ফুটবলে তিনি রহমতগঞ্জের এজাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন
মেন টু মেন মার্কিং এড়িয়ে সুযোগ পেলেই বল পায়ে প্রতি পক্ষের ডিফেন্স ভেঙ্গে তছনছ করে দিতেন মূহুর্তেই। হোক না সেই দল মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্স বা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রক্ষণভাগ। বড় দলগুলোর রক্ষণভাগ চীনের প্রাচীর খ্যাত ছিলো। কিন্তু তার টার্গেট থাকতো প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট। হ্যাঁ, বলছিলাম চার দশক আগে ঢাকার মাঠে রহমতগঞ্জের স্ট্রাইকার এজাজের কথা। বিশাল দেহের অধিকারি গায়ের রং ধবধবে সাদা এবং লাল চুলের এই স্ট্রাইকারকে যে কেউ দেখলেই ভাবতো ইংলিশ বা ইউরোপীয় কোন দেশের ফুটবলার। আসলে প্রায় ছয় ফুট লম্বার খেলোয়াড়টি ছিলেন পুরান ঢাকার রিয়াজ উদ্দীন রোডের ফুটবলার মোঃ এজাজ।
চৌষট্টি বছরের প্রবীণ ফুটবলার এজাজের সঙ্গে দেখা হতেই কুশল বিনিময়ের পরে বললেন, ভাই বয়স হয়েছে মাঠকে বিদায় জানিয়েছি তিন দশক আগে। জীবন যৌবন শেষ। বর্তমান প্রজন্মের খেলোয়াড়েরা আমাদের নাম শোনেনি, খেলা দেখেনি।এখন রাস্তাঘাটে বা হাট-বাজারে গেলেও পুরোনো ফুটবল পাগল সাপোর্টাররা এখনো চিনে সালাম দেয়, দেশের ফুটবলের করুণ অবস্থার নিয়ে নানান প্রশ্ন করে। আর নতুন প্রজন্মের কেউ চিনে না। অথচ আশির দশকে ফুটবলের উত্তাল আর উন্মাদনার সময় দেশের ফুটবল পাগলদের জন্য মার্কেট, হাটবাজারেও যাওয়া যেতো না। ফুটবল পাগলদের ভীড় জমে যেতো কাছ থেকে আমাদের একনজর দেখার জন্য।
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন, হায়রে ফুটবল, আজ জাতীয় দল বা মোহামেডান আবাহনীতে কারা খেলে এদেশের ৯০ ভাগ ফুটবল পাগলরাও চিনে না, জানেন না। মোহামেডান-আবাহনীকে কেন্দ্র করেই এদেশের ফুটবল আকাশসম জনপ্রিয়তায় পৌঁছেছিলো।খেলার দিন পাড়া-মহল্লায় জনপ্রিয় দুই দলের পতাকায় ছেয়ে যেতো। আক্ষেপের সঙ্গেই প্রশ্ন রাখলেন, কোথায় আমার সময়ের ফুটবল উন্মাদনা? কেন হারিয়ে গেলো ফুটবল ঐতিহ্য? এমন প্রশ্নের উত্তর হয়তো অনেক।
পুরান ঢাকার কাজী রিয়াজউদ্দীন রোডের আদী বাসিন্দা এজাজের ফুটবলে যাত্রা শুরু হয়েছিলো সত্তুর দশকের শেষ ভাগে। বাড়ির পাশে কাজী রিয়াজ উদ্দীন রোডের ক্লাব মাঠেই কিশোর বয়সে অন্য দশজন কিশোরের মতোই ফুটবল খেলায় মেতে থাকতেন। ১৯৭৭ সালে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের দল পুরান ঢাকার আলুবাজারের ক্রিসেন্ট ক্লাব থেকে অনুরোধ আসে তাদের দলের হয়ে খেলার। আঠারো বছরের তরুণ ফুটবলার এজাজ ঢাকার লীগ ফুটবল খেলবেন এমন সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি। তাই নাম লেখালেন আলুবাজার ক্রিসেন্ট ক্লাবে। পরের বছরই অফার আসে বাংলাদেশ স্পোর্টিং ক্লাব থেকে। ১৯৭৮-৭৯ দুই মৌসুম খেলেন বাংলাদেশ স্পোর্টিংয়ের হয়ে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে। তখন তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের খেলা হতো বর্তমান হকি স্টেডিয়ামস্থ আউটার স্টেডিয়ামের খোলা মাঠে। সাদা-কালো কাঠের চারকোনা গোলপোস্ট। পায়ে বলে আসলেই টার্গেট থাকতো কখন ওই পোস্ট ভেদ করে বল জালে পাঠাবো? গোল করলে পরদিন পত্রিকায় প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের ম্যাচ রিপোর্টের নীচে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের ফলাফল শিরোনামে ব্রাকেটে নিজের নামটা দেখে খুব আনন্দ লাগতো।
