সামরিক আদালতে ফুটবলার আনোয়ারের বিচারের অজানা কথা
সেনাশাসক এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিলো ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। নয় বছর এরশাদ সরকারের শাসনামলের সবচেয়ে কলঙ্কময় দিক ছিলো খেলার মাঠের গোলযোগকে কেন্দ্র করে দেশ সেরা ফুটবল তারকাদের সামরিক আদালতে বিচার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়া। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ সামরিক শাসন জারির ছয় মাস পর ২১ সেপ্টেম্বর ছিলো ফুটবলের সেই কলংকময় দিন।সেই রাতে কি ঘটেছিলো খেলোয়াড়দের ভাগ্যে? ফুটবলের সেই কলঙ্কময় দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন কারাভোগ করা ফুটবলার কাজী আনোয়ার হোসেন।
“এরা সব আওয়ামীলীগ করে, শেখ কামালের টিম এই আবাহনী, আবাহনী মানেই আওয়ামীলীগ। এরা দেশে সামরিক আইন মেনে নিতে পারে নাই। তাই পরিকল্পিত ভাবেই এরা মাঠে, স্টেডিয়ামে ও স্টেডিয়ামের চারপাশে, গুলিস্তান, পল্টন,বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল এলাকায় তাদের সমর্থকদের দিয়ে বাস পুড়িয়েছে, দোকানপাট ভাংচুর, লুটপাট করিয়েছে, আগুন দিয়ে জনমনে আতংক তৈরী করে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে জনগনকে উস্কে দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করেছে। আমি একজন আবাহনীর ফুটবল খেলার সাপোর্টার, আমি নিয়মিত আবাহনীর খেলা দেখি এদের প্রত্যককে আমি চিনি। এরা সবাই আওয়ামীলীগ করে। এই দেখুন আজ প্রকাশিত দেশের দৈনিক পত্রিকা গুলোতে এদের মারামারির ছবি ছাপা হয়েছে, দেখুন এদের সাপোর্টাররা বাস আগুন দিয়ে পোড়াচ্ছে। প্রায় ৪১বছর আগে দেশের জাতীয় ফুটবলার ও আবাহনী ক্রীড়া চক্রের খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে তৎকালীন মতিঝিল ওসি আব্দুল কুদ্দুস সামরিক আদালতে খেলোয়াড়দের গ্রেফতারের কারণ এভাবেই উপস্থাপন করে স্বাক্ষ্য দিচ্ছিলেন”। অভিযুক্ত আবাহনী ক্রীড়া চক্রের তৎকালীন ফুটবল দলের অধিনায়ক কাজী আনোয়ার হোসেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এভাবেই বর্ননা করছিলেন একচল্লিশ বছর আগের সেই দূর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা।
১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ক্লাব টেন্টে ঘুম থেকে তুলে খেলোয়াড়দের ১৯৭১ এর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কায়দায় রাতের অন্ধকারে জাতীয় দলের এবং ক্লাবে থাকা শ্রীলংকান ফুটবলারদের গ্রেফতার করে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিলো।
সেই দিনের স্মৃতিচারণে কাজী আনোয়ার হোসেন বললেন, সেই দিন মোহামেডানের বিরুদ্ধে খেলে আমরা মাঠের মারামারি জন্য ঢাকা স্টেডিয়ামের ড্রেসিং রুমেই অনেক রাত পর্যন্ত আটকে ছিলাম। আমরা খবর পাচ্ছিলাম হাজার হাজার ফুটবল পাগল সমর্থকরা স্টেডিয়াম ও তার চারপাশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। ক্লাবে ফিরে আসার পরিবেশ না থাকায় অনেক রাতে আমাদের বহন করা বাস পুলিশ স্কট করে ক্লাবে পৌঁছে দেয়। আমরা খেলোয়াড়েরা সবাই পরিশ্রান্ত-ক্লান্ত। রাতের খাবার শেষে আমি আমার রুমে ঘুমাতে যাই। আমি জানালার