বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি

ফুটবল উন্মাদনা

লাখো ক্রীড়া প্রেমিক ও ফুটবল ভক্তের জনপ্রিয় দল আবাহনী ক্রীড়া চক্র। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের হাতে গড়া আবাহনীর ক্রীড়া চক্র আজকের জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাস। আত্মত্যাগের ইতিহাস। এক সাগরে রক্তের বিনিময়ে যেমন বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তেমনি আবাহনীর দর্শকপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে অনেক ফুটবলারের রক্তাক্ত ইতিহাস এবং আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের অনন্য অবদান। শুধু আবাহনী ক্রীড়া চক্রই নয় ঢাকার পাড়া ভিত্তিক ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিা পাওয়ার পেছনেও রয়েছে শেখ কামালের অবদান।শেখ কামাল শুধু আবাহনী কে নিয়েই তার চিন্তা ভাবনা ছিলো না তিনি ফুটবল ক্রিকেট, বাস্কেটবল, হকিসহ দেশের সামগ্রিক ক্রীড়া উন্নয়ন এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের যুব সমাজকে ক্রীড়া, সংস্কৃতি দেশ গড়ার কাজে যুক্ত করে সত্যিকার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন।তিনি চেয়ে ছিলেন দেশের প্রতিটি জেলা শহরে তার প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্রীড়া চক্রের শাখা থাকবে।সেখানে তরুণ যুবক- কিশোররা খেলাধূলায় সম্পৃক্ত থাকবে।জেলা আবাহনীর সেরা ফুটবলাররা ঢাকার আবাহনীতে খেলবে।তৈরী হবে নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড়। সেই লক্ষ্য অর্জনেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আবাহনী ক্রীড়া চক্র।৭০এর দ্বিতীয় বিভাগ লীগ চ্যাম্পিয়ান হয়ে প্রথম বিভাগে উঠে আসা ইকবাল স্পোর্টিং ক্লাবের নাম বদল করে আবাহনী ক্রীড়া চক্র নামে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে যাত্রা শুরু করেছিলো ১৯৭২ সালে। আজকের আবাহনী ক্রীড়া চক্র লিঃ।পাকিস্তান আমলের দেশসেরা ক্লাব ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকাইয়াদের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব,আজাদ স্পোটিং ক্লাব, বিআইডিসি সহ অনেক গুলো ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়দের একত্রিত করে গঠন করেছিলেন আবাহনী ক্রীড়া চক্র।জনপ্রিয় ও তারকা ফুটবলারদের আবাহনীতে সামিল করার মূল কারন ছিলো এই জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের ভক্তরা হয়তো আবাহনীর ভক্ত হিসেবে ব্যাপক জনসমর্থন তৈরী হবে আবাহনীর পক্ষে। কিন্তু স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথম শুরু হওয়া দেশের প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে আবাহনী ক্রীড়া চক্র কে দেশের ফুটবল সমর্থকরা বরন করেনিতে পারেনি।বরং আবাহনী মাঠে নামলে গ্যালারিতে থাকা দর্শকরা ধিক্কার ধ্বনি দিতো।ততকালে ঢাকার ফুটবল লীগে ব্যাপক সমর্থক ছিলো ঢাকা মোহামেডান ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের।দুই দলেরই সেরা খেলোয়াড়দের বেশ কয়েকজনকে আবাহনী ক্রীড়া চক্রে সামিল করেছিলেন শেখ কামাল।কিন্তু সমর্থন বাড়ার বদলে আবাহনীর প্রতি ফুটবল সমর্থকদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে।


এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালের প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে আবাহনীর সঙ্গে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের খেলা।আবাহনী মাঠে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারিতে থাকা দর্শকরা দু–রহ দু–রহ ধ্বনিতে ধিক্কার দিতে থাকে।খেলা শুরুর ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই আবাহনী ১-০ গোলে এগিয়ে যায়।এ সময় আবাহনীর খেলোয়াড়দের কেউ কেউ গ্যালারিতে থাকা তাদের ধিক্কারের জবাব গোল দিয়ে দেয়ার আনন্দ প্রকাশ করে।সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের সমর্থকরা গ্যালারি থেকে কাটা তারের বেড়া টপকে মাঠে নামতে শুরু করে মূহুর্তেই শত শত সমর্থক মাঠে এসে চড়াও হয় আবাহনীর খেলোয়াড়দের প্রতি।ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের সমর্থকেরা লাঠি,ইট নিয়ে হামলা করতে থাকে আবাহনীর খেলোয়াড়দের উপর।অনেকেই মাঠ থেকে জার্সি খুলে দৌড়ে নির্মাণধীন ভিআইপি গ্যালারিতে কাজ করা শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে যান।দর্শকদের মারদাঙ্গা ও মারমুখী আচরণে মারাত্মক ভাবে আহতহন অমলেশ, বাদশা, সাদেক, গফুর (স্কুটার খ্যাত) দিপু ও টিপু।ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় সেই দিনের স্মৃতি মনে করে মাঠে আহত হওয়া আবাহনীর ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের অবদান ও ঢাকা স্টেডিয়ামের রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা এ ভাবেই বর্ণনা করছিলেন।

ষাট ও সত্তুর দশকের ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন,সেই দিন ঢাকা স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাস আবাহনীর খেলোয়াড়দের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো। গোলাম সারোয়ার টিপু ৭২ সালের সেই দিনটির তারিখ মনে করতে না পারলে মাঠে ঘটে যাওয়া দুঃসহ স্মৃতি ৫০ বছর বয়ে বেড়াচ্ছেন বললেন।বর্তমানে ৭৮ বছর বয়সী প্রবীণ ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কখনো চেহারায় আতংকের ছাপ ফুটে উঠছিলো, আবার কখনো আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছিলেন। সেই দিন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের সমর্থকদের হাতে সবচেয়ে বেশী মার খেয়েছিলেন অমলেশ সেন।তাকে এমন নির্দয় ভাবে মেরে রক্তাক্ত জখম করা হয়েছিলো যে তার গায়েও জার্সি -প্যান্ট কিছুই ছিলো না।এ ছাড়া অধিনায়ক সাদেক,গফুর,আলী ইমাম দিপুকে নির্দয় ভাবে পেটানো হয়েছিলো। মাঠ থেকে খেলোয়াড়রা স্টেডিয়ামের নির্মাণাধীন ভিআইপি গ্যালারী কনস্ট্রাকশন সেন্টারিং এর নীচে অনেকেই লুকিয়ে ছিলেন,তবে দর্শকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ব্যাতিক্রম।ফুটবলারদের ব্যাক্তিগত ফ্যান বা ভক্ত।তারা আমাদের অনেক কে রক্ষাও করেছেন বলছিলেন গোলাম সারোয়ার টিপু। মাঠে দর্শক প্রবেশ করে মারমুখি হওয়ার সময়ই মোহামেডানের জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ দাদা,কায়কোবাদ এরা মোহামেডানের উত্তর দিক গেট দিয়ে এসে আমাদের বার বার তাদের সঙ্গে মোহামেডান ক্লাবে চলে আসতে বললেও আমরা মনে করেছিলাম আমরা খেলোয়াড়েরাই হয়তো দর্শকদের বুঝাতে পারবো কিন্তু আমাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।দর্শকদের আচরণ ছিলো খুবই মারমূখি।যা কল্পনাও করা যায় না।পরে ভিআইপি গ্যালারী ও নির্মাধীন শেডের নীচ থেকে পিন্টু ভাই,প্রতাপ দাদা,কায়কোবাদ ভাইসহ মোহামেডানের বেশ কয়েকজন সমর্থক আমাদের মোহামেডান ক্লাব ট্যান্টে নিয়ে যায়। মারাত্মক আহত অমলেশ, দিপু,বাদশা, গফুর সহ অনেকে চিকিৎসার জন্য হলিফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যায়।এ ভাবেই রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে যার মতো আস্তে আস্তে একজন একজন করে মোহামেডান ক্লাব থেকে বের হয়ে বাড়ি চলে যাই।গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন,সেই দিনের দুঃসহ স্মৃতি আজও মনে হলে গা শিউরে উঠে। মারামারির সময় পুলিশের সংখ্যা কম থাকায় তাত্ক্ষণিক কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ।তাই আমাদের খেলোয়াড়দের এভাবেই মার খেতে হয়েছিলো।

