ষাটের দশকে ফুটবলে খ্যাপের ওস্তাদ ফায়ারসার্ভিসের বিমল দাদা এখন ইতিহাসের সাক্ষী
ষাট দশকে সারা দেশের ফুটবলে খ্যাপের ওস্তাদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন ঢাকার অফিস ক্লাব ফায়ারসার্ভিসের ডিফেন্ডার বিমল চন্দ্র পাল। প্রায় পৌনে সাত ফুট লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী বিমল ছিলেন মাকরানি ফরোয়ার্ডদের বল জমা দেয়ার ঠিকানা। তৎকালে ঢাকার জনপ্রিয় ক্লাব ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারী ক্লাব,আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, ইষ্ট পাকিস্তান গর্ভমেন্ট প্রিন্টিং প্রেস বা বিআইডিসি বা ভিক্টোরিয়া যে দলেরই আক্রমণ ভাগের খেলোয়াড় হোন না কেন ফায়ারসার্ভিসের ডিফেন্ডার বিমলকে জমা খরচ দিয়েই রক্ষণ সীমায় প্রবেশ করতে হতো। দুর্দান্ত রাফ এন্ড টাফ ট্যাকলিং,পা থেকে বল ছিনিয়ে নিজ দলের সহযোগী খেলোয়াড়দের কাছে পৌছে দেয়ায় তার কোন তুলনা ছিলো না। বিমল ছিলেন প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের কাছে এক আতংকের নাম। এমন দক্ষ ও জাদরেল খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও বড় দলগুলোর অফার ফিরিয়ে দিতেন অফিস দল ফায়ারসার্ভিসে খেলার জন্যই। কারণ চাকরি আর ফুটবল দুটোই ছিলো তার জীবন জীবিকার চালিকা শক্তি এমনটাই তিনি মনে করতেন।
পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের ভাড়া বাসায় কথা হয় প্রবীণ ফুটবলার বিমল চন্দ্র পালের সঙ্গে। প্রায় আশি বছর নিকটবর্তী বিমল দাদা শারীরিকভাবে নানা সমস্যা নিয়ে ছোট্ট একটি ঘরে বসবাস করেন। বয়সের ভারে হাটু,কোমড়ের ব্যাথায় হাঁটাচলা করতে পারেন না। কানেও কম শুনতে পান। চোখেও পরিষ্কার দেখতে পান না। সব স্মৃতি মনে করতে পারেন না। তবে ঢাকার ফুটবলে ষাট দশকে তার খেলোয়াড়ী জীবনের কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন প্রাক্তন ফুটবলার ও সংগঠক আজফার-উজ-জ্জামান সোহরাব। সেই স্মৃতি মনে হলেই একনাগাড়ে বলতে থাকেন ফুটবলের গৌরবময় দিনগুলোর কথা। থেমে থেমে চিন্তা করতে করতে ফিরে যান ফুটবলের উত্তাল সময়ে। মুখে হাসি আর আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন বর্ণনার সময়। বলতে শুরু করেন ঢাকার ফুটবল লীগে খেলার নানান কথা।
ঢাকার মাতুয়াইলের কোনা পাড়ার বেলগড়িয়া গ্রামে পূর্বপুরুষদের বসবাস হলে তার শৈশব কেটেছে তাঁতিবাজারেই। এখনও তিনি তাঁতিবাজারেই ভাড়া বাসায় থাকেন। যৌবন কালের ফুটবলের সাথীদের কেউ আর খোঁজখবর রাখেন না। তার সঙ্গীসাথী বা ফুটবল সংগঠকদের অনেকেই এখন জীবিতও নেই। কে কোথায় আছেন বলতেও পারেন না। একই পাড়ার খেলার সাথি সাংবাদিক ও খেলোয়াড় কামরুজ্জামানের কথা বার বার মনে করছিলেন আর বলছিলেন জামান ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটে বেশী দক্ষ ছিলো। একবার ক্রিকেট লীগে ইষ্ট এন্ড ক্লাবের বিরুদ্ধে জামানের সেঞ্চুরির কথাটি আজও আমার মনে পড়ে। এরপর থেকে আমি জামানকে সেঞ্চুরি পিলিয়ার নামে ডাকতাম। জামান বয়সে আমার চেয়ে একটু বড় হলেও আমরা বন্ধুর মতোই ছিলাম।
ঢাকার ফুটবল জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিমল দা জানালেন আমি তখন পগোজ স্কুলে পড়ি। ঢাকার জিনজিরায় খ্যাপ খেলতে যাই। বজলু ভাই আমার খেলা দেখে কামাল স্পোর্টিং এ খেলার জন্য বলেন। আমি রাজি হয়ে যাই। এরপর ৫৮/৫৯ সালে কামাল স্পোটিংয়ে দ্বিতীয় বিভাগে লীগে খেলি। ওই বছরই কামাল স্পোটিং দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করে। লীগ অথবা আগা খান গোল্ডকাপে আমরা ঢাকা মোহামেডানের সঙ্গে খেলি। কামাল স্পোটিং ঢাকা মোহামেডানকে হারিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই দিনের ম্যাচটির কথা আজও আমার জীবনে স্বরণীয় হয়ে আছে। গোল খেয়ে ঢাকা মোহামেডানের ফরোয়ার্ডরা আমাদের রক্ষণ ভাগে বার বার হানা দিচ্ছিলো। আমি সেই দিন আমার দুই পা’কে তরবরির মতো ব্যবহার করে মোহামেডানের স্ট্রাইকারদের মাটিতে মিলিয়ে দিয়েছিলাম। মোহামেডানকে হারালেও কামাল স্পোটিং এক বছর পরই দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যায়। তখন বজলু ভাই আমাকে প্রথম বিভাগ লীগে ফায়ারসার্ভিসের নিয়ে যান।