পাশে ডান দিকে কাত হয়ে হাত জানালার দিকে বাড়িয়ে রেখে ঘুমাই। এটাই আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। প্রতিদিনের মতো ওই রাতেও এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ জানালা দিয়ে আমার হাত ধরে কেউ টানছে অনুভব করলাম। ক্লান্ত শরীরের ঘুমে কাতর ছিলাম। কোন ক্রমে চোখ মেলে দেখি আমাদের ক্লাবের বেয়ারা আলী জানালা দিয়ে আমার হাত ধরে টানছে, আমার নজরে এলো তার পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে, মাথার ক্যাপের লোগোটি বাহিরের আলোতে চক চক করছে, আমার বুঝতে বাকী নেই লোকটি পুলিশ। এবার তিনি জানালার নিকটে এসে নিজেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে রুমের বাতি জ্বালাতে বললেন। আমি বাতি জ্বালাতেই দেখি দরজায় পুলিশ নক করছে। এর পরে দরজা খুলে দিই। আমি হাপ-প্যান্ট পরা।তাদের হাতে একটি তালিকা। আমরা লীগ কমিটির কাছে যে তালিকাটি দিই তারই কপি মনে হলো। একজন পুলিশ খেলোয়াড়দের বাহিরে তামিম ও অখেলোয়াড় মঞ্জু এখানে আছে কিনা জানতে চাইলেন। তামিম আমাদের ক্রিকেটার আর মঞ্জু আমাদের ক্লাব কর্মকর্তা হারুন ভাই এর ছোট ভাই মুকুলের বন্ধু। মঞ্জুর বিরুদ্ধে অভিযোগ সে নাকি বরফ ভাঙ্গার কাঠের হাতুড়ি দিয়ে চতুর্থ রেফারী আব্দুল আজিজকে আঘাত করেছে। এরপর আমাদের ক্লাব টেন্টে থাকা শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড় পাকির আলী ও অশোকাসহ খেলোয়াড়দের তালিকা দেখে দেখে যাদের উপস্থিত পেয়েছে সবাইকে পুলিশের একটি বড় লরিতে তুলে নেয়। এরপর এনএসসি’তে দিল্লি গামি এশিয়ান গেমসের ক্যাম্পে থাকা খেলোয়াড়দেরও আটক করে। আমরা খেলোয়াড়, লাখ লাখ মানুষের বিনোদন আর আনন্দে মাতিয়ে রাখাই আমাদের কাজ। কখনো থানা পুলিশ কিংবা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি বা প্রস্তুতও ছিলাম না। গভীর রাতে যখন আমরা তৎকালীন জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (বর্তমান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের) হোস্টেলে পৌঁছাই তখন জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকা চুন্নু ভাই, মোতালেব, খুরশিদ বাবুল, আশিষ, জনি, মনিসহ আমাদের ক্লাবের সবাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নীচে পুলিশের গাড়িতে নিয়ে আসে।এ রপর আমাদের রমনা থানায় নেয়া হয়। রমনা থানার ওসি”র রুমে ঢুকতেই দেখি সালাউদ্দিন ভাই ওসি”র চেয়ারে বসে টেবিলের উপর পা তুলে বসে আছে। আমাদের ফুটবলারদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তা কখনো ভাবতেই পারিনি। আমাদের রমনার থানার ওসি”র রুমে একত্রে রাখা হয়। তখন মোবাইলের যুগ না থাকলেও আস্তে আস্তে কর্মকর্তা ও সমর্থকদের কানে পৌছে যায় আমাদের গ্রেফতারের খবর। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার দূতাবাসের কর্মকর্তারা এসে তাদের দেশের খেলোয়াড় পাকির আলী ও অশোকাকে তাদের জিম্মায় থানা থেকেই নিয়ে যায়। সকাল তখন আটটা/নয়টা হবে। আমাদের নাস্তার জন্য ওয়ারী ক্লাবের ফুটবলার জাহিদ (৭৫সালে জাতীয় যুব দলে খেলেছেন) ভাই আমাদের সকল খেলোয়াড়দের জন্য বিরিয়ানি পাঠিয়েছেন। এরপর আমাদের শাহবাগস্থ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন সাজ্জাদুল আলম ববি”র বাবা বঙ্গবন্ধু”র ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহিউদ্দিন আহমেদ সাহেব। তিনি আমাদের জানান, আমি তোমাদের জন্য “ল”ইয়ার ঠিক করতে যাচ্ছি। তোমরা চিন্তা করো না।