বিদেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল জয়ের নায়ক স্ট্রাইকার হাসান এখন যেমন আছেন
স্ট্রাইকার হাসান। সত্তুর দশকে বাংলাদেশের কিংবদন্তী তরুণ ফুটবলার। দেশে বিদেশী তথা এশিয়া মহাদেশের ফুটবল জগতে স্ট্রাইকার হাসান পূর্নিমার চাঁদের আলোর মতোই বাংলাদেশের ফুটবলকে আলোকিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত এশীয় যুব ফুটবল টুর্নামেন্টের বৃহৎ আসরে বাংলাদেশ যে প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবলে বিজয়ের গৌরব অর্জন করেছিলো সেই বিজয় সূচক গোলটি এসেছিলো হাসানের পা থেকেই। প্রায় সাড়ে চার দশক আগের সেই গৌরবময় ফুটবলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হাসান আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
সেই ১৯৭৮ সালের কথা। ঢাকায় বসেছে ২০তম এশীয় যুব ফুটবল টুর্নামেন্টের জমজমাট উৎসবমুখর আসর। ঢাকায় এতো বড় ফুটবলের আসর আগে কখনও হয়নি। তাই টুর্নামেন্ট নিয়ে ফুটবল উন্মাদনা ছিলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই। সারাদেশই মেতেছিলো ফুটবল নিয়ে। আর এই জমজমাট আসরে বাংলাদেশ জাতীয় যুব দলের স্ট্রাইকার হাসানের জীবনের স্মরণীয় খেলা উত্তর ইয়েমেনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের দিনটি। সেই দিন লাখ ফুটবল পাগল দর্শকদের উপস্থিত ও বিটিভিসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সরাসরি সম্প্রচারিত খেলার দ্বিতীয়ার্ধের ২৮ মিনিটে সহপাঠী হাসানুজ্জামান বাবলুর কাছ থেকে বল পেয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ইয়েমেনের গোলরক্ষককে প্লেসিং শটে পরাজিত করে গোলটি করেছিলেন হাসান। সেই খেলাটি তার জীবনের স্মরণীয় আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। হাসানের দুঃখ একই ম্যাচে বাবলু আরেকটি বল ইয়েমেনের গোল সীমায় ঢুকে তাকে পাস না দিয়ে নিজেই গোল করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু বলটি যখন গোলপোস্টের বাহিরের দিকে চলে যাচ্ছিল হাসান তখন দ্রুত দৌড়ে সেই বলে পা ছোঁয়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন। এটাই তার জীবনের দুঃখজনক ঘটনা। সেই দিন বাবলু বলটি নিজে না মেরে তাকে দিলে খুব সহজেই বাংলাদেশ ২ গোলে এগিয়ে যেতে পারতো। হয়তো বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাসটা অন্যরকম হতে পারতো। সেই দিনের ২য় গোলটি করতে না পারার ব্যর্থতা আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
স্ট্রাইকার হাসান মনে করেন, যতদিন বাংলাদেশ ও ফুটবল থাকবে ফুটবলের গৌরবময় প্রথম বিজয়ের রেকর্ডের পাতায় তার নাম আছে, থাকবে।
১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ প্রায় একযুগ। ফুটবল জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হাসান বলেন, তখন ফুটবলের ছিলো স্বর্ণযুগ। আমি ভাগ্যবান ফুটবলের সেই উত্তাল ও উন্মাদনার সময়ে আমি ফুটবল খেলেছি। ঢাকার হাতিরপুলের বাড়িতে সেই উন্মাদনার ফুটবল জীবন কাহিনীর বর্ননা হাসান করছিলেন এভাবেই। ফুটবল জীবনের সততা, একাগ্রতা ও তার ফুটবল গুরু বজলুর রহমানের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসার কথা। হাসান বলেন, পাক্কা সোনারু যেমন জহরত চিনতে ভুল করে না, তেমনি ফুটবল কোচ বজলু ভাই কখনো ফুটবলার চিনতে ভুল করেননি।