দুই বছর তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলার পরের বছরই ৮০ সালে পোস্তার পাড়ার ক্লাব মুসলিম ইনিস্টিউটে খেলার অনুরোধ পান। এক মওসুম খেলার পরের বছর ৮১তে যোগ দেন ফরাশগঞ্জ এসসিতে। ফরাশগঞ্জ প্রথম বিভাগে উন্নীত হলেও এজাজকে প্রথম ১১জনে স্থান দেয়া হচ্ছিলো না। তাই দুঃখ বাড়তে থাকেন। তখনও ক্লাবের কোচ বা সংগঠকদের গ্রুপিং ও পলিটিক্স সম্পর্কে তার কোন ধারনারই ছিলো না। তাই ৮১সালে অফিস ক্লাব বিআরটিসিতে চলে আসেন। কিন্তু একই অবস্থা। তাই প্রথম বিভাগ থেকে নিয়মিত খেলার আশা ছেড়ে দেন। পাড়ার তৃতীয় বিভাগের আরেক ক্লাব লালবাগ স্পোর্টিং এ চলে আসেন। ওই বছরই লালবাগ তৃতীয় বিভাগ লীগে চ্যাম্পিয়ান হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উঠে আসে। এজাজ লীগে ৮/১০ গোলও করেছিলেন বলে জানালেন। ৮২সালের লীগে দ্বিতীয় বিভাগের প্রথম খেলায়ই লালবাগ স্পোর্টিং ৪-০গোলে জয়ী হয়। এজাজ ১টি, জানে আলম ২টি করে গোল করেন। তবে প্রতিপক্ষ কোন্ দল ও আরেকটি গোল কে করেছিলো মনে করতে পারেননি। একই বছর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের মাঝপথে দিলকুশা স্পোর্টিং এর কর্মকর্তা নুরুল্লাহ ভাই সমঝোতা করে লালবাগ স্পোর্টিং থেকে দিলকুশায় দলভুক্ত করান।লীগের মাঝপথে দিলকুশায় কোন গোল পাননি। প্রথম বিভাগ লীগে ধানমন্ডি ক্লাবের বিরুদ্ধে বদলী খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন। এভাবেই প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে তার ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠে বিচরণ শুরু হয়েছিল।
এজাজ মাত্র ১৮ বছর বয়সে তৃতীয় বিভাগ লীগে খেলে ৪/৫ বছর বিভিন্ন ক্লাবে খেলে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন। ছিলো না তাকে পরিনত ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলতে কোন কোচের ভুমিকা। দলের সঙ্গে প্র্যাকটিসে যা শিখতেন তাই। তবে লালবাগ স্পোর্টিংয়ে থাকাকালীন সময়ে মালা ভাই গাইড করে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। তা অনুসরণ করতেন বলে জানালেন। এজাজ ফুটবলের যৌবন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠেন ১৯৮৩ সালে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটিতে যোগদান করে। ঘুরে যায় ফুটবলে এজাজের ভাগ্য। চব্বিশ বছরের টগবগে যুবক। সেই সঙ্গে দলের ১০ নাম্বার জার্সি। দলের লাইন আপে রক্ষণভাগে অভিজ্ঞ ,মঞ্জু ভাইসহ কোচ গাজি ভাই। সব মিলিয়ে মাঠে একটা আলাদা দাপটও ছিলো রহমতগঞ্জের।
এজাজ দুঃখ করেই বললেন, ফরাশগঞ্জ, দিলকুশা, বিআরটিসি এই ক্লাবগুলোতে আমি গ্রুপিংয়ের শিকার হয়ে নিয়মিত খেলার সুযোগ না পাওয়ায় আমার মনে একটা জেদ ছিলো। তাই আমার স্থানীয় দল রহমতগঞ্জের হয়ে প্রথম খেলায়ই আমি যে গোলটি পাই তা আজও আমার কাছে স্মরণীয়।
৮৩ সালের কথা, ফেডারেশন কাপ ফুটবলে বিজেআইসির বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম ম্যাচ। সেকেন্ড হাফে আমাকে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামানো হয়। আমি মাঠে নামার ১০ মিনিটের মধ্যেই ডি বক্সের উপর উচু থেকে বল পেয়ে বুকে রিসিভ করে মাটিতে নামিয়ে প্রচন্ড শটে গোল করি। আমার সেই গোলে রহমতগঞ্জ জয়ী হয়েছিলো। এজাজ এরপর থেকেই রহমতগঞ্জের নিয়মিত স্ট্রাইকারে পরিনত হন। দাপটের সঙ্গেই খেলেন দুটি মৌসুম। ৮৫তেই এজাজ ডাক পান তৎকালীন শক্তিধর ক্লাব মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে। এক সিজন মুক্তিযোদ্ধায় খেলার পরের বছরই আবার ফিরে আসেন ঘরের ক্লাব রহমতগঞ্জে। ৮৬-৮৭দুই সিজন খেলার পরই আবার দল বদল করে ৮৮সালে প্রথম বিভাগের নতুন দল অগ্রণী ব্যাংকে নাম লেখান। ওই মৌসুমে অগ্রণী ব্যাংক আলোকসহ অভিজ্ঞ ও জাতীয় দলের সাবেক বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে নিয়ে গঠন করা হয়েছিলো।