গোলাম সারোয়ার টিপু মাঠে থাকা সেই দিন আবাহনীর খেলোয়াড়দের নাম বলতে গিয়ে জানান,যতদুর মনে পরে আবাহনীর খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন গোলরক্ষক মুসলিম, রক্ষন ভাগে ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র আনোয়ার,বাদশা, আশরাফ, দিপু,, অধিনায়ক সাদেক,মাঝ মাঠে অমলেশ,আলী ইমাম,গফুর আক্রমণ ভাগে সালাউদ্দিন,আমি টিপু বগুড়ার আফজাল প্রমুখ। আবাহনী প্রশিক্ষণ দিতেন কবীর ভাই ও চুন্না রশিদ ভাই।তখন নিদিষ্ট কোন কোচ প্রথা ছিলো না সিনিয়র খেলোয়াড় বা প্রাক্তন খেলোয়াড়রা প্রশিক্ষণ দিতেন।চুন্না ভাই ছিলেন পঞ্চাশ ও ষাট দশকে কোলকাতা মোহামেডান ও ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের খেলোয়াড় তিনি কোলকাতা থেকে বিমানে ঢাকা এসে ততকালীন পূর্বপাকিস্তান গভর্মেন্ট প্রেস দলের হয়ে ঢাকা লীগ খেলে আবার রাতেই বিমানে কোলকাতা ফিরে যেতেন।পরে ১৯৫২ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে পূর্ব পাকিস্তান গভর্নমেন্ট প্রেস লীগ চ্যাম্পিয়ান হলে চুন্না ভাইকে তারা ঢাকায় চাকরি দিয়ে স্হায়ী ভাবেই রেখে দেন।মূলত কবীর ভাই আর চুন্না ভাইয়ের প্রশিক্ষণে আবাহনীর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে যাত্রা শুরুকরে।স্বাধীনতার পর ফুটবল লীগের প্রথম আসরটি মারামারির কারনে বন্ধ বা অসমাপ্ত থেকে যায়।যা ছিলো দুঃখজনক ঘটনা।ওই সময় লীগের বিভিন্ন ক্লাবগুলো ৩/৪ করে ম্যাচ খেলে ছিলো।এর মধ্যে বাংলাদেশ ওয়াপদা ৩টি ম্যাচেই জিতে লীগের শীর্ষে ছিলো।নওশের গোলদাতার শীর্ষে ছিলেন।ওয়ারী ক্লাব তাদের তিনটি ম্যাচ হেরেই শূন্য পয়েন্ট নিয়ে সবার নীচে ছিলো।ওয়ারী ক্লাবের সভাপতি আবুল হাশেম ভাই একই সঙ্গে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।তাই হয়তো তারা লীগ আর চালিয়ে নেয়ার আগ্রহ না দেখিয়ে ভারতের আসামে বরদুলাই ট্রফিতে অংশ নিতে ঢাকা একাদশ দল গঠনে মনোযোগী হয়ে উঠেন।তাই শেষ পর্যন্ত আর স্বাধীনতার পর ফুটবল লীগের প্রথম আসরটিই অসমাপ্তই থেকে যায়।সেই দিন ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সমর্থকদের হামলায় ঢাকা স্টেডিয়ামের সবুজ মাঠ আবাহনীর খেলোয়াড়দের রক্তে রঞ্জিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে কলংকিত একটি অধ্যায়ের মধ্যেই লীগ পরিত্যক্তের রেকর্ডে ইতিহাস হয়ে আছে।গোলাম সারোয়ার টিপু বললেন,সেই দিন মাঠে আমারা আবাহনীর খেলোয়াড়রা মৃত্যু মুখ থেকে ফিরে এসেছিলাম।এমন মর্মান্তিক ঘটনার সময় সম্ভবত আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামাল একটি যুব প্রতিনিধি দল নিয়ে বিদেশে অবস্থান কর ছিলেন।পরে দেশে ফিরে তিনি সকল খেলোয়াড়দের প্রতি সহানুভূতি ও দুঃখ প্রকাশ করে নব উদ্দ্যামে খেলে যাওয়ার অনুরোধ করেন।তার দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে এমন মারমুখী আচরণ করার পরও তার মধ্যে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব বা তার সমর্থকদের প্রতি কোনপ্রকার ক্ষোভ বা প্রতিহিংসা দেখাননি।বরং শেখ কামাল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে বাস্কেটবল খেলা শুরু করেন এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব সংলগ্ন বাস্কেটবল কোর্টে নিয়মিত অনুশীলন করতেন।তিনি জনপ্রিয় ঢাকা মোহামেডান ক্লাবেও নিয়মিত আড্ডা দিতেন মোহামেডানের হয়েও বাস্কেটবল খেলতেন।তার এই খেলার মূল কারন ছিলো ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও মোহামেডান ক্লাবের সমর্থকদের মনজয় করে তাদের আবাহনীর প্রতি আকৃষ্ট করা।শেখ কামালের সঙ্গে ঢাকার গেরিলা যোদ্ধা ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে ঢাকা ভার্সিটির সূত্রেই একটি সুসম্পর্ক ছিলো। তাই শেখ কামাল তারুণ্যে গড়ে উঠা গোপীবাগের ব্রাদার্স ক্লাবের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন।বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী রুনা লায়লা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসলে ব্রাদার্স ক্লাবের ফান্ড গড়ে তোলতে মধুমিতা সিনেমা হলে রুনা লায়লার সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ২০ টাকা করে টিকেট শেখ কামাল নিজে আবাহনী ক্লাবের খেলোয়াড়, সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষকদের কাছে বিক্রি করেছিলেন।গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন শেখ কামাল আমাকেও ৩ টি টিকেট দিয়ে ৬০ টাকা আমার কাছ থেকে আদায় করে বলেছিলেন ভাই-বোনদের নিয়ে রুনা লায়লার গানের অনুষ্ঠানে আসতে।তিনি শেখ কামালকে বলে ছিলেন কামাল আমার জন্য ৬০ টাকা অনেক ব্যয়বহুল।কামাল বলেছিলেন আরেকটি ক্লাবকে সহযোগিতায় আমাদের সবার অবদান থাকা দরকার।এ ভাবেই শেখ কামাল ব্রাদার্স ক্লাবের জন্য অর্থ সংগ্রহে এগিয়ে এসেছিলেন। এ ছাড়া ব্রাদার্স ক্লাবের ট্যান্টটি স্থায়ীভাবে ক্লাবের নামে বরাদ্দ দিতেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। কারন শেখ কামাল প্রায়ই ক্লাবে বলতেন তার স্বপ্ন দেশের ফুটবল লীগে যদি ৬/৭ টি দল সমশক্তির হয় তবে খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা থাকবে সব দলে তারকা ফুটবলার থাকলে দর্শক ও খেলোয়াড়দের ব্যাক্তিগত ভক্ত বাড়বে।মাঠে দর্শক বাড়বে। বাড়বে ফুটবলের জনপ্রিয়তা ও উন্মাদনা। তাই শেখ কামাল আবাহনীর সমর্থন বাড়াতে কখনো হকি মাঠে,কখনো বাস্কেটবল মাঠে আবার কখনো বা বিভিন্ন ক্লাবগুলোর সমর্থকদের প্রতি আহবান জানাতেন আপনারা আমার আবাহনীকেও সমর্থন দিন।আমি একটি ভাল ফুটবল টিম করেছি।গোলাম সারোয়ার টিপু বললেন পরবর্তীতে শেখ কামাল আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মাধ্যমে দেশে আধুনিক ফুটবলের ধারা তৈরী করতে আইরিশ বংশদূত ব্রিটিশ ফুটবল কোচ বিল হার্ট কে এনে ৪-৩-৩ পদ্ধতির ইউরোপীয় ছকে দেশের ক্লাব ফুটবলে সারা জাগিয়ে ছিলেন।