এরমধ্যে তিনি পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন, তিনি বলেন, এরা জাতীয় দলের ফুটবলার, এরা তো দেশের জন্য খেলে, ওরা কি সন্ত্রাসী? ওদের কেন ধরে আনলেন?। ইতিমধ্যে পুলিশের আরেকটি লরিতে ওইদিন খেলা পরিচালনাকারী চার রেফারী ও লাইন্সম্যানকে আমরা দেখতে পাই। তখনও বুঝতে পারিনি বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে কলঙ্কময় দিনটি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে জাতীয় দলের ফুটবল ক্যাম্প থেকেই আমাদের দুপুরের খাবার আসে। খাবার শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় শেরাটনের পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকা রাস্তাটির পাশে (সম্ভবঃত মিন্টু রোড)”র একটি বাড়িতে, যেখানে সামরিক আদালত স্থাপন করা হয়েছে। এ সময় দুই জন মেজর আমাদের সঙ্গে খুবই ভাল ব্যবহার করেন। আদালতে বিচারকের আসনে কর্ণেল আনোয়ারুল আজীম। আদালতে একটি কাঠগড়া আছে, যেখানে চারজনের বেশী দাড়ানো যায় না। কিন্তু কর্নেল আনোয়ারুল আজিম বলেন, ফুটবলাররা ইলাস্টিকের মতো, সবাইকে এ কাঠগড়ার ভেতরে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেন। এরপর আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। তৎকালীন মতিঝিল থানার ওসি আব্দুল কুদ্দুস আমাদের বিরুদ্ধে এক তরফা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি দলের অধিনায়ক হিসেবে আমাকে সকল গন্ডগোলের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দেন। তিনি নিজেকে আবাহনীর সমর্থক ও নিয়মিত খেলা দেখন বলেও দাবি করেন।
কাজী আনোয়ার বললেন, আদালতে কুদ্দুস সাহেবের বক্তব্যের পর সামরিক আদালতের বিচারকের আসনে বসা কর্ণেল আনোয়ারুল আজিম আমাদের কোন বক্তব্য আছে কিনা জানতে চান। তখন দলের অধিনায়ক হিসেবে আমিই বক্তব্য রাখা ও ওসি কুদ্দুস সাহেবকে একটিই প্রশ্ন রাখার অনুমতি চাই। তখন আমাকে অনুমতি দেয়া হলে, আমি আমার বক্তব্যে বলি, যারা নিয়মিত ফুটবল খেলা দেখেন এবং আবাহনীর সমর্থক, তারা তার প্রিয়দলের সকল খেলোয়াড়দের নাম ও জার্সি নাম্বারও জানে এবং বলে দিতে পারে। আর কুদ্দুস সাহেব নিজেকে আবাহনীর সমর্থক ও নিয়মিত খেলা দেখেন বলে তার বক্তব্য বলেছেন, তাই আমি তার কাছে জানতে চাই, আমি আবাহনীর অধিনায়ক নিশ্চয়ই তিনি আমার জার্সি নাম্বারও বলতে পারবেন? তখন বিচারক তাকে বলার অনুমতি দিলে তিনি চুপ করেছিলেন। তখন আমি আদালতকে বলি, তিনি কারো শেখানো বক্তব্য মুখস্থ করে আমাদের বিরুদ্ধে এমন অসত্য তথ্য উপস্থাপন করেছেন। এরপর সরকারের পক্ষে একজন আইনজীবী রাষ্ট্রদ্রোহের বিভিন্ন ধারা উপস্থাপন করে আমাদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তি দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্য শেষ হলে আমাদের পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট খন্দকার মাহাবুব হোসেন বক্তব্য দিতে আদালতের অনুমতি