মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সাংবাদিক খন্দকার তারেকঃ ক্রীড়াঙ্গনের জীবন্ত দলিল

সত্তুর দশকে ঢাকার ফুটবলের উন্মাদনা ও উত্তাল সময়ে মোহামেডান- আবাহনীর গুরুত্বপূর্ণ লীগের খেলায় ক্যামেরা হাতে গোলপোস্টের পাশে দাঁড়িয়ে ফুটবলের উত্তেজনাকর মুহূর্তটির ছবি ক্যামেরাবন্দী করে ক্রীড়া জগতের পাঠকদের কাছে যিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি ক্রীড়া সাংবাদিক খন্দকার তারেক। গ্রুপের সমর্থকদের ইট মারামারি বা পুলিশের লাঠি পেটা ও টিয়ার গ্যাসের মুখোমুখি হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন এ্যাকশনের ছবি ক্যামেরাবন্দী করে ক্রীড়াঙ্গের ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন। আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়, এর বেশীর ভাগ ছবিই ক্রীড়া সাংবাদিক খন্দকার তারেকের তোলা। গত পাঁচ দশক ধরেই ঢাকার ক্রীড়াঙ্গন ও ঢাকা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের দর্শকদের কাছে অতিপরিচিত মুখ হয়ে উঠেন তারেক। ক্রীড়ামোদীদের কাছে তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এক জীবন্ত দলিল।

পুরো নাম খন্দকার তারেক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ। জনপ্রিয় ফুটবল, ক্রিকেট, খেলোয়াড় হতে শুরু করে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই তিনি তারেক ভাই হিসেবেই পরিচিত। ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের একদিন পর থেকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বরিশালের সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাদের উদ্যোগে সদর গার্লস স্কুল মাঠে ডামি অস্ত্র হাতে শুরু করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। দেশ স্বাধীন করে বীরের বেশে দেশে ফিরে সেই হাতেই তুলে নিয়েছিলেন শখের ক্যামেরা। শখের ফটোগ্রাফি থেকেই পেশাদার ফটো সাংবাদিকতা। সেই শৈশবের ফুটবল-ক্রিকেট পাগলের নেশায়ই হাতে তুলে নিয়েছিলেন ফুপা নবীর রাশিয়ান জেনিথ ক্যামেরা। ষাট দশকের শেষে নিজ জেলা বরিশালের প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের খেলোয়াড় থেকেই নেশায় পেয়ে বসে স্পোর্টস ফটোগ্রাফির। ঢাকার লীগে কোন দলের হয়ে খেলার সুযোগ না পেলেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন স্পোর্টস ফটোগ্রাফিতে। প্রথমে শখ পরে পেশাদার ফটোগ্রাফার। ফিচার সংশ্লিষ্ট ছবি তুলতে হাত পাকিয়ে ফেলেন। ফটোগ্রাফির উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ হতে শুরু করে ফটোগ্রাফির বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কোর্সে অংশগ্রহণ করে নিজেকে গড়ে তোলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ক্রীড়া লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এক জীবন্ত ইতিহাস ও খেলার দলিল হিসেবে লাখ লাখ দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আছেন খন্দকার তারেক। ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে দেশপ্রেমিক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তার অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরষ্কার ২০২৩ এ ভূষিত হয়েছেন। যদিও এর আগেই তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার পক্ষ থেকে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য বহু পুরষ্কার পেয়েছেন।

সত্তুর দশকের শেষ ভাগ হতে ঢাকার ফুটবলের উন্মাদনা ও উত্তাল সময়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল মাঠের এক জীবন্ত সাক্ষী খন্দকার তারেক। আইসিসি ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ টেষ্ট প্লেয়িং কান্ট্রি হিসেবে যোগ্যতা অর্জনে মাঠের বিভিন্ন দৃশ্য ধারণ ও ক্যামেরাবন্দী করে সাক্ষী হয়ে আছেন এই ক্রীড়া সাংবাদিক।

