করেন ৯ নাম্বার জার্সি গায়ে। ওই বছরই চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উন্নীত হয় রহমতগঞ্জ। ৬৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে রহমতগঞ্জ। একবছর পর ৬৫ সালে দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে রহমতগঞ্জ। ৬৬ সাল থেকে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে পাড়া ভিত্তিক ক্লাব রহমতগঞ্জের যাত্রা শুরু হয় লীগ ফুটবলে। কিশোর বয়স পেরিয়ে সুলতানও টগবগে তরুণ লড়াকু সৈনিক। ষাট দশকে ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ইপিআইডিসি, ভিক্টোরিয়া ক্লাব, ওয়ারীসহ পাকিস্তানের অফিস ক্লাবগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রহমতগঞ্জকেও ডাবল লীগের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হতো। ঘরোয়া লীগ ছাড়াও স্ট্রাইকার সুলতান খেলেছেন তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় প্রাদেশীক চ্যাম্পিয়নশীপে ঢাকা জেলার হয়ে। জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়নশীপে ঢাকা জেলা সুলতানের কৃতিত্ব পূর্ণ হ্যাটট্রিকে পাবনা জেলাকে হারিয়ে ৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানে চূড়ান্ত পর্বে খেলতে যান ঢাকা জেলার হয়ে। ৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান একাদশের হয়ে নেপাল খেলতে যান।

গোল লালবৃত্ত চিহ্নিত সুলতান

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ফুটবল লীগ শুরু হলে সুলতান রহমতগঞ্জের অধিনায়কের দায়িত্ব পান। একটানা ১৯৭৩ থেকে ৭৬ সাল পর্যন্ত ১০ নাম্বার জার্সি গায়ে সুলতান রহমতগঞ্জের হয়ে প্রতিপক্ষের গোল সীমানায় তান্ডব চালিয়েছেন চার বছর। সুলতানের পায়ে বল থাকলে প্রতিপক্ষের গোলরক্ষকের মাঝে আতংক বিরাজ করতো। ৭০ দশকের দূর্দান্ত স্ট্রাইকার সুলতানের অধিনায়কত্বে ৭৩ সালে রহমতগঞ্জ ভারতের পশ্চিম বাংলায় বরদলাই ট্রফিতে অংশ গ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালের লীগ চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর হয়ে তিনি আইএফশিল্ডে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া সুলতান ঢাকা মোহামেডানের হয়ে ৭৫ এ আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেন। দেশ সেরা দু’দলের হয়েই টুর্নামেন্ট খেললেও সুলতান ফুটবল লীগের পাড়ার ক্লাব প্রিয় দল রহমতগঞ্জের জার্সি কখনো বদল করতে চাননি। ৭৭ সালে ক্লাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে মনমালিন্য হওয়ায় দুঃখ নিয়ে দল ছেড়ে ঢাকাইয়াদের আরেক ক্লাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে যোগদান করেন। এরপর ৮১ সালে ফুটবলার মন্জুর অনুরোধে আবার তার প্রিয় পাড়ার ক্লাব রহমতগঞ্জে ফিরে এসে লীগ ফুটবল থেকে অবসর নেন।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার সময় আবাহনীর ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামাল বলেছিলেন, সুলতান আগামী মৌসুমে আমার আবাহনীতে খেলবে। সেই দিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে ৭৪ বছরের প্রবীণ ফুটবলার সুলতান আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। শেখ কামাল ভাই জাতির পিতার সন্তান হলেও কখনও তার মধ্যে অহংকার দেখিনি। শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানার ভাই বাবুল আমার বন্ধু হওয়ায় আমরা বকসি বাজার মাঠে একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম। খেলা শেষে প্রায়ই তাদের বাড়িতে যেতাম আড্ডা দিতে। তখন সুলতানা ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠে অনুশীলন শেষে ঘরে ফিরতেন। কামাল ভাই জানতেন আমার সঙ্গে সুলতানার ভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা। তাই জাতীয় দলের অনুশীলন বা কোনো কারণে মাঠে দেখা হলে মজা করে আমাকে বলতেন, “সুলতান আমি পুরান ঢাকারই আত্নীয় হবো।“ কিন্তু কখনো আমি বিষয়টি ভাল করে বুঝতে পারিনি। সুলতানাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম কেন কামাল ভাই আমাকে মাঝে মধ্যে পুরান ঢাকার আত্নীয়তার কথা বলতেন।

মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্ট থেকে দেশে ফিরে স্বপরিবারে জাতির জনক, শেখ কামাল ও সুলতানার নিহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাটি তার ফুটবল জীবনের অনেক কিছুই অপূরনীয় ক্ষতের সৃষ্টি করেছে বলে তিনি মনে করেন। তার আর আবাহনীতে খেলা হয়নি। মালয়েশিয়ায় কায়কোবাদ ভাই ঢাকা মোহামেডানে খেলার অনুরোধ করলেও তাও আর রক্ষা করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ঘরের ক্লাব রহমতগঞ্জে থেকে গিয়েছিলেন, বলছিলেন সুলতান আহম্মেদ। সেই ষাট দশক হতে আশির দশক পর্যন্ত ফুটবলের যে উন্মাদনা ছিলো তা এখন আর নেই। সেই সময় খেলোয়াড়দের একটা আলাদা সম্মান ছিলো। যেখানেই আমরা যেতাম, শত শত মানুষ তাদের প্রিয় ক্লাব ও ফুটবলারদের প্রতি ভালবাসায় একনজর দেখতে জড়ো হতেন। ঢাকার বাহিরে খেলতে গেলে জেলার লীগ হোক আর খ্যাপ খেলা হোক খেলোয়াড়দের জামাই আদরে আপায়ন করা হতো। এখনকার ফুটবলাররা সারা দিন ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ালেও তাদের কেউ চিনে না। কারণ ফুটবলের নেই সেই উন্মাদনা, দর্শকপ্রিয়তা।