প্রয়াত এই প্রাক্তন ফুটবলার ও কোচের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার ফুটবলার হওয়ার পেছনের গল্প বলতে গিয়ে হাসান বলেন, সেই ১৯৭২ সালের কথা, আমি তখন পগোজ স্কুলের অষ্টম কি নবম শ্রেনীর ছাত্র। বজলু ভাইয়ের কামাল স্পোটিং ক্লাবের সঙ্গে আমাদের পগোজ স্কুলের একটি প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় পুরান ঢাকার নবকুমার ইনিস্টিউটের মাঠে। সেই খেলায় দূর্দান্ত ফুটবল খেলে আমরা বজলু ভাইয়ের কামাল স্পোটিং ক্লাবকে ৪-২ গোলে হারিয়ে দিই।আমি নিজে দুটি গোল করি। আমার খেলায় মুগ্ধ হয়ে খেলা শেষে বজলু ভাই বলেন, তুমি নিয়মিত অনুশীলন করলে উচু মানের ফুটবলার হতে পারবে। তোমার মধ্যে অনেক প্রতিভা আছে। আমি তোমাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিবো, যদি তোমার ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছা থাকে। হাসান সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। তখন বজলু ভাই তাকে অভিভাবকসহ পরদিনই ইকবাল হল মাঠে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তখন ঢাকার আশপাশের বহু তরুণ, কিশোর খেলোয়াড় ইকবাল হল মাঠে ওস্তাদ বজলু ভাইয়ের কাছে তালিম নিতেন। বাড়িতে এসে হাসান পুরো ঘটনা খুলে বলেন তার বাবা-বড় ভাইয়ের কাছে। ব্যবসায়ী বাবা কোন ক্রমেই রাজী হচ্ছিলেন না। কারণ ছেলের পড়ালেখা ও ব্যবসার ক্ষতির কথা চিন্তা করে ফুটবল খেলতে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না হাসানের বাবা এ,এম ফজলুল হক। তবে তার বড় ভাই আহমেদুল হক বাদল রাজি হয়ে যান এবং তার বাবাকে ম্যানেজ করেন। তিনি তার পাড়ার বন্ধু খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামান ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ইকবাল হল মাঠে কোচ বজলু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে অভিভাবক হিসেবে তাদের কোন আপত্তি নাই বলে জানান। তিনি হাসানকে বজলু ভাইয়ের হাতে তুলে দেন।
ফুটবলার হওয়ার গল্পটা এভাবেই বলছিলেন স্ট্রাইকার হাসান। সেই দিন থেকেই শুরু হলো হাসানের ফুটবল জীবনের নতুন অধ্যায়। স্কুল শেষে তাতীবাজারের বাসা থেকে হাসান নিয়মিত বজলু ভাইয়ের কাছ থেকে ফুটবলের নানা কৌশলের তালিম নিতে শুরু করেন।এরই মাঝে হাসান ইতিহাসের আর একটু পেছনে গিয়ে জানান, তার ইচ্ছা ছিলো এ্যাথলেট হওয়ার। কারণ স্কুল জীবনে বার্ষিক ক্রীড়া ও ইন্টার স্কুলের ১শ থেকে ২শ, ৪শ ও ৮০০শ মিটার দৌড়ে হাসান ছিলেন অপ্রতিদ্বন্ধী। স্কুলের প্রতিটি ইভেন্টেই প্রথম অথবা ২য় স্থান অর্জন ও দলগত ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ান হতেন। তাই তার স্বপ্ন ছিলো একজন ভাল এ্যাথলেট হওয়া। কিন্তু এই এ্যাথলেটের মাঝে লুকিয়ে থাকা ফুটবল প্রতিভা আবিষ্কার করেছিলেন কোচ বজলুর রহমান। তার ঘষামাজায় হাসান আস্তে আস্তে একজন পরিনত ফুটবলার হতে থাকেন।