সিটিজি সংবাদের সঙ্গে সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, সত্তুর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি তখন পুরান ঢাকার ওয়ারীতে থাকি। বাসার কাছেই থাকতেন দৈনিক সংবাদের সাংবাদিক আবু-আল-সাঈদ। বিভিন্ন বিষয়ে ফিচার ও রিপোর্টিং করতেন। তার অনুরোধ ও অনুপ্রেরণায় আমি দৈনিক সংবাদের ফিচার পাতায় নিয়মিত ছবি দিতে শুরু করি। এরপর খেলার নেশার কারণেই আমি খেলার ছবি তোলায় আগ্রহী হই বেশী। তখন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ফটো সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলম ভাই সংবাদের ফটো সাংবাদিক ছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা ফটো সাংবাদিকতায় আসায় আমার প্রতি তিনি বেশ আন্তরিক হন এবং সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকেন। সাঈদ ভাই ও আলম ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় কাজ করতে শুরু করি। একজন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া পাগল হিসেবে ঢাকার মাঠে কোন ক্লাবের হয়ে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলার সুযোগ না পেলেও খেলার ছবি তোলার নেশায় ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠকেই আপন করে নিই।

১৯৭৫-৭৬ সাল থেকেই দৈনিক সংবাদের ফটো সাংবাদিক হিসেবে প্রথমে ফ্রী ল্যান্স পরে পেশাদারীত্বের সূচনা। এরপর ১৯৭৮ সালে ঢাকায় এশিয়ার সর্ববৃহৎ যুব ফুটবল টুর্নামেন্টের আসর বসলে ক্রীড়া লেখক, ক্রীড়া সাংবাদিক, ধারা ভাষ্যকার আতাউল হক মল্লিক ভাই আমার স্পোর্টস ফটো সাংবাদিকতায় আগ্রহ দেখে ক্রীড়া জগত পত্রিকায় পার্টটাইম ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অনুরোধ করেন। তার অনুরোধেই আমি ক্রীড়া জগতেও পার্টটাইম কাজ শুরু করি। তবে সেই সময় আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় ক্রীড়া জগতে চাকরি স্থায়ী করতে আমাকে দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। সেই ১৯৭৮ সাল থেকে ঢাকা স্টেডিয়াম আর খেলার মাঠের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছি আজ-অব্দি।

ঢাকা স্টেডিয়ামে সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ননায় খন্দকার তারেক বললেন, সংবাদপত্রগুলোতে স্পোর্টস রিপোর্টিং বা স্পোর্টস ফটো সাংবাদিকতায় খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হতো না। দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক বাংলায় খেলার জন্য আলাদা পাতা রাখা হতো।সেই সঙ্গে সাপ্তাহিক খেলার ফিচার পাতাও প্রকাশিত হতো। তবে খুব কম কাগজেই শুধুমাত্র খেলার জন্য ফটো সাংবাদিকতায় কেউই ছিলেন না। কিন্তু আমার পছন্দ ছিলো স্পোর্টস ফটো জার্নালিস্ট হিসেবেই কাজ করা। তাই আমি স্পোর্টস ফটোগ্রাফিকেই বেছে নিই।

