ফুটবলার ইকবালের স্বপ্ন ভেঙেছে একটি রাফ টেকলিং

“একটি দূর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না”। এটি একটি বিজ্ঞাপনের সংলাপ হলেও বাস্তবেও তাই। এমনি একটি দূর্ঘটনা প্রতিভাবান একজন ফুটবলারের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিলো। তবে সেই দূর্ঘটনা সড়কে নয়, ঢাকা স্টেডিয়ামের ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের রাফ ট্যাকলিংয়ে ডান পায়ের ‘নি‘ ভেঙে আর ফুটবল পায়ে দাঁড়াতে পারেননি সেই প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলার।

বলছিলাম ষাটের দশকে ঢাকার মাঠে তৎকালীন পূর্ব বাংলা যুব ফুটবল দল ও ফায়ারসার্ভিসের সেন্টার ফরোয়ার্ড একেএম ইকবাল চৌধুরীর কথা। স্বাধীনতাত্তোর ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠে গোলপোস্টের পেছনে ক্যামারা হাতে দাড়িয়ে থাকা ফটোগ্রাফার বা আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবেই ইকবাল সবার কাছে পরিচিত ছিলেন।

ষাট দশকের এই প্রতিভাবান দূর্ধষ স্ট্রাইকার যেকোন দলের রক্ষণভাগ বা গোলরক্ষকের জন্য ছিলেন এক আতঙ্কের নাম। সেন্টার ফরোয়ার্ড ইকবাল মাঝ মাঠ, রাইট বা লেফট উইং যেকোন প্রান্ত থেকে বল নিয়ে প্রতিপক্ষের দুই/চার জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে অনায়েসে লক্ষ্য বস্তু গোলপোস্টের জালে পৌঁছে দিতেন। অসাধারণ ড্রিবলিং, বল প্লেসিং ও দুই পায়ে জোড়ালো শটের অধিকারী ছিলেন ইকবাল।

ইকবালের এই অসাধারণ দক্ষতা ও ফুটবল প্রতিভার অন্যতম কারণ পূর্ব পুরুষদেরও ফুটবল দক্ষতা। তার পিতা ইয়াহিয়া চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত পূর্ব বাংলার কোলকাতা এরিয়ান্স ক্লাবের ডিফেন্ডার। চাচা আশরাফ চৌধুরী ছিলেন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবলার ও কোচ। স্বাভাবিকভাবেই ফুটবলের সঙ্গে ছিলো রক্তের সম্পর্ক।

ষাটের দশকে ঢাকার ফুটবলের এই প্রতিভাবান ফুটবলারের জন্ম কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। তার ফুটবলের যাত্রা শুরু ইন্টার স্কুল ফুটবল দিয়ে। ৬৬ সালে দাউদকান্দি সোয়া গাজী হাই স্কুলের হয়ে খেলেন। পরের বছরই যুব ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ দিতে ঢাকায় আসেন জার্মানির ফুটবল কোচ রেসলি কোটিয়ার। সারা পূর্ব বাংলা থেকে কয়েক শত তরুণ ফুটবলার এসেছেন ঢাকার এই বাছাইয়ে। জার্মান কোচ রেসলি কোটিয়ার নিজে খেলোয়াড়দের বল দিয়ে নানাভাবে পরীক্ষা নিচ্ছেন বাছাইয়ের জন্য। ইকবাল মুখোমুখি রেসলির। রেসলি বলটি উচু করে দিলেন ইকবালের উদ্দেশ্যে। ইকবাল অসাধারণ দক্ষতায় বলটিকে মাটিতে থামিয়ে রিসিভ না করেই আলতোভাবে পায়ে নিয়ে জোড়ালো শটে অপ্রস্তুত গোলরক্ষক পরাজিত করে বল জালে পাঠালেন। জার্মান কোচ রেসলি উপস্থিত কর্মকর্তাদের বললেন, “এই ছেলের পূর্ব পুরুষদের খোঁজ নিন, কেউ ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন কিনা।“ তখন কর্মকর্তারা জানতে পারলেন ইকবাল একজন জাত ফুটবলার। তার রক্তে মিশে আছে ফুটবল। প্রায় ৩ শতাধিক ফুটবলার হতে বাছাই করা ৮০ জনে স্থান করে নেন ইকবাল। জার্মান কোচের অধীনে প্রশিক্ষণ পেয়ে তরুণ ইকবাল আরও পরিনত ফুটবলার হয়ে উঠেন। তৎকালীন জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়ানশীপে ইকবাল পূর্ব পাকিস্তান যুব দলের হয়ে অংশগ্রহণ করেন। ওই সময় বিভাগীয় দল, সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহন করতো। জার্মান কোচ রেসলি কোটিয়ার প্রথমে ৮০ ও পরে পূর্ব পাকিস্তান যুব একাদশ দলের জন্য ১৬ জন খেলোয়াড় চূড়ান্তভাবে সিলেক্ট করেন। তার মধ্যে ইকবাল সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন। ৬৭ সালে চট্টগ্রাম বিভাগকে ৩-১ গোলে হারিয়ে পূর্ব পাকিস্তান যুব দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।ইকবাল একাই ২টি গোল করেন। প্রথমার্ধে ০-১ পিছিয়ে পরেও ইকবালের দুর্দান্ত দুই গোলে শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলে জয়ী হয় পূর্ব পাকিস্তান যুব দল। পরের বছর জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়নশীপ ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান যুব দল চট্টগ্রাম বিভাগকে ২-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উন্নীত হয়। দুটি গোলই এসেছিলো স্ট্রাইকার ইকবালের পা থেকে। ফাইনালে সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় একাদশের মুখোমুখি হয়। নির্ধারিত সময়ে খেলায় কোন পক্ষই গোল করতে না পারায় অতিরিক্ত সময় গড়ায়। ১২০ মিনিটের অতিরিক্ত সময়ের খেলায় ১ গোলে জয়ী হয় সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয়। খেলার ফলাফল নির্ধারণী গোলের সময় পূর্ব পাকিস্তান যুব একাদশের গোলরক্ষকের চোখে দর্শকরা ধূলো দিয়ে দিলে গোলরক্ষক বল দেখতে না পাওয়ায় বিতর্কিত গোলে হেরে যায় পূর্ব পাকিস্তান যুব একাদশ।