দ্রুত গতি, বলের প্রতি নিয়ন্ত্রণ, চমৎকার হেড ওয়ার্ক ও পায়ে থাকা প্রচন্ড শটে সহজেই প্রতিপক্ষের গোলরক্ষকে পরাজিত ও গোলসীমায় রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের তছনছ করার দক্ষতায় বজলুর রহমান হাসানকে ২য় বিভাগের কামাল স্পোটিং ক্লাবে (৭২এ লীগ বন্ধ হয়ে যায়) না খেলিয়ে ১৯৭৩ সালে সরাসরি প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ফায়ার সার্ভিস দলের হয়ে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। আর বজলু ভাই তখন ফায়ার র্সাভিস দলের কোচ। স্কুল ফুটবল থেকে সরাসরি প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে হাসানের জন্য এটা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের ফায়ার সার্ভিসে তখন সিনিয়র খেলোয়াড়দের মধ্যে গোলরক্ষক সিতাংশু দাদা, গফুর, আক্রমণভাগে আমান, শরফুদ্দীন, কাজী শরীফ, রক্ষণ ভাগে বিমল, রাজ্জাক, আমান, দুলাল শামীম, ওয়াহাবসহ একঝাঁক অভিজ্ঞ ফুটবলারের মিলন মেলা। তাদের সঙ্গে হাসান মাঠে নেমে সাহসী হয়ে উঠেন। স্ট্রাইকার পজিশনে হাসান দুর্দান্ত খেলে সবার নজর কাড়েন। ৭৩-৭৪ দুই বছর ফায়ার সার্ভিসের হয়ে দাপটের সঙ্গে খেলে ৭৫ সালে দিলকুশায় খেলার আমন্ত্রণ পান। হাসান তার ফুটবল গুরু বজলু ভাইয়ের কথার বাইরে কখনো কোন দলে খেলেননি। বজলু ভাই হাসানকে দিলকুশা স্পোটিং ক্লাবে খেলার অনুমতি দেন। দিলকুশায় ৭৫ সালে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেন। তার সহযোদ্ধা ঝাকড়া চুলের অপর স্ট্রাইকার নীলু। আর নীলু ছিলেন পায়ের চেয়ে মাথায় হেডে গোল কারায় পটু। নীলু- হাসান জুটির দূর্দান্ত দাপটে বড় দল তথা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও তৎকালীন বিআইডিসির রক্ষণ ভাগের খেলোয়াড়রা থাকতেন আতঙ্কে। তাই বড় দলগুলোর নজর পরে হাসানের দিকে।
এ সময় হাসানের ফুটবল গুরু বজলু ভাই ১৯৭৬ সালের লীগ ফুটবল মৌসুমে ঢাকা মোহামেডানে খেলার অনুরোধ করেন। হাসান তার গুরুর কথা কখনোই বরখেলাপ করতে পারেননি। তাই ৭৬ সালে হাসান ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে যোগদান করেন। ওই বছর ঢাকা মোহামেডান উপর্যুপরি দ্বিতীয় বারের মতো লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করলেও হাসানকে ঢাকা মোহামেডান একটি ম্যাচ খেলার পর আর প্রথম ১১ জন রাখেনি রহস্যময় কারণে। আজও হাসানকে এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলে, যেখানে ঢাকা মোহামেডানে তুখোড় স্ট্রাইকার মেজর হাফিজ ও নওশেরের মতো খেলোয়াড় রয়েছে সেখানে কি তার স্থান হবে?কি কারণে গুরু তাকে মোহামেডানে পাঠিয়েছিলেন ৪৭ বছর পর আজও হাসান বুঝতে পারেননি। তাই মনে অনেকটা দুঃখ নিয়েই হাসান ৭৬ সালটা কাটিয়ে দেন মাঠের বাইরে বসে। পরের বছরই ১৯৭৭ সালে পুরান ঢাকার ক্লাব রহমতগঞ্জে যোগ দেন।ওই বছর রহমতগঞ্জ প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ ও লিবারেশন কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হয়। পরের বছর ১৯৭৮ এ হাসান অফিস ক্লাব বিজেআইসিতে যোগদান করেন। ওই বছর পিডব্লউডি স্পোর্টস ক্লাবের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিকসহ লীগে ৭/৮ টি গোল করেন। বিজেআইসি লীগে রানার্সআপ হয়।