সেই সময়ের নানান তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে খন্দকার তারেক বলেন, সিনিয়র ফটো সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচন্ড হীনমন্যতা কাজ করতো। তারা জুনিয়র বা নতুন কেউ এই পেশায় এলেই দায়িত্ব পালনকালে তাকে নানান ভাবে নাজেহাল করতো। খেলার মাঠে ছবি তুলতে বাধাগ্রস্ত করা হতো, তাদের পাশে দাড়াতে বা বসতে দিতো না। আমি যখন প্রথম ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল লীগের ছবি তুলতে যেতাম তখন সিনিয়র ফটোগ্রাফাররা গেটে পুলিশকে বলতো আমাকে যেনো মাঠে ঢুকতে না দেয়, এই কথা বলে ওরা মাঠে চলে যেতো। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ভদ্র আচরণ করেছি। তাদের সঙ্গে তর্কে না গিয়ে আমি পুলিশকে বলতাম আপনারা কি তাদের চাকরি করেন? আমার মাঠে প্রবেশের পাস আছে,তাদের কথায় আমাকে বাধা দিবেন কেন? এরপর তারা দুঃখ প্রকাশ করে ছেড়ে দিতো এবং ফটো সাংবাদিকদের এমন মানসিকতার সমালোচনা করতো। এরপর মাঠে প্রবেশ করলেও সিনিয়রদের পাশে দাড়াতে বা বসতে দিতো না। বিষয়টি আলম ভাইকে জানালে তিনি আমাকে তার সঙ্গে নিয়ে মাঠে ঢুকতেন এবং তার পাশে দাড়াবার বা বসার জায়গা দিতেন। আলম ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় আমাকে তিনি হাতে-কলমে ফটোগ্রাফিতে পারদর্শী করে তুলতে সহযোগিতা করতেন। ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠে প্রবেশ ও খেলার ছবি তোলার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বলছিলেন খন্দকার তারেক।

মোহামেডানের সাপোর্টার ও আবাহনীর সাপোর্টাররা প্রায়ই আপনাদের উপর ক্ষুব্ধ হতেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার তারেক বলেন, ফটোগ্রাফার যারা আবাহনীর সমর্থক তারা মোহামেডানের গোলপোস্টের পাশে দাঁড়াতেন আর মোহামেডান সমর্থকরা আবাহনীর গোলপোস্টের পাশে দাঁড়াতেন। এ কারণে সমর্থকরা ধারণা করতেন কে কার সমর্থক। তবে সব ক্ষেত্রে তা সঠিক ছিলো না।

বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ক্যামেরায় ছবি তোলা আর এনালগ আমলের ফিল্মে ছবি তোলার পার্থক্যের অভিজ্ঞতা বর্ননায় খন্দকার তারেক বললেন, ওই সময় আমরা ৩৬টি স্নেব এর একটি ফিল্ম নিয়ে অপেক্ষা করতাম একটি দৃশ্য বন্দী করতে। টেনশনে থাকতাম কখন ফিল্ম শেষ হয়ে যায়। কারণ নতুন ফিল্ম ভরার জন্য তো আর খেলা বন্ধ থাকবে না। এ ছাড়া প্রায় সময়ই কাঙ্ক্ষিত মনের মতো ছবিটি সত্যিই উঠলো কিনা সংশয়ে থাকতাম। কারণ ছবির নেগেটিভ ডেভেলপ করার আগ পর্যন্ত জানতে পারতাম না আসলে কি তুললাম। এখন মেমোরি কার্ডে শত শত ছবি তোলা যায়। আধুনিক যুগের ক্যামেরায় ছবি তুলে মূহুর্তেই দেখা যায় কেমন ছবি হলো। প্রযুক্তির আধুনিকতায় আজ ছবি তোলাও সহজ হয়ে গিয়েছে।

কোন্ দৃশ্যের প্রতি টার্গেট থাকতো এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার তারেক বলেন, সত্তুর আশির দশকে জনপ্রিয় তারকা ফুটবলারদের গোল করার মুহুর্ত বা গোলমুখে শট নেয়ার দৃশ্যটির অপেক্ষায় থাকতাম। ওই সময় দেশ সেরা তারকা সালাউদ্দিন, চুন্নু, এনায়েত, বাদল রায়, সালাম, গাফফারসহ স্ট্রাইকারদের আক্রমণগুলোর প্রতিই ক্যামেরার ল্যান্সের ফোকাস থাকতো।অনেক সময় মারামারি দৃশ্যও ক্যামারা বন্দী করার টার্গেট থাকতো। খেলা শেষে যখন ডার্ক রুমে ছবি বানাতে ঢুকতাম তখন নেগেটিভ ডেভেলপের পর কখনো আনন্দিত হতাম আর হতাশও হতাম।