চান। এসময় কর্ণেল আনোয়ারুল আজিম তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি আমাদের পক্ষের আইনজীবী হিসেবে সরকারের পক্ষের আইনজীবী উপস্থাপন করা বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, এরা ফুটবলার। এরা দেশের সম্মান বয়ে আনার জন্য খেলে। এরা জাতির গর্ব। এরা কখনো রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করতে পারে না এবং করেওনি। তাদের বিরুদ্ধে যেসমস্ত ধারা উপস্থাপন করা হয়েছে, তার জন্য এক হাজার টাকা করে জরিমানার আইন আছে। এর বেশী কিছু নয়। এরপর আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে রেফারী মনির হোসেন, সহকারী আব্দুর রশিদ, জেড আলম ও চতুর্থ রেফারী আব্দুল আজিজ আলাদা আলাদাভাবে আমাদের একেক জনের নাম উল্লেখ করে কে কি ভাবে তাদের আক্রমণ করেছি তার বর্ণনা দেন।
এ সময় আনোয়ার বললেন, তাদের ও আমাদের আইনজীবীর বক্তব্য আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। কারণ আমরা ফুটবলাররা কখনো আদালতের মুখোমুখি হইনি। দুই পক্ষের বক্তব্য শেষে বিচারক আধা ঘন্টা সময় নিয়ে তার আসন ছেড়ে যান।অভিযুক্ত কাজী আনোয়ার বলছিলেন, এসময় আমাদের আইনজীবী এডভোকেট খন্দকার মাহাবুব হোসেন, ববি ভাইয়ের বাবাসহ আদালতের আশপাশে থাকা ক্লাব কর্মকর্তাদের বলছিলেন, হাজার পাঁচেক টাকা রেডি রাখেন। জরিমানা করলে যাতে আদালতে জমা দেয়া যায়। যা পরে শুনেছি।
আনোয়ার বলছিলেন, বিচারকের দায়িত্বে থাকা কর্ণেল আনোয়ারুল আজিম আমাদের সঙ্গে কথোপকথনে ভাল আচরণ করছিলেন। কিন্তু বিরতির পর যখন তিনি আবার আদালতের আসনে বসেন, তখন তার মুখমন্ডল ছিলো গম্ভীর। হেঁটে আসনে বসার সময় আমাদের দিকে তাকানওনি। এরপর তিনি তার রায় পড়ে শোনান। দলের অধিনায়ক হিসেবে আমার দায়িত্ববোধ বেশী হওয়া সত্বেও আমি তা পালন না করে নিজেও মারামারিতে অংশ নিয়েছি এবং অন্যদের বিরত রাখার চেষ্টা করিনি বলে আমাকে এক বছরের, হেলালকে ছয় মাসের চুন্নুকে দুই মাসের ও সালাউদ্দিনকে এক মাসের কারাদণ্ড দেন। বাকীদের খালাস দেন। এরপর সাজাপ্রাপ্ত আসামী হওয়ায় আমাদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডস্থ কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। এরই মধ্যে আমাদের আবাহনীর ক্রিকেটার বেলাল ভাইয়ের আপন ভাই ডেপুটি জেলার হেলাল ভাইয়ের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া হয় আমাদের জেলে আসার বিষয়টি। তিনি জানতে পেরে জেলারসহ সবাই উপস্থিত থেকে আমাদের গেটে আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভেতর নিয়ে একটি রুমে রাখা হয়। এরই মধ্যে জেলখানায় খবর ছড়িয়ে পড়ে ফুটবলারদের আগমনের খবর। আমারা জাতীয় দলের খেলোয়াড় হওয়ায় আমাদের আইনজীবী কারাগারে আমাদের ডিভিশন দেয়ার আবেদন করেছিলেন আদালতের কাছে।তাই আমাদের প্রথম শ্রেনীর বন্দী হিসেবে রাখা হয়। কিন্তু আমরা এর সুবিধা অসুবিধা কিছুই জানতাম না। তাই একজন বন্দী আমাদের বলছিলেন, আপনারা পত্রিকা পাবেন, রেডিওতে খবর শুনতে পারবেন, রুমে আয়না টেবিল চেয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আমরা জেলের কারারক্ষীদের কাছে এগুলো চাইলে ওরা বলতো আপনারা এই সুবিধা পাবেন, কে বললো, কিভাবে জানলেন?
