পূর্ববঙ্গের মুসলিম জাগরণে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো মূলতঃ পুরান ঢাকায়। ১৯২৭সালে নবাবদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে মুসলিম স্পোটিং ক্লাব নামে ঢাকার হাজারীবাগের ২৫ মনেশ্বর রোডে তৎকালীন পাকিস্তান মাঠ (বর্তমান বাংলাদেশ মাঠ) এলাকার কয়েকজন এ্যাথলেট, সাইকেলিষ্ট, ক্রীড়াপ্রেমী ও ফুটবলারদের যৌথ সভায় মুসলিম তরুণ সমাজকে খেলাধূলার মাধ্যমে জাগ্রত করতে মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিা করা হয়। আর মূলতঃ এই ক্লাব প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালিন পূর্ববাংলার অ্যাথলেট ও ফুটবলার হাজী আব্দুল আওয়াল। হাজী আব্দুল আওয়াল ঢাকা-৮ এর প্রয়াত সাংসদ নাসির উদ্দিন পিন্টু”র নানা। মূলত তার উদ্যোগেই মুসলিম জাগরণে এই ক্লাবটির জন্ম হয়। হাজী আব্দুল আওয়ালের আদিবসতি পাকিস্তান মাঠ এলাকায় হলেও তিনি বসবাস করতেন হাজারীবাগের মনেশ্বর রোডে। পরবর্তিতে ৩০ দশকের মাঝামাঝি কোলকাতা মোহামেডানের খ্যাতিমান ফুটবলার মোহাম্মদ শাহজাহান ঢাকা ফিরে আসেন এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকার মুসলিম জাগরণে অগ্রনী ভুমিকা পালনকারী ক্লাব মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব নামে ঢাকার ফুটবল মাঠ তথা ক্রীড়াঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন। ওই সময় ঢাকার মাঠ দাপিয়ে বেড়াতো ওয়ারী ক্লাব ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও পর্বরতিতে ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাব। হাজী আব্দুল আওয়াল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবলার ছিলেন। এরপর ওয়ারী, ঢাকা ওয়ান্ডার্স এবং ভিক্টোরিয়ার আধিপত্যকে পেছনে ফেলে ৫০ দশকের মাঝামাঝি ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লীগ শিরোপা জয়ের মাধ্যমে ঢাকার ফুটবল ও অন্যান্য খেলাধুলায় আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে মুসলিম জাগরণে মোহামেডান পূর্ব বাংলার ক্রীড়াঙ্গনে জনপ্রিয় ক্লাবে পরিনত হয়। প্রায় শত বছরের পুরনো ও ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের সর্মথকদের নিয়ে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে তা হলো মোহামেডান কসাইদের দল। অর্থাৎ মোহামেডান সমর্থনকদের মধ্যে কসাইয়ের সংখ্যাই বেশী। স্বাধীনতার পর পরই ঢাকার ফুটবল লীগে মোহামেডান সমর্থকদের কসাই বলে প্রতিপক্ষের সমর্থকরা বিদ্রূপ করতো। কেন মোহামেডান সমর্থকদের কসাই সমর্থকদের দল বলতো। ৭০ দশকে ঢাকার কাপ্তান বাজার তথা ঠাটারী বাজারে হাক্কা কসাই নামে এক মাংস ব্যবসায়ী ছিলেন। হাক্কা কসাইয়ের ২০-২৫টি মাংসের দোকান ছিলো। স্টেডিয়াম পাড়ায় হাক্কা কসাইয়ের দাপট ছিলো। ১৯৭০ সালে হাক্কা কসাই ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের ৭ জন ফুটবলারকে বাগিয়ে নিয়ে দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের শক্তিশালী ফুটবল দল গঠন করেন। ওই বছর দিলকুশা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে রানার্সআপ হয়। একই সময়ে ঠাটারিবাজারের আরেক মাংশ ব্যবসায়ী হামিদ কসাই। পুরান ঢাকার বংশাল, নবাবপুর, ওয়ারী, কাপ্তান বাজার, ঠাটারীবাজার হতে কমলাপুর পর্যন্ত হামিদ কসাইয়ের ছিলো প্রায় অর্ধশত মাংশের দোকান। হাক্কা কসাইকে পেছনে ফেলে ঢাকা মোহামেডানের পক্ষে অবস্থান নেন হামিদ কসাই । মোহামেডানের খেলার দিন হামিদ কসাই তার মাংশের দোকানের শত শত কর্মচারীদের নিয়ে গ্যালারিতে বসে ঢাকা মোহামেডানকে সমর্থন দিতেন। তার সঙ্গে থাকতো বড় বড় মাংশ কাটার চাপাতি-ছুরি। মূলত ঢাকা মোহামেডানের প্রতিপক্ষ ছিলো ঢাকাইয়াদের আরেক জনপ্রিয় ক্লাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। তাই হামিদ কসাই ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সমর্থকদের মোকাবেলা করতে গ্যালারীতে আসতেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে। এই হাক্কা কসাই ও হামিদ কসাইয়ের দাপটে স্টেডিয়াম পাড়ায় অন্যকোন দলের সমর্থকরা দাঁড়াতেই পারতেন না। ওই সময়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসা দর্শকদের কাছ থেকে এমনটাই শোনা যায়।