ফটো সাংবাদিকদের অবস্থান একেবারে গোলপোস্ট ঘেঁষে রক্ষনভাগ, গোলরক্ষক বা স্ট্রাইকারদের মাঠে কথোপকথনের বিচিত্র কোন অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে খন্দকার তারেক বলেন, বর্তমান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য গোলরক্ষক বিজন বডুয়ার কথা না বললেই নয়। তিনি গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে তার রক্ষণ ভাগের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারের পায়ে বল থাকলেই বলতে থাকতেন টান দিবো, টান দিবো ওরে আটকা, ওরে আটকা। তার এই ডায়লগটি এখনো মনে পড়লে হাসি পায়। খন্দকার তারেক বলেন, এখনো কোথাও দেখা হলে তাকে বলি টান দিবো, টান দিবো।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রায় অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসের সাক্ষী ক্রীড়া সাংবাদিক খন্দকার তারেক ১৯৭৮ সালে ক্রীড়া জগত পত্রিকায় পার্টটাইম ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করে ১৯৮০ সালে চাকরি স্থায়ী হয়।গ্যালারীতে সাপোর্টারদের ইটের আঘাতে মাথা ফেটে গুরুতর আহত হওয়ার পরই কর্তৃপক্ষ স্পোর্টসের নিবেদিত ক্রীড়া ও ফটো সাংবাদিকদের চাকরি স্থায়ী করে দেন।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী খন্দকার তারেকের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল মালয়েশিয়ায় আইসিসি ক্রিকেটে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবের দিনটি। ১৯৯৭ সালের সেই দিন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীকে কিছুক্ষণ পরপরই ফোন করে প্রতিমুহূর্তে বাংলাদেশের আপডেট খবর নেয়ার ঘটনাটি বলে জানালেন, প্রধানমন্ত্রীর খেলার প্রতি এতো আগ্রহের বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করেছিলো । সেদিন আয়ারল্যান্ডের সাথে আমরা জিতলে পরের ম্যাচ আরব আমিরাতের সাথে ড্র করলেই আমরা চ্যাম্পিয়ান হয়ে আইসিসি কোয়ালিফাই করতাম। হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। আমরাও টেনশনে। গ্রাউন্ডসম্যানদের সঙ্গে আমি ও শামসুল হোক টেংকু মাঠের পানি শুকানোর কাজ করি। কারণ ওইদিন বাংলাদেশ হেরে গেলে বা ড্র হলে ক্রিকেটে হয়তো আমাদের গৌরবের ইতিহাসটা বদলে যেতো, বলছিলেন খন্দকার তারেক।  এ ছাড়া দৈনিক সংবাদে কাজ করাকালীন সময়ে যশোরে অনুষ্ঠিত জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার ১০০ মিটার দৌড়ের ফিনিশিং পয়েন্টে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ্যাথলেট লিপি প্রথম স্হান অর্জনের দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী করে ঢাকায় ফিল্ম পাঠিয়ে সারা রাত অপেক্ষা করেছি, ছবি কেমন আসলো এ নিয়ে। পরদিন বিকেলে খেলার পাতায় ছবি খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম পাতায় চোখ রাখতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেন, নিজের তোলা ছবি তাও বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আলম ভাইয়ের হাতের বদান্যতায় ছবির ফোর্স বাড়িয়ে এমন ভাবে প্রিন্ট করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে দেশের অন্য দৈনিকেই প্রকাশিত ছবির চেয়ে তার তোলা ছবিটি ছিলো আকর্ষণীয় । যে কারণে ছবিটি প্রথম পাতায় স্থান করে নিয়েছিলো। সেই দিনের আনন্দের স্মৃতি আজও খন্দকার তারেকের কাছে স্মরণীয়।

১৯৮০ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল লীগে মোহামেডান-আবাহনীর খেলায় দর্শকদের ইটের আঘাতে মাথা ফেটে যাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাটি তার জীবনের দুঃসহ স্মৃতি। ৮০র দশকে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে জামায়াতের সমাবেশে গোলযোগ হলে পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারসেল ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠে ফটো সাংবাদিকদের সামনে এসে পড়লে গ্যাসের ঝাঁজে চোখের জ্বালাতনের চরম যন্ত্রণার ঘটনাটি মনে হলেই এখনো আঁতকে উঠেন বলে জানান তিনি। রণাঙ্গনের সম্মুখ বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার তারেক যুদ্ধের ময়দানেও এমন কঠিন যন্ত্রণা কাতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি বলে জানালেন।