এজাজ বললেন, ১৯৮৩ থেকে ৮৭ সাল পর্যন্ত আমি দুর্দান্ত ফর্মে ছিলাম। একটা মৌসুমের রহমতগঞ্জের অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেছি। এরই মধ্যে আমি প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে লাল দলে খেলার সুযোগ পাই। তখন কোচ রহিম ভাইয়ের সান্নিধ্য পাই।এ ছাড়া,কোচ গাজি ভাই, মুক্তিযোদ্ধায় গফুর বেলুচ ভাই, আমাকে আক্রমণের রণকৌশলের কতগুলো টেকনিকের তালিম দিয়েছিলেন।
৮৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের হয়ে নেপালের আনফা কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে হংকং এর বিরুদ্ধে আমি ১টি গোল করি। আর ১৯৮৬ সালে মোহামেডানের বিরুদ্ধে আমার সেরা খেলাটি খেলেছিলাম। ওই বছর আমার গোলেই রহমতগঞ্জ মোহামেডানের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে। সেই দিন আমি বার বার মোহামেডানের রক্ষণ ভাগ তছনছ করার এক পর্যায়ে সফলতা পেয়ে গোলটি করেছিলাম। মোহামেডান ছিলো ওই বছরের লীগ চ্যাম্পিয়ান দল। এজাজ জানালেন, ১৯৮৯ সাল থেকে ৯১ সালে আবার পুরনো দল রহমতগঞ্জেই ফিরে আসি। তিন বছর খেলার পর পোস্তায় চামড়ার ব্যবসায় মনোযোগ দেই। প্রায় দুই দশক ঢাকার বিভিন্ন লীগের ফুটবল খেলার সময় বড় দল ব্রাদার্স, মোহামেডান থেকেও খেলার অফার আসলেও যাইনি। কারণ বড় দলে চাপ ও গ্রুপিং বেশী। তাই পাড়ার ক্লাবের হয়ে খেলার একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। তার খেলোয়াড়ী জীবনে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা এক মৌসুমের জন্য পেয়েছিলেন বলে জানালেন। ১৯৯১ সালের পরে আবার চামড়ার ব্যবসার কারনে পোস্তার মুসলিম ইনিস্টিউটে খেলার জন্য সবাই অনুরোধ করে। তখন মুসলিমে খেলি। আমরা ফাইনালে উঠলেও চলন্তিকার কাছে ১গোলে হেরে আর প্রথম বিভাগে উঠতে পারিনি। আর আমিও আর খেলা চালিয়ে যাইনি।এজাজ ১৯৯০ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী ফারহানা আফরোজ।এক মেয়ে প্রিয়াংকা জান্নাত জোহরা, দুই ছেলে নাসিমুল হাসান প্রান্ত ও হাসিবুল হাসান দিগন্ত। চামড়া ব্যবসা মন্দা। ৬৪ বছরের প্রবীণ ফুটবলার এজাজ আর ফুটবল মাঠমুখী হননা।পরিবারের সদস্য, নাতি ও পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে দেন।
কবর খোদক ফুটবলার রজব’র অজানা গল্প
ফুটবলারদের শাস্তিঃ তদন্ত কর্মকর্তা আলোচিত ওসি কুদ্দুস যা বললেন
সামরিক আদালতে ফুটবলার আনোয়ারের বিচারের অজানা কথা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া ফুটবলার বাবুল গুমের মর্মস্পর্শী কাহিনী
মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সাংবাদিক খন্দকার তারেকঃ ক্রীড়াঙ্গনের জীবন্ত দলিল
ক্রীড়াঙ্গনে আজিমপুর কলোনীঃ জুডো কন্যা সুমির সাফল্যের গল্প
৫১ বছর পর পরিচয় উদঘাটন: বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার প্রতিরোধে পুলিশ নয়, প্রথম শহীদ ফুটবলার খোকন
ষাটের দশকে ফুটবলে খ্যাপের ওস্তাদ ফায়ারসার্ভিসের বিমল দাদা এখন ইতিহাসের সাক্ষী
শোকাবহ আগস্ট : আবাহনীর খেলোয়াড়দের রাতের অন্ধকারে অনুশীলন করতে হতো
পঞ্চাশ দশকঃ কায়দে আজম ট্রফিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটার মিন্টুর গল্প
ফুটবলার ইকবালের স্বপ্ন ভেঙেছে একটি রাফ টেকলিং
গ্যালারি মাতানো পাগলা মুজিবর আবাহনী সমর্থক হওয়ার পেছনের গল্প – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের ফুটবলে ভুলে যাওয়া নাম সত্তুর দশকের শার্প শ্যুটার সুলতান – CTG SANGBAD24
ঢাকার ফুটবল উন্মাদনাঃ কসাইদের মোহামেডান আর রহমতগঞ্জের ডাইলপট্টির কথা – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি – CTG SANGBAD24
পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প – CTG SANGBAD24
ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু – CTG SANGBAD24