পঞ্চাশ দশকের ফুটবলার ও অ্যাথলেট এবং সোনালী অতিত ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জগন্নাথ কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক প্রয়াত নুর হোসেন স্যারের সন্তান আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আম্পায়ার সায়লাব হোসেন টুটুল ষাট দশকে তার পিতার হাত ধরে ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসতেন। সেই সঙ্গে ঢাকার নবাবপুরে বাড়ি হওয়ায় নিয়মিত ঢাকা স্টেডিয়াম পাড়া চষে বেড়াতেন, কিশোর বেলায় ঢাকার ফুটবলের সেই উন্মাদনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা মোহামেডানের সমর্থক ছিলো হামিদ কসাই। হামিদ কসাইয়ের বর্নণা দিয়ে তিনি বললেন, দীর্ঘ দেহ আর মুখে গুটি বসন্তের দাগ ছিলো তার। স্বাধীনতার পরও মোহামেডানের খেলার দিন দলবল নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারীতে প্রবেশ করতেন। ঠাটারিবাজারের বিসিসি রোডের প্রথম গলিটি হামিদ কসাইয়ের নামে পরিচিত ছিলো। তবে মোহামেডানের সমর্থক শুধু কসাই এটা একটা অপপ্রচার বলে তিনি জানান।সমাজের ফুটবল পাগল সব শ্রেনীর মানুষ মোহামেডানের সমর্থক ছিলো। ঢাকার ফুটবল ও ক্রীড়াঙ্গনে মোহামেডান তার গৌরবময় সাফল্য দিয়েই জনপ্রিয় ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আশির দশকে মোহামেডানের সমর্থক হিসেবে দেশের শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, নায়ক-নায়িকা, বুদ্ধিজীবি হতে শুরু করে সমাজের সকল শ্রেনীর ক্রীড়ামোদীদের ক্লাবে পরিনত হয়েছে। এমন কি সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যেও মোহামেডান সমর্থকের একটি বড় সংখ্যা ছিলো। ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন বা ভলিবল সব খেলায়ই মোহামেডানের সাফল্য জয় করেছে মানুষের মন।
জনপ্রিয় ঢাকা মোহামেডানের কসাই সমর্থকদের নিয়ে নানা গুঞ্জন প্রতিষ্ঠিত ছিলো ঢাকাবাসীর মাঝে। যেমন মোহামেডান হারলে পর দিন ঠাটারিবাজারে গরুর মাংশের দাম বেড়ে যাওয়া। আবার জিতলে আনন্দে পরদিন ঠাটারিবাজারে গরুর মাংশের দাম কমে যাওয়া একটি প্রচলিত রেওয়াজ হয়ে দাড়িয়েছিলো। তবে ৭০ দশকের মাঝামাঝি মোহামেডান তার অসাধারণ ফুটবল নৈপূন্য আর সাফল্যে লাখ সমর্থকদের ভালবাসার ক্লাবে পরিনত হয়। স্বাধীনতা পূর্বকালীন সময়ে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও ততকালীন ইপিআইডিসি ও পর্বরতিতে বিআইডিসি”র সমর্থকরা ঢাকা মোহামেডানের বিপক্ষে অবস্থান নেন। পাড়া মহল্লা ভিত্তিক পুরান ঢাকার আরেকটি ক্লাব রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডেন্স সোসাইটি (রহমতগঞ্জ এমএফএস) ডাইলপট্টি নামে পরিচিত ছিলো। এই ক্লাবটিকে নিয়ে আরেকটি প্রবাদ প্রচলিত ছিলো। রহমতগঞ্জ দেশে বৃহত্তর পাইকারী ডাল ব্যবসার আড়ত থাকায় এই ক্লাবের জয়পরাজয় নিয়ে নানা প্রবাদের মধ্যে আলোচিত ছিলো রহমতগঞ্জ হারলেই ডাইলের দাম বাড়বে। জিতলে দাম কমবে।মোহামেডান বা অন্যকোন দলের সঙ্গে রহমতগঞ্জ হেরে গেলে গ্যালারীতে থাকা দর্শকরা বলতেন কাল ডাইলের দাম বেড়ে যাবে।ঢাকার ফুটবলের উন্মাদনার সেই সময়কালে পাড়া ভিত্তিক ক্লাবগুলো নিয়ে নানা গল্প-গুঞ্জন প্রচলিত ছিলো। তবে ফুটবলে এখন আর সমর্থকদের মাঝে নেই আর উন্মাদনা। নেই ফুটবলের জনপ্রিয়তা।
বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি – CTG SANGBAD24
পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প – CTG SANGBAD24