একই সঙ্গে ফায়ারসার্ভিসে চাকরিও হয়ে যায় খেলোয়াড়ী কোটায়। যতদুর মনে পড়ে তখন ফায়ারসার্ভিসে সীতাংশু,মোবাশ্বের, সরফুদ্দীন, ওবায়েদ, গাউস, আমান, কামরুজ্জামান, বজলুর রহমান, মজিবুর ওরফে কালেখা মুজিবুর (৭১ এ কেরানীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হন) হাকিমসহ আরও অনেকেই খেলেন যাদের নাম মনে করতে পারছিনা। প্রবীণ এই ফুটবলার বলেন, আমি দুই বছর কামাল স্পোটিং এ খেলার পরই ফায়ারসার্ভিসে খেলি।
১৯৭৩ সালে ফুটবল থেকে নিরবে অবসরে চলে যান বিমল। প্রায় একদশকেরও বেশী সময় ঢাকার ফুটবল লীগে খেলা ছাড়াও ১৯৬৯ সালে লাহোরে প্রাদেশিক ফুটবল টুর্নামেন্টে ঢাকার হয়ে খেলতে যান। ৫ নাম্বার জার্সি গায়ে ফায়ারসার্ভিসের রক্ষণ ভাগে স্টপার বিমল এক দশকেরও বেশী সময় আগলে রেখেছেন ফায়ার্সার্ভিসের গোল সীমানা। বিমল ছিলেন ফায়ারসার্ভিস দলের ফ্রি কিক মাস্টার। ঢাকার লীগে ফ্রী কিকে গোল করার অনেক নজির আছে তার।
৭৮ বছরের প্রবীণ ফুটবলার বিমল বলেন, আমরা বাঙ্গালীরা ভাল খেললেও অবহেলার শিকার ছিলাম। খ্যাপের ওস্তাদ বিমল তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন জেলা বা মহকুমায় ভাড়ায় খেলতে যেতেন। এতে কখনো খাওয়া-দাওয়া, যাতায়াত ভাড়া ছাড়াও ১০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পেতেন। এতেই খুব আনন্দ লাগতো বলে জানান।
কামাল স্পোর্টিং ও ফায়ারসার্ভিসের বজলু ভাইয়ের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, বজলু ভাই যেখানেই যেতেন মাঠে খেলোয়াড়দের খেলা দেখেই বুঝতে পারতেন কোন খেলোয়াড়ের মাঝে প্রতিভা লুকিয়ে আছে। তিনি তাদের মফস্বল থেকে ঢাকার লীগে কখনো কামাল স্পোটিং, ফায়ারসার্ভিসের দ্বিতীয় টিম হোল্ড্রেন একাদশ বা ফায়ারসার্ভিস দলে খেলাতেন।
প্রবীণ ফুটবলার বিমল চন্দ্র পাল বিবাহিত হলেও কোন সন্তান নেই। স্ত্রী অনুকা পাল মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। পালক মেয়ে ভারতী মন্ড ও মেয়ের জামাই রনজিত রায় তার দেখভাল করেন। নিঃসঙ্গ প্রবীণ ফুটবলার বিমল চন্দ্র পাল স্কুল জীবনে ইন্টার স্কুল ফুটবল খেলেছেন পগোজ ও ইষ্ট বেঙ্গল স্কুলের হয়ে। ষাট দশকে ইষ্ট বেঙ্গল স্কুল ১-০ গোলে নবকুমার স্কুলকে হারিয়ে ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ ফাইনাল খেলাটির কথা আজও তার মনে আছে বলে জানান। তার দুঃখ এখন ইন্টার স্কুল, কলেজ বা আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল হয় না। জাতীয় বা জাতীয় যুব ফুটবলও নিয়মিত না হওয়ায় ফুটবলের প্রতিযোগিতা নাই।নতুন নতুন ভাল মানের খেলোয়াড় না আসার অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।
বয়সের কারণে এখন অনেকটা গৃহবন্দী জীবন বিমলের। এক সময়ে খেলার জন্য যিনি ঢাকার এক মাঠ থেকে আরেক মাঠ, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় খ্যাপ খেলে ফুটবলের উত্তাল ও উন্মাদনার বছরগুলো পেরিয়েছেন, বয়সের কাছে পরাজিত হয়ে আজ তাকে একটি চেয়ারে বসে আর খাটে শুয়ে সময় পার করতে হয়। তার ৭৮ বছরের জীবনযুদ্ধের কঠিন সময়েও তিনি বাংলাদেশের ফুটবলের সুদিন প্রত্যাশা করেন।
শোকাবহ আগস্ট : আবাহনীর খেলোয়াড়দের রাতের অন্ধকারে অনুশীলন করতে হতো
পঞ্চাশ দশকঃ কায়দে আজম ট্রফিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটার মিন্টুর গল্প
ফুটবলার ইকবালের স্বপ্ন ভেঙেছে একটি রাফ টেকলিং
গ্যালারি মাতানো পাগলা মুজিবর আবাহনী সমর্থক হওয়ার পেছনের গল্প – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের ফুটবলে ভুলে যাওয়া নাম সত্তুর দশকের শার্প শ্যুটার সুলতান – CTG SANGBAD24
ঢাকার ফুটবল উন্মাদনাঃ কসাইদের মোহামেডান আর রহমতগঞ্জের ডাইলপট্টির কথা – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি – CTG SANGBAD24
পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প – CTG SANGBAD24
ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু – CTG SANGBAD24