জেলের ভেতরের প্রথম অভিজ্ঞতায় আনোয়ার বললেন, তখন জেলে থাকা তান্না ভাই আমাদের কাছে একটি চিরকুট পাঠান তার সেলে চলে আসার জন্য। আমাদের পাশের সেলে থাকা ব্যাংকার নেতা জামাল উদ্দীন জানতে চাইলেন এরা কারা। আমরা ফুটবলার জেনে তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। এভাবেই ২৪ ঘন্টা না যেতেই পরদিন সকাল বেলাই কারাগারে খবর আসলো আমাদের বদলি করা হয়েছে। সকালে আমাদের জেল গেটে নিয়ে আসা হলে, সেখানে পায়চরি করা সাত্তার সরকারের মন্ত্রী কেএম ওবায়দুর রহমান জানতে চাইলেন, এরা কারা? তখন কারা কর্মকর্তারা জানালেন, এরা ফুটবলার। তখন কেএম ওবায়েদুর বলছিলেন, এরশাদ ফুটবলারদেরও ছাড়লো না? এ-ই বলে তিনি হেঁটে চলে যান। পরদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশের পর আমাদের হাজার হাজার ফুটবল ভক্তরা দলমত নির্বিশেষে আমাদের মুক্তির জন্য সারা দেশেই বিক্ষোভ, মিছিল শুরু করেছিলো। তাই ঢাকায় বড় ধরনের শোডাউনের আশঙ্কায় সরকার আমাদের ঢাকা থেকে বদলি করে দেয়। কিন্তু আমরা জানতাম না, কাকে কোন কারাগারে পাঠানোর অর্ডার হয়েছে। ২৩সেপ্টেম্বর সকালে আমাদের একজনের সঙ্গে একেকটি রিকসায় একজন কারারক্ষী দিয়ে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। ভোরে মতিঝিল দিয়ে যখন আমাদের রিকশা যাচ্ছিলো, তখন ফুটবল পাগল অনেক দর্শকই আমাদের চিনতে পেরেছিলেন। তাই তারা কমলাপুর স্টেশনে ভীড় করতে শুরু করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের স্টেশন ম্যানেজারের রুমে নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। এরপর জানা গেলো, আমাদের রাজশাহীর ট্রেন রাত ১১টায়। তখন আমাদের আবার রমনা থানায় নিয়ে আসা হয়। রাত পর্যন্ত রমনা থানায়ই থাকি। রাতে আমরা জানতে পারি, আমি আর হেলাল রাজশাহী কারাগারে আর সালাউদ্দিন ও চুন্নু ভাইকে যশোর কারাগারে দেয়া হয়েছে। তবে কমলাপুর থেকে ঈশ্বরদী স্টেশন পর্যন্ত একসঙ্গে একই ট্রেন। সেখান থেকে যার যার গন্তব্যে যাওয়া। কিন্তু ট্রেনে সমস্যা দেখা দেয় কারারক্ষীদের টিকেট নিয়ে। কারণ কারারক্ষীদের টিকেট তৃতীয় শ্রেনীর আর আমাদের দেয়া হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেনীর টিকেট। তাই আমরাই কারারক্ষীদের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেনীতে তাদের সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এতে কারারক্ষীরা খুবই খুশি হয়। তারা আমাদের সঙ্গে খুবই ভাল ব্যবহার ও দুঃখ প্রকাশ করছিলো। ট্রেন ছাড়ার সময় তারা ঝামেলা এড়াতে বগির জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়।যাতে সমর্থকরা আমাদের দেখতে পেয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে।