মাত্র ১৯ বছর বয়সের দুর্ধর্ষ ফুটবলার ইকবালের জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়নশীপে চমৎকার নৈপুণ্যে কারণে চাচা মোহামেডানের ফুটবলার আশরাফ তাকে ঢাকার লীগে খেলানোর চিন্তা ভাবনা করেন। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় তৎকালে মারকানি খেলোয়াড়দের সঙ্গে টিকে থাকা কঠিন ছিলো। তাই সাহস সঞ্চয়ের জন্য প্রথমে তৎকালীন আরামবাগের হয়ে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলেন। পরের বছরই ঢাকার প্রথম বিভাগ লীগে ফায়ারসার্ভিসের হয়ে ঢাকা রেলওয়ের বিরুদ্ধে খেলেন। ফায়ারসার্ভিস তখন প্রথম ৫/৬ টি ম্যাচ হেরে লীগে পিছিয়ে ছিলো। ষষ্ঠ ম্যাচে রেলওয়ের বিরুদ্ধে ইকবাল দুর্দান্ত খেলেন।

ময়মনসিংহ স্টেডিয়ামে জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়নশীপে পূর্ব পাকিস্তান যুবএকাদশের হয়ে বসা বামদিকে প্রথম

পরের বছর ৬৯ সালে ঢাকার ফুটবল লীগে ঢাকা মোহামেডান ছিলো এক দুর্ধর্ষ টিম। মারকানি খেলোয়াড় আলি নেওয়াজ, আমির বক্স, রসুল বক্স, আব্দুল্লাহ রাহি, বাঙ্গালী জহির, টিপু, প্রতাপ শংকর, নুরুন্নবী ও সান্টু প্রমূখরা ছিলেন। ৫মে ফায়ারসার্ভিসের মুখোমুখি হয় ঢাকা মোহামেডান। খেলা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইকবাল মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে ঢাকা মোহামেডানের রক্ষণভাগকে তছনছ করে গোল করে ১-০গোলে ফায়ারসার্ভিসকে এগিয়ে নেন। ফায়ারসার্ভিসের সঙ্গে ১ গোলে পিছিয়ে মোহামেডান মরিয়া হয়ে উঠে গোল পরিশোধে। কারণ মোহামেডান লীগে তখনও কোন ম্যাচ হারেনি। মোহামেডানের সকল খেলোয়াড়ই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে খেলছিলো। এমনই এক মূহুর্তে সেন্টার ফরোয়ার্ড ইকবাল বল নিয়ে ডি বক্সের ভেতরে ঢুকে গোলে শট নেয়ার আগ মূহুর্তে গোলরক্ষক সান্টু’র রাফ টেকলিং এর শিকার হন। ইকবাল পায়ে গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তার ডান হাটুর ‘নি‘ ভেঙ্গে যায়। আর খেলতে পারেননি। আহত হয়ে মাঠ ত্যাগ করেন। এরপর মোহামেডান ১ গোলে পিছিয়ে থেকেও পরে ২-১ গোলে জয়ী হয়। ফায়ারসার্ভিসের শিবিরে নেমে আসে শোকের ছায়া। ভারাক্রান্ত মনে মাঠ ছাড়েন ফায়ারসার্ভিসের খেলোয়াড়েরা। মোহামেডানের গোলরক্ষক সান্টুর একটি রাফ টেকলিংয়ে হাটুর ‘নি‘ ভেঙ্গে ঢাকার ফুটবলের এক দুর্ধর্ষ প্রতিভাবান ফুটবলারের খেলোয়াড়ী জীবনের সাফল্যে ও অগ্রযাত্রা থেমে যায়।