স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রক্তাক্ত ফুটবলের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন,আজ শেখ কসমাল বেচে নেই। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্রীড়া চক্র আছে লাখ লাখ জনসমর্থন নিয়ে।৭৫এ জাতির পিতা স্বপরিবারে শহীদ হওয়া বঙ্গবন্ধু”র জেষ্ঠ্যপুত্র শেখ কামাল ছিলেন প্রথম শহীদ।৭৫এর ১৫ আগষ্টের পর আবাহনীর খেলোয়াড়দের মাঝে একটি ভয় কাজ করছিলো।কারন দেশে তখন বঙ্গবন্ধুর খুনীদের অবাধ বিচরন।শোনেছি আবাহনীতে খেলার কারনেই আবাহনীর খেলোয়াড় জামিল আক্তার কে নির্মম ভাবে খুন করা হয়েছিলো।আজও তার হত্যার রহস্য উদঘাটিত হয়নি।এমনি এক পরিস্থিতিতে ৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর আবাহনীর খেলোয়াড়রা প্রথমে দুই-চার জন করে ঢাকা মোহামেডান ক্লাব ট্যান্টে এসে একত্রিত হয়ে পরে ড্রেসিং রুমে গিয়ে মাঠে যেতেন খেলতে।গোলাম সারোয়ার টিপু বললেন,শেখ কামাল শহীদ হওয়ার পর যখন আবাহনী লীগ খেলতে ঢাকা স্টেডিয়ামে নামে তখন যেন এক ব্যাতিক্রমী চিত্র দেখা যায় গ্যালারিতে।যে দর্শকরা আবাহনীর খেলোয়াড়দের দু–র হ–দু—র -হ বলে ধিক্কার ধ্বনি দিতো তারাই আবাহনীর খেলোয়াড়দের প্রতি পরম সহানুভূতি দেখিয়ে বিপুল ভাবে করতালি দাড়িয়ে উল্লাস ও করতালি দিয়ে খেলোয়াড়দের সম্মান ও উৎসাহ দিয়েছিলেন।সেই রক্তাক্ত ইতিহাস পেরিয়ে আস্তে আস্তে ৭৫ এর পর আবাহনী ক্রীড়া চক্র একটি জনপ্রিয় ফুটবল দলে পরিনত হয়েছে আজ।

ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, বিআইডিসি,আজাদ স্পোর্টিং, দিলকুশা,ওয়ারী ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডানের প্রতিপক্ষ সমর্থকরা আবাহনী ক্রীড়া চক্র কে সমর্থন করতে থাকে।স্বাধীনতাত্তোর দেশের ফুটবল হয়ে উঠে মূলতঃ আবাহনী- মোহামেডান কেন্দ্রীক।দেশের ফুটবলের উন্মাদনায় ঢাকা মোহামেডানের প্রধান প্রতিদ্বন্দী হিসেবে ওয়াপদা, বিজিআইসি আবাহনী ক্রীড়া চক্র পরে ব্রাদার্স ইউনিয়নের আবির্ভাব ঘটে।এ ভাবেই স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের ফুটবলে তৈরী হয়েছিলো উন্মাদনা। ফুটবলের এ উত্তল ঢেউ এই বাংলা ছাড়িয়ে আছড়ে পড়েছিলো সিমান্ত পেরিয়ে ওপার বাংলার কোলকাতা পর্যন্ত। দুই বাংলার খেলোয়াড়দের কেউ খেলতে আসতেন ঢাকার লীগে আবার আবার কেউ ঢাকা থেকে খেলতেন যেতেন কোলকাতার লীগে।এ ভাবেই পূর্ব বাংলার ফুটবল আবার ফিরে পেয়েছিলো তার অতিত গৌরবময় ঐতিহ্য।