১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২০তম এশীয় যুব ফুটবল টুর্নামেন্টে হাসান বাংলাদেশ জাতীয় যুব দলে স্থান করে নেন। ইয়েমেনের বিরুদ্ধে হাসানের গোলে বাংলাদেশ জয়লাভ করলে বড় ক্লাবগুলোতে হাসানের চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু হাসান তার ফুটবল গুরু বজলু ভাইয়ের কথার বাইরে নড়চড়ও করতেন না। তাই ১৯৭৯ সালেও হাসান বিজেআইসিতেই থেকে যান। দল বদলের আগে ক্লাব কর্মকর্তারা ক্লাবের একটি ভাউচারে ১ লাখ ২০ টাকার একটি ফিগারে স্বাক্ষর করান। তখন হাসান জানতে পারলেন ওই সময় ঢাকার ফুটবল লীগে কোন খেলোয়াড়দের এটাই সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক। তবে এই পারিশ্রমিকের টাকা তিনি গ্রহন করেননি। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর ঘরে জন্ম নেয়া হাসান ফুটবল খেলার জন্য কোন ক্লাব থেকেই পারিশ্রমিক নিতেন না।
১৯৭৯ সালে ফুটবল লীগের দল বদলে ১লাখ ২০ হাজার টাকার সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকটি গ্রহণ করেছিলেন তার ফুটবলের গুরু বজলু ভাই। তিনি এই টাকায় তার কামাল স্পোটিং ক্লাব চালাতেন। ব্যবসায়ী ঘরের সন্তান হাসান কখনোই ফুটবল খেলে টাকা নেননি। মূলতঃ তার ফুটবল গুরু বজলু ভাই তাকে যখন যে দলে খেলতে বলতেন তখন সেই দলেই খেলতেন। তার ফুটবল গুরু বজলু ভাইয়ের প্রতি তার প্রচন্ড আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের কারনেই তিনি তার খেলোয়াড়ী জীবনের ভালমন্দ সব বিষয়ই ছেড়ে দিয়ে ছিলেন গুরুর সিদ্ধান্তের ওপর।
বজলু ভাই ছিলেন তার আদর্শ গুরু। হাসান বললেন, তার খেলোয়াড়ী জীবনে কো দিন তিনি লাল কার্ড তো দূরের কথা হলুদ কার্ডও দেখেননি। তিনি নিজেকে সুশৃঙ্খল খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে বিজেআইসি চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করে। হাসান সুপার লীগে ওয়ারীর বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেন। ওই বছর সুপার লীগে ৬টি গোলসহ লীগের দুই পর্বে ১২টি গোল করেছিলেন বলে হাসান জানান। ঢাকার লীগ ফুটবল ছাড়াও হাসান বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে ব্যাংকক এশীয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া জাতীয় ফুটবলে ঢাকা জেলা দলের হয়ে নিয়মিত খেলেছেন। ১৯৮০ সালে হাসানের অধিনায়কত্বে ঢাকা জেলা জাতীয় ফুটবলে রানার্সআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বরিশাল পুলিশ লাইন মাঠে অনুষ্ঠিত ফাইনালে ঢাকা জেলা ০-১ গোলে হেরে যায়।
ফুটবলার না হলে একজন এ্যাথলেট হওয়ার ইচ্ছা ছিলো বলে জানালেন হাসান। এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, ১৯৭৩/৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ এ্যামেচার এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার পুরুষদের ১শ মিটার দৌড়ে হাসান ১১.৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করে ঢাকা দক্ষিণের দ্রুততম পুরুষ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। পগোজ স্কুলের হয়ে তিনি ওই এ্যাথলেক্সে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাই এ্যাথলেট হওয়ার ইচ্ছা ছিলো।
