ডেঙ্গু জ্বর নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি

ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ :: বর্ষার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ রাজধানীসহ সারাদেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলছে। ডেঙ্গুজ্বর এক ধরনের ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ। ডেঙ্গুজ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে এবং এই ভাইরাস বাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে হয়ে থাকে। ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গজ্বুরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গুজ্বরের জীবানুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের হয়- ১) ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার ২) হেমোরেজিক ফিভার।

ডেঙ্গুজ্বর কখন হয় : মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়ে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে সাধারণত এই জ্বর হয় না বললেই চলে। শীতে লার্ভা অবস্থায় এই মশা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষার শুরুতে সেগুলো থেকে নতুন করে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশা বিস্তার লাভ করে।

কাদের বেশি হয় : সাধারণত শহর অঞ্চলে, অভিজাত এলাকায়, বড় বড় দালান কোঠায় এর প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই ডেঙ্গুজ্বরও এই এলাকার বাসিন্দাদের বেশি হয়। বস্তিতে বা গ্রামে বসবাসরত লোকজনের ডেঙ্গু কম হয়। ডেঙ্গু ভাইরাস ৪ ধরনের হয়। তাই ডেঙ্গুজ্বরও ৪ বার হতে পারে। তবে যারা আগেও ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে রোগটি হলে সেটি মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়।

ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ: ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমড়, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে, মনে হয় হাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’। জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় শরীর জুড়ে লালচে দানা দেখা যায়। যাকে বলা হয় স্কিন র‌্যাশ, অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমিভাব। এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্রান্তিবোধ করে ও রুচি কমে যায়। সাধারণত ৪ বা ৫ দিনে জ্বর থাকার পর তা এমনিতে চলে যায় বরং কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এর ২ বা ৩ দিন পর আবার জ্বর আসে। একে ‘বাই ফেজিক ফিভার’ বলে।

ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর : এই অবস্থাটা সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরো যে সমস্যাগুলো হয়, সেগুলো হলোÑ শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন-চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাঢ়ি ও দাঁত থেকে, কফের সঙ্গে, রক্ত বমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত পড়তে পারে। নারীদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি হতে পারে। এই রোগের বেলায় অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ডেঙ্গু শক সিনড্রোম : ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরী হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো:-

  • রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া। নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হওয়া।
  • শরীর, হাত-পা ও অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়।
  • প্রস্রাব কমে যায়।
  • হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে।
  • এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

কি কি পরীক্ষা করা উচিত:  আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুজ্বর হলে খুব বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা করার দরকার নেই। জ্বরের ৪ থেকে ৫ দিন পরে সিবিসি এবং প্লাটিনেট করাই যথেষ্ট। এর আগে করলে রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকে এবং অনেকে বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন। প্লাটিনেট কাউন্ট এক লাখের কম হলে ডেঙ্গু ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। প্রয়োজনে বøাড সুগার, লিভারের পরীক্ষাগুলো যেমনÑএসজিপিটি, এসজিওটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি করা যাবে।
আনুষঙ্গিক চিকিৎসা ব্যবস্থা : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়।তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই চলতে হবে। যাতে ডেঙ্গুজনিত কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয়। ডেঙ্গুজ্বরটা আসলে গোলমেলে রোগ, সাধারণত লক্ষণ বুঝেই চিকিৎসা দেয়া হয়। সম্পূর্ণ ভাল না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য ভেজা কাপড় দিয়ে গা মোছাতে হবে।

প্রতিরোধ ব্যবস্থা : ডেঙ্গু প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। স্বচ্ছ পরিস্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে। তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কোটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। যাতে কোন পানি জমে না থাকে। এডিস মশা সাধারণত সকালে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য কোন সময়েও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলায় মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমাতে হবে।

বাচ্চাদের যারা স্কুলে যায়, তাদের হাফ প্যান্ট না পরিয়ে ফুল প্যান্ট পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। বাড়ীর আশেপাশের নর্দমা ও আবদ্ধ জলাশয়ে ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারতে হবে। ঝোপঝাড় পরিস্কার করতে হবে। যা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সবসময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে। যাতে করে কোনো মশা কামড়াতে না পারে।

ডেঙ্গুজ্বরের মশাটি এদেশে আগেও ছিল, এখনো আছে। মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।

জটিল উপসর্গ বা পরিণতি : ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে রক্তের মনোসাইটকে আক্রমন করে থাকে। শরীরের আক্রান্ত মনোসাইট ও লিম্ফোসাইটের মধ্যে এক যুদ্ধ চলে। নিঃসরণ হয় অনেক রকমের কেমিক্যাল মেডিয়েটর ও সাইটোকাইন। তারা কিনা রক্তের উপশিরা সু² জালিকা শিরাকে ছিদ্রময় করে তুলে এবং তাদের পানি নিঃসরণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়, রক্তের পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে লিভার কোষের পচন ধরতে পারে। কিডনিতে প্রদাহ হতে পারে। অস্থিমজ্জায় রক্ত কণিকা তৈরিতে প্রবল ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।

হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান:  চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. স্যামুয়েল হ্যানেম্যানের দুইশত বছর পূর্বের যুগান্তকারী আবিষ্কার ডেঙ্গুজ্বরের প্রচন্ড শক্তিশালী ওষুধ ‘ইউপেটোরিয়াম প্যার্ফোলিয়েটাম’ প্রতিষেধক হিসেবে এবং ডেঙ্গুজ্বরে দীর্ঘকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাছাড়া লক্ষণভেদে ১) একোনাইটন্যাপ ২) বেলেডোনা ৩) জেলসিমিয়াম ৪) ব্রায়োনিয়া ৫) রাসটক্স ৬) রাসভেনিনেটা ৭) পালসেটিলা ৮) আর্সেনিক ৯) কলচিকাম ১০) চায়না উল্লেখযোগ্য। তারপরেও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করা উচিত।

লেখক : ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ, ডি, এইচ, এম, এম (ঢাকা), এম, এ হোমিও চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক।

আরও পড়ুন :

হিট স্ট্রোক প্রতিকারে হোমিওপ্যাথি

আরও পড়ুন