আনোয়ার বললেন, আমরা ভেতর থেকেই বুঝতে পারছিলাম কখন কোন স্টেশন অতিক্রম করছি। ময়মনসিংহ স্টেশনে পৌছা মাত্রই শত শত সমর্থক ট্রেনের জানালায় শুধু থাপ্পড় মারছিলো আর চিৎকার করে বলছিলো, আমাদের ফুটবলাররা কোথায়, কোন বগিতে? আমরা ভেতর থেকে তা শুনছিলাম। ঈশ্বরদী থেকে বাহাদুরাবাদ ফেরী পার হয়ে আমরা বিভক্ত হয়ে যাই। রাজশাহীতে আমাদের আবাহনীর সাবেক ফুটবলার সামসু (ক্রিকেটার পাইলটদের বাবা) ভাই ক্রীড়া সংগঠক জাফর ইমাম, নিজে উপস্থিত থেকে খোঁজখবর রাখতেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক ফজলে হোসেন বাদশা ভাই তার নামে হুলিয়া থাকায় জেল গেটের দূরে দাড়িয়ে হাতের ইশারায় কথা বলতেন ও লোক পাঠিয়ে আমাদের খোঁজখবর নিতেন। রাজশাহী কারাগারে আমরা ছিলাম ডিভিশন পাওয়া কারাবন্দী। তাই আমাদের কাছে এক তরুণ এসে বলে, আমাকে এখানে সবাই ফালতু নামে ডাকে। আমি আপনাদের প্রথম শ্রেনীর খাবার, নাস্তা সব এনে দিবো। তখন ফালতু নতুন কারো জন্য খাবার নেয় দেখে সাত্তার সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দীন তার কাছে জানতে চায়, নতুন কে এলো, কাদের জন্য খাবার নাও?। তখন তাকে জানানো হলো ফুটবলারদের জন্য। এ সংবাদ পেয়ে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি ডিভিশন পাওয়া তার বিশাল একটি রুমে তার সঙ্গে আমাদের থাকতে নিয়ে যান। ১৮ দিনের কারাবাসের বিচিত্র অভিজ্ঞতাটা রাজশাহী জেলেই হয়।
তিনি বললেন, ইমদুকে ফাঁসি দেয়া জল্লাদ আমাদের সামনের সেলেই থাকতেন। কি বিচিত্র অভিজ্ঞতা? দূর্নীতির দায়ে সামরিক আদালতে সাজা পাওয়া জামালউদ্দীন নামাজে ইমামতি করতেন। খুনের আসামী ইক্কামত দিতেন আর খেলার মাঠের মারামারির জন্য প্রতিহিংসায় সাজাপ্রাপ্ত আমরা তার পেছনে মুসুল্লি হিসেবে নামাজ আদায় করতাম। রাজশাহী জেলে কারাবাসের বর্ননা এভাবেই করছিলেন ১৯৮২ সালে ফুটবলের কালো অধ্যয় সৃষ্টিকারী স্বৈরশাসক এরশাদ সাহেবের সামরিক আদালতে দন্ড পাওয়া আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও জাতীয় দলের ফুটবলার কাজী আনোয়ার হোসেন।
১৮ দিন কারাবাসে মুক্তির প্রেক্ষাপট বর্ননায় কাজী আনোয়ার বললেন,পৃথিবীর ইতিহাসে খেলার মাঠের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে সামরিক আদালতে হাজির করে খেলোয়াড়দের দন্ড দেয়ার নজির হয়তো আর দ্বিতীয় নেই। মুক্তি প্রসঙ্গে আনোয়ার বললেন, শুধু আবাহনীর সাপোর্টার নয়, মোহামেডানসহ সর্বস্তরের ফুটবল পাগল সমর্থকেরা এক হয়ে আন্দোলন করছিলো। যার যেখানে সুযোগ আছে, আমাদের জন্য তদ্বির করছিলো। সবাই সেনাশাসক এরশাদের কাছে খেলোয়াড়দের মুক্তিদেয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। মোহামেডানের ফুটবলার গাফফার, বাদল রায়, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় কামরুন নাহার ডানা সবাই