বিরল রোগ প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত মিরসরাইয়ের শাহাদাত

১০ বছরের শিশু যেন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ !

মিরসরাইয়ের শিশু শাহাদাত। বয়স ১০ বছর। কিন্তু শারিরিক কাঠামোয় যেনো সে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ! ৩ ফুট উচ্চতার শিশুটি বিরল রোগ প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত। শাহাদাত উপজেলার ১৫ নং ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের মাইজগাঁও গ্রামের মোহাম্মদ হানিফ ও নাছিমা আক্তার দম্পত্তির তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। সে মির্জাবাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। তার মাথায় চুল নেই বললেই চলে। চেহারায় পুরোপুরি বার্ধক্যের ছাপ। হাত ও পায়ের রগগুলো ফুলে শরীরের উপরে ধরা দিচ্ছে। চোখ, মুখ, নাক, কান, গলার চামড়া বুড়িয়ে গেছে। অঙ্গ প্রতঙ্গের আকৃতি, বর্ণ ও মাথার চুলেও স্পষ্ট শিশুটি মোটেও ছোট নয়। দেখে খর্বাকৃতির সত্তরোর্ধ্ব কোনো বৃদ্ধই মনে হবে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এমন সব বৈশিষ্ট্যের শাহাদাতের গলার স্বর নাবালক শিশুর মতো মিষ্টি।

জানা যায়, বিশ্বে ৪০ থেকে ৮০ লাখ শিশুর মধ্যে মাত্র ১ জন শিশু প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত শিশু বাঁচে মাত্র ১৩-১৫ বছর। বেশিরভাগই ১৩ বছর পর মৃত্যুবরণ করে। বর্তমানে দেশে এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। বিদেশেও ভালো চিকিৎসার খবর পাওয়া যায়নি। তবে আক্রান্ত শিশুদের শরীরে প্রভাব সৃষ্টিকারী সমস্যাগুলোকে দমিয়ে রাখার চিকিৎসার তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে শাহাদাতের জন্ম। জন্মের ৪ মাস পর প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয় শাহাদাত। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ মাস ১৪ দিন চিকিৎসাধীন ছিল। চিকিৎসা নিলেও কোনো উন্নতি হয়নি তার। সেসময় চিকিৎসকরা জানান, তাকে বাঁচাতে সুদূর আমেরিকায় নিয়ে যেতে হবে। ওইসময় একটি সংস্থা শাহাদাতের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও শেষ অবধি তা আর হয়ে উঠেনি। সেই থেকে দিনদিন বার্ধক্যের ছাপ বাড়তে থাকে শাহাদাতের শরীরে। দৈনন্দিন জীবনে নেমে আসে একের পর এক কষ্ট।

শাহাদাতের মা নাছিমা আক্তার জানান, যখন শাহাদাদের জন্ম হয় তখন থেকেই তার শরীরে বয়স্ক মানুষের ছাপ চোখে পড়ে। কিন্তু তারা ভেবেছিল সেই সমস্যা একসময় কেটে যাবে। প্রোজেরিয়ার সাথে তারা তখনো পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে শাহাদাত আরো বৃদ্ধ হতে থাকে। প্রায় সময় শাহাদাত যন্ত্রণায় বিছানায় কাঁতরান। বৃদ্ধ মানুষের মতো রাতে তার হাত, পা ঠান্ডা হয়ে আসে, শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে যায়; ঘুম হয় না। ছটফট করতে থাকে শাহাদাত। তখন তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না।

শাহাদাতের বাবা মোহাম্মদ হানিফ একজন অটোরিকশা চালক। সামান্য আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। শাহাদাতের বোন ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করেন। তার লেখাপড়ার খরচ যোগাতেও হাঁফিয়ে ওঠতে হয় দিনমজুর বাবাকে। একদিকে একমাত্র ছেলের বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গোনা, অন্যদিকে দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিদারুণ কষ্টে দুর্বিষহ জীবনযাপন। এ যেনো মরার উপর খাঁড়ার ঘা।

শাহাদাতের বাবা মোহাম্মদ হানিফ বলেন, শাহাদাত অসুস্থ হওয়ায় ভাত-তরকারি খেতে পারে না। তার খাবার বলতে শুধুই ফলমূল। কিন্তু বাজারে ফলের যে চড়া দাম, রিকশা চালিয়ে দৈনিক যা রোজগার হয় তা দিয়ে সংসারের জন্য ঠিকমতো চালও কিনতে পারেন না তিনি। কখনো কখনো না খেয়েও থাকতে হয় তাদের। এ অবস্থায় ছেলের জন্য ফলমূল কেনা অনেক দূরহ ব্যাপার। ছেলেকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। একমাত্র সন্তান ৩ বছর পর মারা যাবেন, এটা ভাবতেই তাদের চোখে ঘুম আসে না। চোখের দু’পাতা পানিতে ভিজে যায়। মাঝেমাঝে তারা হতাশায় ভুগেন এই ভেবে যে জীবনে কী এমন পাপ তারা করেছেন যে তাদের ভাগ্যে এমনটা হতে হলো?