তৎকালে হাটুর ‘নি‘ এর তেমন উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাও ছিলো না। তাই প্রতিভাবান ফুটবলার ইকবালের ভবিষ্যৎ বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন হাটুর ‘নি‘ এর হাড়ের মতোই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আর ফুটবল পায়ে মাঠে গোলের ম্যাজিক দেখাতে পারেননি জাত ফুটবলার ইকবাল। পরিসমাপ্তি ঘটে ঢাকার এক সম্ভাবনাময় তরুণ ফুটবলারের খেলোয়াড়ী জীবন। ওই সময়ে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে মাঠে থাকা ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু’র দৃষ্টিতে ইকবাল ছিলেন একজন প্রতিভাবান ফুটবলার। তার খেলা এক্সট্রা অডিনারি ছিলো। তার বাপ-চাচারাও ফুটবলার ছিলেন। রক্তেও ফুটবল মিশে ছিলো।

ষাট দশকের ঢাকার কামাল স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড় ও বর্তমান ক্রীড়া সংগঠক আজফার-উজ্জামন-সোহরাব বললেন, ইকবালের খেলা আমিও দেখেছি। অসাধারণ দক্ষতা ছিলো বল নিয়ন্ত্রণে। তিনি বলেন, একটি রাফ টেকলিং একজন প্রতিভাবান ফুটবলারের খেলোয়াড়ী জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিলো। সবই ভাগ্যের ব্যাপার।

স্বাধীনতার পর আবুল কালাম মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী তার শখ ও নেশার ফটোগ্রাফির কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি আর গায়ে জার্সি, পায়ে বুট আর বল হাতে মাঠে নামেননি। তবে ঢাকা স্টেডিয়ামে নেমেছে হাতে ক্যামারা নিয়ে। ফুটবল মাঠে কখনো সাইড লাইনের পাশে, আবার কখনো গোল পোস্টের পেছনে। এবার আর গোল করা নয়, অন্যের গোলের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা।

ঢাকার ফুটবলের উন্মাদনা ও উত্তাল দিন গুলোর কথা মনে হলেই ফিরে যান সেই দুঃসহ স্মৃতিময় ৫ মে ১৯৬৯ সালের হাটু ভাঙ্গার দিনটিতে। অনেক সময় গোলপোস্টের পেছনে দাড়িয়ে নিজের অজান্তেই চোখের পানি মুছুছেন কত দিন তার হিসাব নেই। নিজে ফুটবলার হওয়া স্বপ্ন পুরণ না হওয়ায় সন্তানদেরও আর ফুটবলার হতে দেননি। ৭৪ বছরের একেএম ইকবাল চৌধুরী বাংলাদেশের ৬ জন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার ছিলেন। ফুটবল মাঠ ও রাজনীতির বহু ঘটনার সাক্ষী ইকবাল চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেও নেননি কোন সনদ। কারণ তিনি মনে করেন দেশপ্রেমিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে দেশকে শত্রু মুক্ত করতে যুদ্ধ করেছি, ভাতা খাওয়া কিংবা কোটার সুবিধা পাওয়ার জন্য নয়। ৭৪ বছরে অবসরপ্রাপ্ত আলোকচিত্র সাংবাদিক ইকবাল চৌধুরী বর্তমানে ঢাকার মোহাম্মদপুরে বসবাস করছেন। স্ত্রী মোহসেনা চৌধুরী, বড় ছেলে মোস্তফা চৌধুরী আয়ারল্যান্ডে পড়াশোনা করছেন। ছোট ছেলে ইকরাম চৌধুরী পিআইডিতে আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত।

গ্যালারি মাতানো পাগলা মুজিবর আবাহনী সমর্থক হওয়ার পেছনের গল্প – CTG SANGBAD24

বাংলাদেশের ফুটবলে ভুলে যাওয়া নাম সত্তুর দশকের শার্প শ্যুটার সুলতান – CTG SANGBAD24

ঢাকার ফুটবল উন্মাদনাঃ কসাইদের মোহামেডান আর রহমতগঞ্জের ডাইলপট্টির কথা – CTG SANGBAD24

বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি – CTG SANGBAD24

পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প – CTG SANGBAD24

ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু – CTG SANGBAD24

আরও পড়ুন