ফুটবল জীবনের গল্পে আবার ফিরে আসেন। ১৯৮০ সালে বিজেএমসিতে থাকাকালীন লীগের প্রথম ম্যাচেই ইস্ট এন্ড ক্লাবের সঙ্গে খেলার দিন গোলরক্ষক মোশাররফ বাদলের সঙ্গে ক্লেশে হাসান হাঁটুতে আঘাত প্রাপ্ত হন। এরপর ওই বছর আর একটি ম্যাচও খেলতে পারেননি। ফুটবলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। ১৯৮০ সাল থেকেই ফুটবলের ফর্ম হারিয়ে ফেলেন হাটু অপারেশনের কারণে। এরপর ৮২ সালে পুরনো দল রহমতগঞ্জে ফিরে এলেও আর নিয়মিত খেলতে পারেননি। অনেকটা নীরবে নিবৃত্তে ফুটবল মাঠকে বিদায় জানিয়ে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন।
সুদর্শন তরুণ ফুটবলার হাসান ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৭৮ সালের এশীয় যুব ফুটবলের টপ ফর্মে। তখন হলিক্রসের ছাত্রী আদিবার সঙ্গে টেলিফোনে পরিচয়। আদিবা ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২০তম এশীয় যুব ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা ঢাকা স্টেডিয়ামের ভিআইপি গ্যালারীতে বসে দেশ-বিদেশের তরুণ ফুটবলারদের জমজমাট ফুটবল উপভোগ করতেন। সুদর্শন ঝাকড়া চুলের স্টাইলিশ ফুটবলার ঢাকার ছেলে হাসানের ফুটবল ফ্যানের অভাব না থাকলেও এশীয় যুব ফুটবলে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে কলেজ ছাত্রী আদিবার মন জয় করেছিলেন হাসান। চার বছর পর ১৯৮২ সালের ১০ নভেম্বর আদিবা সুলতানার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হাসান। বর্তমানে তাদের দুই সন্তান আইয়ান আহমেদুল হক আতিশ ও আইয়ায আহমেদুল হক আদিবকে নিয়ে রাজধানীর হাতিরপুলের বাড়িতেই বসবাস করেন। নিজে একজন খ্যাতিমান দেশ সেরা ফুটবলার হওয়ার পরও ছেলেরা ফুটবলে কেন আসলো না, এমন প্রশ্নের উত্তরে হাসান বলে, ছেলেরা বলে ফুটবল এখন ভূয়া। তাদের আগ্রহ ক্রিকেটে।
জাতীয় দলের প্রাক্তন স্ট্রাইকার হাসান বর্তমানে পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জে হার্ডওয়্যার ব্যবসা করেন। হাসানের জন্ম ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি বর্তমান চকবাজার থানা এলাকার বড় কাটারায় হলেও তার শৈশব পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে কেটেছে। ৬৩ বছরের প্রবীন ফুটবলার হাসানের মনে দুঃখ বিদেশী দলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের গোলটি তার পা থেকে এসেছে। ঢাকার লীগে ঢাকা মোহামেডান, আবাহনী ক্রীড়া চক্র, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স বা ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো জনপ্রিয় বড় ক্লাবে না খেলা সত্বেও ফুটবল লীগে তার একাধিক হ্যাটট্রিকের কৃতিত্বে অফিস ক্লাব বিজেআইসিকে চ্যাম্পিয়ন, ১৯৭৫ সালে দিলকুশা স্পোটিং ক্লাবকে লীগে রানার্সআপ ও ১৯৭৭ সালে রহমতগঞ্জ এমএফএসকে লীগ ও লিবারেশন কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে রানার্সআপ করার কৃতিত্ব থাকা এবং তার এক যুগেরও বেশী সময় খেলোয়াড়ী জীবনে কখনো হলুদ-লাল কার্ড না পাওয়ার সুশৃঙ্খল খেলোয়াড়ী জীবন হওয়া সত্বেও তাকে আজ পর্যন্ত কোন ক্রীড়া পুরষ্কার প্রদান করা হয়নি। তাই আমাদের সন্তানরাও ফুটবল খেলায় আসতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ দেশে ভাল ও সুশৃঙ্খল ফুটবল খেলোয়াড়দে মূল্যায়ন হয় না এমনটাই অভিযোগ জাতীয় ফুটবল দল ও বিদেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের নায়ক স্ট্রাইকার হাসান।
