মফস্বল সাংবাদিকরা বঞ্চিত কেন

নিয়ন মতিয়ুল :: একবার কয়েকটি জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের ফাউন্ডার দাবিদার এক সম্পাদকের হাউজে জয়েন করলাম। মফস্বল সম্পাদকের সঙ্গে মিটিংয়ে বসে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সম্পাদক নিজের বেতন ধরেছেন ৩-৪ লাখ টাকা, স্টাফ রিপোর্টার ও ডেস্কে ধরেছেন ১৫-২৫ হাজার টাকা করে আর মফস্বলে ৩০-৩৫ জেলায় মূলো ঝুলিয়ে মাত্র ১০-১৫ জেলায় ‘বেতন’ ধরেছেন মাত্র এক থেকে দেড় হাজার টাকা। নিউজ পাঠাতে একটু দেরি হলেই বেতনের দোহাই দিয়ে চলে হামকি, ধুমকি…।

‘বিশ্বমানের’ আরেক সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মফস্বল প্রতিনিধিরা তো কোনো বেতন পেতেনই না, উল্টো তাদের টাকায় দেওয়া হতো ঢাকা অফিসের বেতন। মফস্বলে চোধ ধাঁধানো প্রোগ্রাম করতেন প্রতিনিধিদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে। নিজের দাপট আর রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সম্পাদক তার কমিশনভিত্তিক প্রতিনিধিদের ‘বিজ্ঞাপন সন্ত্রাসী’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এসব সম্পাদকেরাই সাংবাদিকদের জাতীয় সংগঠনগুলোর ‘মহামাননীয়’ নেতা। সাংবাদিকদের স্বার্থ আদায়ে মরিয়া। নিজের পক্ষের ভোটার বাড়াতে সেসব সংগঠনে তালিকাভুক্ত করেন অচেনা, অপেশাদারদের। এসব প্রভাবশালী সম্পাদকেরা সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বরাদ্দ পেতেন সামনের চেয়ার। বসতেন মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে অবনত মস্তকে।

কদিন আগে সাবেক এক সহকর্মীর সঙ্গে ফোনে আলাপ। নতুন এক ডিজিটাল মিডিয়া প্রজেক্টে কাজ শুরু করেছেন। জানালেন, শুধু বেতন বাবদ মাসিক ব্যয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৫-৭ লাখ টাকা। যার মধ্যে ১৬ শতাংশ ধরা হয়েছে মফস্বল প্রতিনিধিদের জন্য। তবে প্রস্তাব পাসের সময় ব্যবস্থাপনা থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, মফস্বলে কোনো বেতন দেওয়া হবে না। কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করাতে হবে।

শুধু কি বাঘা বাঘা সম্পাদক আর ব্যবস্থাপকরাই মফস্বল সাংবাদিকদের বঞ্চিত করেন, এ তালিকায় আছেন ঢাকা ও মফস্বলের কিছু নীতিহীন সাংবাদিকও। বছর কয়েক আগে একটা বিশাল করপোরেট গ্রুপের নিউজ পোর্টালের দায়িত্ব নিয়ে এমডিকে বললাম, মফস্বলের সব জেলায় বেতন দিতে হবে। তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। মফস্বলের ‘প্রভাবশালী’ পরিচয়ধারী কতিপয় সাংবাদিক তাকে ধারণা দিয়েছেন, ঢাকার বাইরে বেতন দিতে হয় না। বরং তারাই হাউজে টাকা পাঠান।

কোনো আইন বা নীতিমালা করে মফস্বলে বঞ্চিত সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিত করা কি সম্ভব? কারণ, গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারক তথা বাঘা বাঘা সম্পাদকেরাই যদি অপসাংবাদিকতাকে উসকে দেওয়ার পরেও নিজেদের মূলধারার একমাত্র ভরসা মনে করেন, তাহলে গণমাধ্যমের সংস্কার কীভাবে হবে? এসব ব্যাকডেটেড, দলদাস, ব্রিটিশ মস্তিষ্কের অধিকারীদের গণমাধ্যম থেকে বিদায় করতে না পারলে শুধু মফস্বলই নয়, মূলধারার সাংবাদিকতাও নিজ মেরুদণ্ডে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

লেখক : নিয়ন মতিয়ুল, গণমাধ্যমকর্মী, ঢাকা।

আরও পড়ুন :

ভাইয়া, ‘দূর-নীতিকে’ বৈধতা দেওয়া যায় না?

সাংবাদিকতার বারোটা বেজে গেছে!

দেশে ভালো সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকের সংকট

ঘূর্ণিঝড়ে রবীন্দ্রসংগীত, ভুনা খিচুড়ি!

হেডিংয়ের টোপে পাঠক শিকার

সাংবাদিকতা নিয়ে যখন সাংবাদিকতা

গ্রহের জন্য গণমাধ্যম!

অ-রাজনীতিকে ‘মহিমান্বিত’ করছে গণমাধ্যম

ভালো সাংবাদিকতা সংকুচিত!

যেখানেই ঘটনা সেখানেই লাইভ!

অবদমিত কৌতুহল থেকেই ‘গুজব’

গণমাধ্যমের পুঁজি ‘দুর্নিবার কৌতুহল’

টার্গেট হিট, ভাইরাল কন্টেন্ট?

মূলধারায় ‘মাল্টিমিডিয়া’ উন্মাদনা

উদ্বোধনী লিড : কেন কৌতুহল বাড়ায়

সাংবাদিকদের কেন একইসঙ্গে ‘বস্তিজীবন’ আর ‘রাজসিক জীবন?

সংবাদমাধ্যম থেকে ‘রাজমাধ্যম’: গণমাধ্যম আটকে আছে কোথায়

‘টেনশন’ বাড়াচ্ছে নতুন পত্রিকা

আরও পড়ুন