প্রবীণ এই ফুটবলার বললেন, “আগে ফুটবলারদের মধ্যে নিজস্ব মেধা, স্কীল, বুদ্ধিমত্তা কাজ করতো। এখন খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত স্কীল বলে কিছু নেই। আর ব্যক্তিগত স্কীল মেধার বিকাশ ঘটাতে নিজেকে আলাদা অনুশীলন করতে হয়। কোন তারকা ফুটবলারের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ফলো করে নিজেকে সেভাবে গড়ে তুলতে নিবিড় অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। বেশী বেশী বিদেশী ফুটবল ম্যাচগুলো দেখে নিজের ক্যারিয়ারে তা কাজে লাগাতে অনুশীলন করতে হয়। এখনকার স্ট্রাইকার ওয়ান ইশ টু ওয়ান হলেই ডিফেন্ডের কাছে বল জমা দিয়ে দেন অথবা নিজের কাছ থেকে বল হারিয়ে ফেলেন। আমাদের সময় সালাউদ্দিন ভাই, হাফিজ ভাই, এনায়েত ভাই, চুন্নু, নওশেরের পায়ে মাঝ মাঠে বল থাকলেও প্রতিপক্ষের গোলরক্ষকের বুকে কাঁপন ধরতো। কারণ দুই/চার ডিফেন্সকে কাটিয়েও গোল কারার সক্ষমতা এদের ছিলো।“

ষাট হতে সত্তুর দশকে মাঠ কাঁপানো ফুটবলার সুলতান ৭৪ বছর বয়সে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের প্রবীণ খেলোয়াড় হিসেবে আজও ঢাকার মাঠের কালের সাক্ষী হয়ে আছেন। পুরান ঢাকা তথা রহমতগঞ্জে তার সহপাঠীদের কেউই আজ জীবিত নেই। এই বয়সে এখনো সময় ও সুযোগ পেলে সোনালী অতিত ক্লাবের হয়ে বল হাতে মাঠে নেমে পড়েন।

সুলতানের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৫ অক্টোবর পুরান ঢাকার রহমতগন্জের হাজী বাল্লু রোডে নিজ পৈতৃক বাসায়। ব্যাক্তিগত জীবনে সুলতান বিবাহিত। ১৯৮০ সালে নয়াবাজার আওলাদ হোসেন লেনে রোকসানা বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০০৮ সালে রোকসানা প্রয়াত হন। সুলতান তিন সন্তানের জনক। তাদের একমাত্র কণ্যা সুনিতা সুলতানা, দুই ছেলে তাহমিন আহম্মেদ ও সাকিব আহমেদ। এরা বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।

একনজরে মোঃ সুলতান আহম্মেদ:

১৯৬৩ সালে কিশোর বয়সে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে রহমতগঞ্জের হয়ে খেলা শুরু করেন। ওই বছরই রহমতগঞ্জ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উন্নীত হয়।
১৯৬৫ সালে রহমতগঞ্জ দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে উন্নীত হয়।
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি রহমতগঞ্জের হয়ে লীগ ফুটবলে খেলেন।
১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে খেলেন।
১৯৮১ সালে আবার পুরনো দল রহমতগঞ্জে ফিরে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সালে তিনি রহমতগঞ্জের হয়ে আগা খান গোল্ডকাপে অংশ নেন।
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত তিনি থাকা ঢাকা সদর মহুকুমা ও ঢাকা জেলার হয়ে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নেন।
১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান একাদশের হয়ে নেপাল সফর করেন।
১৯৭৩ সালে রহমতগঞ্জের হয়ে ভারতের বরদুলাই ট্রফিতে অংশ নেন।
১৯৭৪ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ান আবাহনী ক্রীড়া চক্রের হয়ে ভারতের কোলকাতায় আইএফশিল্ডে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৩ সালে রাশিয়ার মিনিকাকস ডায়নামো একাদশের বিরুদ্ধে ঢাকা ও কুমিল্লায় দুটি প্রদর্শনী ম্যাচে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন একাদশ ও ঢাকা একাদশের পক্ষে অংশ নেন।
১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ সালে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়ানশীপে ঢাকা জেলার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন ও চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে মালয়েশিয়ায় মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭২ সাল হতে ১৯৭৬ পর্যন্ত রহমতগঞ্জের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮১সালে তিনি ফুটবল লীগ হতে অবসর গ্রহন করেন।
তার দুই দশকের ফুটবল জীবনে খেলার মাঠে কখনও লাল কার্ড দেখেননি।