শাহাদাত হোসেনকে তাদের বাড়ির পাশের একটি স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলে সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শাহাদাতকে ভর্তি নিতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন এবং তাকে ভর্তি নিলে বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিশুদের সমস্যা হবে বলেও জানান। এমন অভিযোগ করে শাহাদাত হোসেনের মা নাছিমা আক্তার বলেন, প্রধান শিক্ষিকা ভর্তি না নিয়ে তখন বলেছিলেন শাহাদাতকে দেখলে অন্য শিশুরা ভয় পাবে। তাছাড়া তাকে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু মিরসরাইয়ে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় না থাকায় শাহাদাতকে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। কয়েক বছর আগেও একটি মাদ্রাসা তাকে ভর্তি করাতে রাজি হয়নি। শেষমেশ তাদের বাড়ি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরের মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন শাহাদাত হোসেন। বর্তমানে সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে সে। শাহাদাতকে শুরুতেই ভর্তি না করানোয় তাকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করা হয়েছে বলে মনে করেন নাছিমা আক্তার।

শাহাদাত হোসেনকে বিদ্যালয়ে ভর্তি নেওয়া হয়নি কেন জানতে চাইলে নিজামপুর সরকারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাছিমা আক্তার বলেন, শাহাদাত হোসেন প্রতিবন্ধী শিশু। আমাদের বিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থীর চাপ আছে। তাকে আলাদা কেয়ার করার প্রয়োজন আছে। তাই আমরা তাকে ভর্তি নিইনি। যদিও চিকিৎসক জানিয়েছেন, প্রোজেরিয়া আক্রান্ত শিশু প্রতিবন্ধী নন, তাদের মেধা, বুদ্ধি সবকিছু ঠিক থাকে।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন গত সোমবার শাহাদাতের বাড়িতে ছুটে যান। এসময় তাৎক্ষণিক শাহাদাতের আবদার রক্ষায় একটি বাইসাকেল কিনে দেন। তিনি বলেন, শাহাদাতের পরিবার সওজের জায়গায় বসবাস করে। নিজের কোনো বাড়ি-ভিটে নেই। আমি তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে জায়গাসহ নতুন ঘর করে দেব। এক ব্যক্তি শাহাদাতের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। আগামী দু’একদিনের মধ্যে তাকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হবে। এছাড়া তার পড়াশোনার বিষয়ে দেখভাল করবেন মিরসরাই উপজেলা শিক্ষা অফিস। এজন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শাহাদাতের পুষ্টির জন্য সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ফলমূলসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়া হবে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী শাহাদাতের বাবা হানিফকে একটি অটোরিকশা কিনে দেওয়া হবে।

মিরসরাই উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা একেএম ফজলুল হক বলেন, শাহাদাতকে দেখে ও পরিবারের কষ্টের কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো। আমি শাহাদাতের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বলে দিয়েছি তার পড়াশোনায় কোনো ধরনের বিঘ্ন যেনো না ঘটে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জেবিন চৌধুরী বলেন, প্রোজেরিয়া রোগ মূলত জীনগত কারণে হয়। যখন একজন নারীর গর্ভে সন্তান আসে তখন তার সেলগুলো ধীরে ধীরে বড় হয় এবং সেলগুলো ভেঙে যায়। এসব সেল একটি থেকে দুইটি, দুইটি থেকে চারটি করে করে বড় হয়। তখন যাদের বাচ্চা প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাদের সেগুলো একটি বিশেষ প্রোটিনের কারণে মিউটেশন হয় অর্থাৎ এটি স্বাভাবিকে না থেকে একটি অস্বাভাবিক উপাদান তৈরি করে। এই অস্বাভাবিক সেল বা কোষের ভিতরে তখন প্রোজিনের প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যায়, তখন বাচ্চা ধীরে ধীরে বড় হলে এটি প্রকাশ পায়। সাধারণ এক বছর কিংবা দুই বছরের মধ্যে এটি ধরা পড়ে৷ বাচ্চার শরীরের গ্রোথ ও চর্বি কমে যায়। একইসাথে বাচ্চার উচ্চতা ও ওজন বাড়ে না। শরীরের চর্বি কমে যাওয়ার চামড়াগুলো ধীরে ধীরে লুজ হয়ে যায়। অনেকটা বৃদ্ধ বয়সের মতো হয়ে যায়।

এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ রোগের সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা নেই। তবে এ রোগে আক্রান্তের শরীরে পুষ্টি, খাবারের যে সমস্যা, সেগুলোর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের ঝুঁকি আছে কিনা সেগুলো মনিটর করা হয়। অর্থাৎ সাপোর্টিভ চিকিৎসাগুলো দেওয়া হয় যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারেন। এক্ষেত্রে হয়তো দেখা যায় কয়েক বছর বেশিও বাঁচতে পারেন। প্রোজেরিয়া আক্রান্ত শিশুরা সামাজিকভাবে খুব বেশি সংকুচিত হয়ে যায়। যাদের সন্তান আক্রান্ত হয়েছে তারাই জানেন কতটা কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।

আরও পড়ুন