আমাদের মুক্তির বিষয়ে সোচ্চার ছিলো। এমনকি যতদুর শুনেছি, জিয়াউর রহমানের ছোট ভাই আহমেদ কামাল তৎকালে তার ভাবী বেগম খালেদা জিয়াকে দিয়ে এরশাদ সাহেবকে ফোন দিতে বাধ্য করেছিলেন আমাদের মুক্তি দেয়ার জন্য। কারণ আহমেদ কামাল ছিলেন আবাহনীর কট্টর সমর্থক। বেগম জিয়ার দুই ছেলে তারেক ও কোকো আবাহনীর সমর্থক ছিলো। তারা আবাহনীর খেলার দিন চাচা আহামেদ কামালের সঙ্গে আবাহনী ক্লাবে এসে সাপোর্টার টিকেট নিয়ে খেলা দেখতেন। তাই খালেদা জিয়াকে দিয়েও আমাদের মুক্তির জন্য সেনাশাসকের কাছে অনুরোধ করানো হয়েছিলো। আর খালেদা জিয়া তখন রাজনীতিতে আসেননি। এ ছাড়াও এরশাদ দিল্লি সার্ক সম্মেলনে যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে একজন মেজর জেনারেল এরশাদকে অনুরোধ করেছিলেন, খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের মুক্তি দিতে। বেগম জিয়ার কাছে নাকি এরশাদ জানতে চেয়েছিলেন, ভাবী আপনি কি আবাহনীর সাপোর্টার? জেনারেল ও বেগম জিয়াকে এরশাদ একই কথা বলেছিলেন, ওরা একটু দুষ্টুমি করেছে, তাই কয়দিন যাক, এরপর দেখবো। এরপর এরশাদ ওমরা হজ্জে যাওয়ার আগে এয়ারপোর্টে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মোহাব্বত জান চৌধুরীকে নির্দেশ দেন খেলোয়াড়দের মুক্তি দিতে। ১৮ দিন কারাবাসের পর ফুটবলাররা মুক্তিলাভ করে।
খেলার মাঠের গোলযোগকে কেন্দ্র করে খেলোয়াড়দের সামরিক আদালতে শাস্তি দেয়ার কারণ প্রসঙ্গে আনোয়ারের মূল্যায়ন, আবাহনী শেখ কামালের প্রতিষ্ঠিত একটি ক্লাব, যেটি শত বাধা পেরিয়ে লাখ লাখ ক্রীড়া প্রেমীর ভালবাসা ও জনপ্রিয়তায় ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ বিভিন্ন খেলায় সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়া, ১৯৭৮ সালের দিল্লি এশিয়াডে আবাহনীর খেলোয়াড় নান্নুকে অধিনায়ক থেকে আকর্ষিক সরিয়ে সান্টুকে অধিনায়ক করার প্রতিবাদের আবাহনীর সাত জন খেলোয়াড়ের জাতীয় দল বয়কট করে। তবে রংপুরের এরশাদ মোহামেডান সমর্থক ও সান্টুর বাড়ি রংপুর হওয়া এবং মেজর হাফিজ মোহামেডানের সাবেক খেলোয়াড় হওয়ার কারনেই হঠাৎ অধিনায়ক বদলের কারন ছিলো কিনা আজও তা অজানাই থেকে গেছে বলছিলেন আনোয়ার। এ ছাড়া এরশাদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট ১৯৭৮ সালে। তিনি ফোনে আবাহনীর খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছিলেন জাতীয় দলে যোগদানে। তার অনুরোধ না রাখায় হয়তো এর প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিলো। এ ছাড়া একজন প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে মেজর হাফিজ উদ্দীন ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। তিনিও খেলোয়াড়দের পক্ষে কোন ভূমিকা রাখেননি। হাফিজ সাহেব হয়তো ধারণা পোষন করতেন, শেখ কামাল হয়তো তাকে ১৯৭৩ ও ৭৫ সালে জাতীয় দলে খেলা থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। এমন ভুল বুঝাবুঝির কারনেই হয়তো আমারা শেখ কামালের আবাহনীর খেলোয়াড় হওয়ায় আমাদের মুক্ত করার বিষয়ে তিনি ভুমিকা নেননি।