প্রায় পাঁচ দশক বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সাক্ষী ফটো সাংবাদিক খন্দকার তারেক রাজনৈতিক সচেতন পরিবারের সন্তান। তার চাচা মোহাম্মদ ইমাদুল্লাহ ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। বরিশাল সদর বগুড়া রোডে স্থায়ী নিবাস হলেও এই সৎ ক্রীড়া সাংবাদিক আজ-অব্দি ঢাকায় মাথা গোজার একখন্ড জমি ক্রয় করতে পারেননি।

খন্দকার তারেক ১৯৬৮ সালে বরিশাল বজ্রমোহন হাই স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭২ সালে শেরে-বাংলা ফজলুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৭৮ সালে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্প কলায় গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ১৯৮১ সালে ঢাকার নবাববাড়ির কণ্যা জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন ও ব্যাডমিন্টনে জাতীয় ক্রীড়া পুরষ্কার প্রাপ্ত তারকা মরিয়মের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। একমাত্র ছেলে শাহ-ই-আলম সানি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা, দুই মেয়ে সিফাত-ই-নুর ফারিয়া ও রিফাত-ই-নুর।

বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার তারেক মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তার ফুপা নবী ও ফুপু বেলা নবী ১৯৭১ ঢাকা থেকে বিমানে টিকেট কেটে কুমিল্লা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগে বাবা মোঃ ওবায়েদ উল্লাহ অসুস্থ তারেকের মাতা মোছাম্মৎ সৈয়দা মোস্তারী ওবায়েতকে শেষ বারের মতো সন্তানের মুখটি দেখিয়ে বিদায় দেয়ার ঘটনাটি আজ স্মরণীয় বলে জানালেন। ভারতের চাকুলিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে পাকিস্তান ফেরত চৌকস কমান্ডো লেঃক্যাপ্টেন মাহ্ফুজ বেগের অধীনে নবম সেক্টরের অধীনে বৃহত্তর সাতক্ষীরা অঞ্চলের বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে একে একে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনা ঢাকার মীরপুরমুক্ত সেনা অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭২ এর ২ ফেব্রুয়ারী মেজর জলিলের মুক্তি চাওয়ার উছিলায় বঙ্গবন্ধুকে সামনা সামনি দেখার আশায় ধানমন্ডি ৩২ নাম্বরে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এসময় বারান্দায় পায়চারি করা বঙ্গবন্ধু তাদের দেখতে পেলে পুলিশের কাছে জানতে চান ওরা কারা? পুলিশ জানায় ওরা মুক্তিযোদ্ধা, মীরপুর মুক্ত করেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। তখন বঙ্গবন্ধু তাদের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলে লিডারের প্রতি আহবান জানান মেজর জলিলকে মুক্তি দেয়ার। বঙ্গবন্ধু তাদের জানান, ‘তোমরা যুদ্ধ করেছো দেশের জন্য ও আমাকে মুক্ত করতে। এখন স্বাধীন দেশ গড়ার কাজে মনযোগ দাও। জলিল জেনেভা কনভেনশন জানে না। ভারতীয় বাহিনী যা করছে তা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী করেছে‘। বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার তারেক এর স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি আজও স্মরণীয়।

শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরষ্কার প্রাপ্তিতে তিনি তার পাঁচ দশকের ক্রীড়া সাংবাদিকতার স্বীকৃতি হিসেবে খুবই আনন্দিত। খন্দকার তারেক সেরা বা সম্মাননা ক্রীড়া সাংবাদিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশের ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিকদের তিনটি সংগঠনের মাধ্যমে নাম গ্রহণের ব্যবস্থা প্রবর্তন হওয়া দরকার বলে মনে করেন। কারণ সেরা পুরষ্কারের জন্য আবেদন করাটা দৃষ্টিকটু বলে তিনি মনে করেন। প্রায় সত্তুর বছরের প্রবীণ ক্রীড়া লেখক ও ফটো সাংবাদিক বললেন, এখন ফটো সাংবাদিকদের মধ্যে মাঠে ছবি তোলা নিয়ে কোনো রেশারেশি নেই। সিনিয়র জুনিয়র বলে কিছু নেই। সবাই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও স্নেহপূর্ণ আচরণ করেন।

ক্রীড়া জগত পরিবারের সংবর্ধনা :: প্রায় পঞ্চাশ বছর ক্রীড়াঙ্গনে ফটো সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার তারেক। তার ক্যামেরায় দেশের খেলাধুলার হাজার হাজার ছবি ফুটে উঠেছে পাক্ষিক ক্রীড়া জগতের পাতায়। দেশের খেলাধুলার অনেক ঘটনার সাক্ষী খন্দকার তারেকের ক্যামেরা। তার নিখুঁত হাতেরছবি এখন ক্রীড়াঙ্গনের আর্কাইভ। ২৯ নভেম্বর পাক্ষিক ক্রীড়া জগত কার্যালয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয় খন্দকার তারেককে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ক্রীড়া জগত সম্পাদক মাহমুদ হোসেন খান দুলাল,  ক্রীড়া সংগঠক ফটো সাংবাদিক ইউসুফ আলী, জাগো নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা, পাক্ষিক ক্রীড়া জগতের সাবেক প্রতিবেদক ও বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, ক্রীড়া লেখক ইকরামুজ্জামান, সিটিজ সংবাদের ঢাকা ব্যাুরো চীফ ইকবাল কবীর, ক্রীড়া জগতের সাবেক সার্কুলেশন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হায়দার চৌধুরী, সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক ও ফুটবল বাংলাদেশের নির্বাহি সম্পাদক মোরসালিন আহমেদ, খন্দকার তারেকের স্ত্রী জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যাডমিন্টন তারকা মরিয়ম তারেক, তার পুত্রবধু প্রমি এবং পাক্ষিক ক্রীড়া জগতের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

খন্দকার তারেককে ফুল, ক্রেস্ট ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়েছে। উপস্থিত অতিথিরা খন্দকার তারেকের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন।আলোচনায় ক্রীড়াঙ্গনের নির্লোভ রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার তারেকের কর্মজবনের সততা ও ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি তার আন্তরিকতার বিষয়টি উঠে আসে আলোচনায়।

ক্রীড়াঙ্গনে আজিমপুর কলোনীঃ জুডো কন্যা সুমির সাফল্যের গল্প

৫১ বছর পর পরিচয় উদঘাটন: বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার প্রতিরোধে পুলিশ নয়, প্রথম শহীদ ফুটবলার খোকন

ষাটের দশকে ফুটবলে খ্যাপের ওস্তাদ ফায়ারসার্ভিসের বিমল দাদা এখন ইতিহাসের সাক্ষী

শোকাবহ আগস্ট : আবাহনীর খেলোয়াড়দের রাতের অন্ধকারে অনুশীলন করতে হতো

পঞ্চাশ দশকঃ কায়দে আজম ট্রফিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটার মিন্টুর গল্প

ফুটবলার ইকবালের স্বপ্ন ভেঙেছে একটি রাফ টেকলিং

গ্যালারি মাতানো পাগলা মুজিবর আবাহনী সমর্থক হওয়ার পেছনের গল্প – CTG SANGBAD24

বাংলাদেশের ফুটবলে ভুলে যাওয়া নাম সত্তুর দশকের শার্প শ্যুটার সুলতান – CTG SANGBAD24

ঢাকার ফুটবল উন্মাদনাঃ কসাইদের মোহামেডান আর রহমতগঞ্জের ডাইলপট্টির কথা – CTG SANGBAD24

বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি – CTG SANGBAD24

পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প – CTG SANGBAD24

ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু – CTG SANGBAD24