বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্য আর শান্তি নীড় ‘মাটির ঘর‘
হাজার বছরের ঐতিহ্য গ্রাম বাংলার চিরচেনা অন্যতম মাটির দেওয়ালে গাঁথা বাংলাঘর খ্যাত ‘কাঁচা মাটির ঘর’ এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে। একসময় শতভাগ কাঁচা মাটির ঘর ছিল বাংলার গ্রামাঞ্চলে। অনেকের দ্বিতল কাঁচা মাটির ঘর ছিল রাজকীয় প্রাসাদ। ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি তীব্র গরম ও কনকনে শীতে আদর্শ বসবাস-উপযোগী মাটির তৈরি এসব ঘর আগের মতো এখন আর তেমন একটা নজরে পড়ে না। দেখা মেলেনা গোলপাতায় কিংবা খড়ে ছাওয়া মাটিরঘর। বাড়ির সামনে সেই বৈঠকখানাও এখন বিলুপ্ত প্রায়। চিরচেনা গ্রামও এখন অচেনা লাগে। পাহাড়ি ছনে মাটির দেওয়ালে উঁচা চালাঘর দেখে অনেকটা ভাল লাগতো। তখন পাহাড়ি ছনের বাজার ছিল মৌসুমভিত্তিক সরগরম। এখন পাহাড় আছে, ছনও আছে তবে মাটিরঘর ও ছনের সেই ব্যবহার নেই। শান্তির নীড় হিসেবে বহুল পরিচিত মাটির ঘরের স্থান দখল করেছে ইট-পাথরের উঁচু দালান। গরিবের এসি বলে সুপরিচিত মাটির দেয়ালে গাঁথা বাংলাঘর (কাঁচা মাটির ঘর) এখন বিলুপ্তির পথে। সাতচালা কিংবা আটচালা মাটির বাংলাঘর এখন আর নজরে পড়ে না।
গ্রামে এখনও হাজারে গুনা দু’একটি কাঁচা মাটির ঘর দেখলে আমাদের প্রজন্মের কাছে অদ্ভুত আবিস্কার মনে হয়। এখন বাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যের কাঁচা মাটির ঘর তেমন চোখে পড়ে না। কালের আবর্তে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়ও হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন মাটির তৈরি ঘর। এখন তেমন একটা আর চোখে পড়েনা গ্রাম বাংলার চির ঐতিহ্যের নিদর্শন সবুজ শ্যামল ছায়া ঘেরা শান্তির নীড় মাটির তৈরি বাড়ি (ঘর)। যা এক সময় ছিল গ্রামের মানুষের কাছে গরিবের এসি বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। মাটির দেওয়াল ভেঙে টিন কিংবা বাঁশের বেড়া দেওয়ালের পরিপূরক হিসেবে দখল করেছে। ছনের চালাও হারিয়েছে টিনের রাজত্বে। গ্রামের অধিকাংশ বসতঘর হয়তো বাঁশের বেড়া আর টিনের চালায় কিংবা ইট-পাথরের গাঁথুনিতে উঁচু দালান কোটা। সবমিলিয়ে কালের আবর্তে হারিয়েছে ‘কাঁচা মাটির ঘর’ খ্যাত বাংলাঘর।
বেশি দিন আগের কথা নয়, বাংলার প্রতিটি গ্রামে নজরে পড়তো এই মাটির বাড়ি ঘর। ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশা-পাশি প্রচুর গরম ও শীতে বসবাস উপযোগী মাটির তৈরি বাড়ি ঘর। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আর সময়ের পরিবর্তে গ্রাম বাংলা থেকে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি বাড়ি-ঘর বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই বাড়ি ঘর শীত ও গরম মৌসুমে আরামদায়ক বলে গ্রামের অনেক বিত্তবানও এই মাটির দ্বিতল বাড়ি ঘর তৈরি করতেন।
জানা যায়, অতি প্রাচীনকাল থেকেই মাটির বাড়ি বা ঘরের প্রচলন ছিল। গ্রামের মানুষের কাছে এই বাড়ি বা ঘর ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল। গ্রামের বিত্তবানরা এক সময় অনেক অর্থ ব্যয় করে মজবুত মাটির দ্বিতল বাড়ি ঘর তৈরি করতেন। যা এখনও কিছু কিছু গ্রামে চোখে পড়ে। এঁটেল বা আঠালো মাটির কাঁদায় পরিণত করে ২-৩ ফুট চওড়া করে দেয়াল বা ব্যাট তৈরি করা হয় ১০-১৫ ফুট উঁচু। দেয়ালে কাট বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় বা টিনের ছাউনি দেয়া হয়।
মাটির বাড়ি-ঘর অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত করা হতো। সব ঘর বড় মাপের হয়না। গৃহিনীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও বর্ষা মৌসুমে মাটির বাড়ি ঘরের ক্ষতি হয় বলে বর্তমান সময়ে দীর্ঘ স্থায়ীত্বের কারণে গ্রামের মানুষরা ইটের বাড়ি নির্মাণের আগ্রহী হচ্ছেন। ভূমিকম্প বা বন্যা না হলে একটি একটি মাটির বাড়ি শত বছরেও বেশি স্থায়ী হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে কালের বিবর্তনে ইটের দালানকোটা আর বড় বড় অট্টালিকার কাছে হার মানছে মাটির বাড়ি ঘর।
উপজেলার শীলকূপ মনকিচর গ্রামের আইচ্ছা মিয়া সিকদার, মোতাব্বত পাড়ার কবির আহমদ, চাম্বলের নুরুল আমিন, কালীপুরের মনির আহমদ, সরলের গুরা মিয়া সহ আরো অনেকে জানান, মাটির তৈরি এই বাড়ি-ঘর তারা পেয়েছেন পৈত্রিকভাবে। তাদের পূর্ব পুরুষরাও এই মাটির তৈরি বাড়িতেই জীবন কাটিয়ে গেছেন। সে সময়ে এ ঘরে বেশ আরামে থাকা যেত শীত-গরমে। মাটির বাড়ি বসবাসের জন্য আরামদায়ক হলেও যুগের পরিবর্তনে আধুনিকতার সময় অধিকাংশ মাটির বাড়ি ঘর ভেঙ্গে অধিক নিরাপত্তা ও স্বল্প জায়গায় দীর্ঘ স্থায়ীভাবে অনেক লোকের বসবাসের জন্য গ্রামের মানুষরা ইটের বাড়ি ঘর তৈরি করছেন বলে তাদের অনেকের ধারণা।
এখনো গ্রামিণ ঐতিহ্যের বাংলাঘর খ্যাত কাঁচা মাটির ঘর শোভা পাচ্ছে বাঁশখালী উপজেলার পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে। বিশেষ করে পুকুরিয়া, সাধনপুর, কালিপুর, জঙ্গল জলদী, পূর্ব শীলকূপ, জঙ্গল চাম্বল, নাপোড়া ও পুঁইছড়ির মতো পূর্বা পাহাড়ি অঞ্চলে। এ বাড়ির দেওয়াল দেখলে মনে হবে সিমেন্টের আস্তর দেওয়া হয়েছে। অনেকটা ধবধবে সাদা আবার অনেকটা হলদে পাহাড়ি মাটির রঙে রঙিন। মাটিরঘর হলেও চালায় নেই সেই পাহাড়ি ছন কিংবা খড়। এভাবে একদিন চিরচেনা বাংলার কাঁচামাটির ঘরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আধুনিকতার ছোঁয়া হারিয়ে যাবে গ্রামিণ সভ্যতার এ ঐতিহ্য।