তবে সেই দিনের মাঠের ঘটনায় আনোয়ার নিজের অপরাধ স্বীকার করে বললেন, আমার নেয়া শর্টটিকে স্পষ্ট মোহামেডানের তৎকালীন গোলরক্ষক মহসিন গোললাইন অতিক্রম করার পরে ভেতর থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এর প্রতিবাদ ও গোলের দাবি করে রেফারী মনির হোসেনকে ২শ পাউন্ড ওজনের শক্তিতে ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার ন্যায্য গোলটি না দেয়ায় আমার ক্ষোভ মিটিয়েছিলাম। তখন আমি দলের অধিনায়ক থাকায় আমার মাথা পুরাই গরম ছিলো। খেলা শেষ হওয়ার তখন মিনিট দশেক বাকি ছিলো। আমরা ০-১ গোলে পিছিয়ে ছিলাম। যদিও মোহামেডানের শিরোপা নিশ্চিত হয়েছিলো আগেই। এই ম্যাচের ফলাফলে কোন ফ্যাক্টর ছিলো না। আনোয়ার বললেন,পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো ফুটবল মাঠের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খেলোয়াড়দের সামরিক আদালতে বিচার করে জেলে পাঠানোর ঘটনা সম্ভবত এটাই প্রথম ছিলো। চার দশকেও সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারিনি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া ফুটবলার বাবুল গুমের মর্মস্পর্শী কাহিনী
মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সাংবাদিক খন্দকার তারেকঃ ক্রীড়াঙ্গনের জীবন্ত দলিল
ক্রীড়াঙ্গনে আজিমপুর কলোনীঃ জুডো কন্যা সুমির সাফল্যের গল্প
৫১ বছর পর পরিচয় উদঘাটন: বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার প্রতিরোধে পুলিশ নয়, প্রথম শহীদ ফুটবলার খোকন
ষাটের দশকে ফুটবলে খ্যাপের ওস্তাদ ফায়ারসার্ভিসের বিমল দাদা এখন ইতিহাসের সাক্ষী
শোকাবহ আগস্ট : আবাহনীর খেলোয়াড়দের রাতের অন্ধকারে অনুশীলন করতে হতো
পঞ্চাশ দশকঃ কায়দে আজম ট্রফিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটার মিন্টুর গল্প
ফুটবলার ইকবালের স্বপ্ন ভেঙেছে একটি রাফ টেকলিং
গ্যালারি মাতানো পাগলা মুজিবর আবাহনী সমর্থক হওয়ার পেছনের গল্প – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের ফুটবলে ভুলে যাওয়া নাম সত্তুর দশকের শার্প শ্যুটার সুলতান – CTG SANGBAD24
ঢাকার ফুটবল উন্মাদনাঃ কসাইদের মোহামেডান আর রহমতগঞ্জের ডাইলপট্টির কথা – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি – CTG SANGBAD24
পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প – CTG SANGBAD24
ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু – CTG SANGBAD24