একনজরে হাসান : জন্ম ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি। ঢাকার অফিস ক্লাব ফায়ার সার্ভিসের হয়ে ১৯৭৩ সালে সরাসরি প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশগ্রহণ। দুই বছর ফায়ার সার্ভিসে খেলার পর ১৯৭৫ সালে দিলকুশা স্পোটিং, ১৯৭৬ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা মোহামেডানে, ১৯৭৭ সালে রহমতগঞ্জ এমএফএস, ১৯৭৮থেকে১৯৮১ বিজেআইসিতে, ১৯৮২-১৯৮৪ সালে রহমতগঞ্জ এমএফএস হয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশগ্রহণ ও নীরবে অবসর গ্রহণ।
ফুটবলে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব : ১৯৭৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২০তম এশীয় যুব ফুটবল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের হয়ে উত্তর ইয়েমেনের বিরুদ্ধে জয়সূচক গোল। যা বিদেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ফুটবল দলের প্রথম জয়। ১৯৭৮ সালে বিজেএমসির হয়ে পিডব্লউডির বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক। ১৯৭৮ সালে বিজেআইসি র লীগে রানার্সআপ। ১৯৭৯ সালে বিজেআইসি লীগ চ্যাম্পিয়ন, ওয়ারীর বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক। ১৯৭৯ সালে আগাখান গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিজেআইসির ৬-১ গোলে জয়ের রেকর্ড ৪টি গোলের উৎসই হাসানের। এ ছাড়া ১৯৮০ সালে জাতীয় ফুটবলে ঢাকা জেলার অধিনায়ক ও রানার্সআপ। এ ছাড়াও উন্মুক্ত এ্যামেচার এ্যাথলেটে ঢাকা দক্ষিণ (১৯৭৪)এর দ্রুত পুরুষ হওয়ার গৌরব অর্জনের মতো কৃতিত্ব রয়েছে তার গৌরবের ভান্ডারে।
ষাটের দশকে ফুটবলে খ্যাপের ওস্তাদ ফায়ারসার্ভিসের বিমল দাদা এখন ইতিহাসের সাক্ষী
শোকাবহ আগস্ট : আবাহনীর খেলোয়াড়দের রাতের অন্ধকারে অনুশীলন করতে হতো
পঞ্চাশ দশকঃ কায়দে আজম ট্রফিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটার মিন্টুর গল্প
ফুটবলার ইকবালের স্বপ্ন ভেঙেছে একটি রাফ টেকলিং
গ্যালারি মাতানো পাগলা মুজিবর আবাহনী সমর্থক হওয়ার পেছনের গল্প – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের ফুটবলে ভুলে যাওয়া নাম সত্তুর দশকের শার্প শ্যুটার সুলতান – CTG SANGBAD24
ঢাকার ফুটবল উন্মাদনাঃ কসাইদের মোহামেডান আর রহমতগঞ্জের ডাইলপট্টির কথা – CTG SANGBAD24
বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল লীগে আবাহনীর খেলোয়াড় টিপু’র দূর্বিষহ স্মৃতি – CTG SANGBAD24
পঞ্চাশের দশকে ঢাকার ফুটবলে রক্ষণ ভাগের দুই প্রহরীর গল্প – CTG SANGBAD24
ফুটবলার তৈরীর পাঠশালা গ্রামীণ জনপদ, এখানে নজর দিতে হবে : আসকর খান বাবু – CTG SANGBAD24