১৯৭৯ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরষ্কার প্রাপ্ত ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু”র ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রবেশে রয়েছে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,মামা ডাঃএম আর খান ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী।মামার হাত ধরে কিশোর বয়সে ফার্মগেট এলাকার বাসা থেকে ঢাকা স্টেডিয়ামে যাই খেলা দেখতে,সম্ভববত ১৯৫৬ সাল।ঢাকা মেহামেডান ও আজাদ স্পোটিং খেলা।দুই দলেই খেলছেন সেরা বাঙ্গালী ফুটবলাররা আজাদের হয়ে মারি,আশরাফ রনজিৎ,ঢাকা মোহামেডানের হয়ে আরজু,গজনবী,কবীর প্রমুখ। গোলাম সারোয়ার টিপু বলছিলেন,কিশোর বয়সে আমার ধারনা ছিলো স্টেডিয়াম মানে গাছ গাছালিতে ঘেরা বাগানের মাঝে মাঠ হবে।কিন্তু মামা যখন ঢাকা স্টেডিয়ামে নিয়ে গেলেন দেখলাম চারপাশে ঘেরাও দেয়া পাকা ভবন। আমি বার বার মামার কাছে জানতে চাইছিলাম মাঠ তো দেখছি না,স্টেডিয়াম কোথায়? মামা বলছিলো অপেক্ষা করতে, গেট দিয়ে গ্যালারিতে ঢুকতেই দেখি বিশাল খেলার মাঠ।ঢাকা মোহামেডানের সঙ্গে আজাদ স্পোটিং এর খেলা।তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর খেলাটি ড্র হয়। তখন জগন্নাথ কলেজ,ততকালীন কায়দে আযম (বর্তমান সারোয়ার্দী) কলেজসহ ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্ররাই আজাদ স্পোর্টিং এর হয়ে খেলতেন।আমিও তাদের মতো ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।পাড়ার ক্লাব তেজগাঁও ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে ১৯৬৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলা শুরু করি। পরের বছরই ৬৪ সালে প্রথম বিভাগে বিজিপ্রেসে ৬৫ সালে ওয়ারীতে,৬৬ সালে রহমতগঞ্জে, ৬৭ তে ভিক্টোরিয়া,৬৮ থেকে,৭০ পর্যন্ত ঢাকা মোহামেডানে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত আবাহনীতে খেলি।আবাহনীতে খেলার প্রেক্ষাপট বর্ননা করে গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন,শেখ কামাল বললেন,টিপু ভাই আমি আবাহনী নামে একটি ফুটবল দল গঠন করছি।আপনিতো ফার্মগেট আমার এলাকায়ই থাকেন তো আবাহনীতে চলে আসেন।তখন শেখ কামালকে জানাই মোহামেডানের প্রেসিডেন্ট মঈনুল ইসলাম অনুমতি না দিলে আমি খেলতে পারবো না।তখন শেখ কামাল বলেন মঈনুল নানা কে আমি ম্যানেজ করবো।বঙ্গবন্ধু মঈনুল ইসলাম কে মামা বলে ডাকতেন।তাই শেখ কামাল নানা বলতেন।এ ভাবেই ৭২ সালে যোগদান করলাম আবাহনীতে বছিলেন গোলাম সারোয়ার টিপু।৭৪ পর্যন্ত আবাহনীতে খেলে আবার ফিরে গেলাম পুরনো দল প্রিয় ক্লাব ঢাকা মোহামেডানে।পরে মোহামেডানের কোচের দায়িত্বও পালন করেছি।গোলাম সারোয়ার টিপুর দেড় দশকের বেশী(১৯৬৩-১৯৭৯) সময়ের ফুটবল জীবনে বর্নাঢ্য সাফল্য, ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া সহ তরুণ প্রজন্মের সংগঠক জাতির জনকের জেষ্ঠ্য পুত্র শেখ কামালের অনুপ্রেরণা ও আবাহনীতে খেলার সময় মাঠে দর্শকদের আক্রান্ত হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি সহ নানা ঘটনা আজও স্মরনীয় হয়ে আছে।

পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প

ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু

 

আরও পড়ুন