অ-রাজনীতিকে ‘মহিমান্বিত’ করছে গণমাধ্যম

নিয়ন মতিয়ুল :: অফিসে সিনিয়র এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হলো। বললেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা এখনও বিগত শতকে পড়ে আছি। একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনীতির সর্বস্তরে দক্ষতা গড়ে ওঠেনি। বিশেষত, প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গি বা আধুনিক মূল্যবোধ দরকার তার উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি বেশিরভাগ নেতা। স্মৃতিকাতরতায় ভুগতে ভুগতে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামনে এগোনোর শক্তি হারিয়েছেন তারা।

রাজনীতির এসব আলাপ বহুদিন ধরেই ঘরবন্দি। বাইরে আনার সুযোগ বা সামর্থ নেই। কারণ দেশীয় রাজনীতির বাইনারি দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতির উন্মুক্ত আলাপ, আলোচনা আর পর্যালোচনাকে গলাটিপে ধরছে। রাজনীতির লেন্সটাকে এমনভাবে বদলে দেয়া হয়েছে, যা শুধু পক্ষ আর বিপক্ষই নির্ধারণ করতে পারে। সমালোচনা বা আত্মসমালোচনার কোনো সুযোগ নেই। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহযোগী হিসেবে কাজ করছে অতিরাজনীতি কেন্দ্রিক প্রচলিত গণমাধ্যম।

মূলত, একজন রাজনীতিক কখনই বেঁধে দেয়া রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে আসতে পারেন না। সুনির্দিষ্ট আদর্শের লেন্সেই রাজনীতিকে দেখে থাকেন তারা। তা সে আদর্শ যতই সময় অনুপোযোগী, তামাদি, অপরিচ্ছন্ন হোক না কেন। ফলে নেতারা কখনই তাদের অনুন্নত দৃষ্টিভঙ্গি আর অযোগ্যতাকে পরিমাপ করতে পারেন না, চানও না। বরং তারা রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য সামাজিক মূল্যবোধের ওপরই দায় চাপান। আত্মবোধ বা উপলব্ধির ধার ধারেন না।

একবিংশ শতকে প্রথম চতুর্থভাগের শেষে এসে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধাক্কায় সমাজ-রাষ্ট্রের পরিকাঠামো আমূল বদলে যাওয়ার সঙ্গে খাপ খেয়ে নিচ্ছে বৈশ্বিক রাজনীতি, বিশ্বনেতারা। অথচ সেই বদলের সঙ্গী বা সহযাত্রী হওয়ার তাড়না নেই আমাদের রাজনীতিকদের। ফলে রাজনৈতিক আদর্শের নবায়ন না করেই জটিল এক যুগে প্রবেশ করছেন তারা। আর সংকট মোকাবিলায় যেসব রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার করছেন তা শতাব্দি পুরোনো। লেন্সটাকে আরেকটু পুরু করলেই দেখা যাবে শীর্ষ থেকে প্রান্তিক পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ একেবারে অতীতের শৃঙ্খলে বৃত্তবন্দি।

আমাদের রাজনীতি সোনালি অতীতের মোহে বড্ড নস্টালজিক। একবিংশ শতকের উপযোগী করে সমাজ আর প্রজন্ম তৈরিতে তারা যে ‘টুলস’ ব্যবহার করছেন তা অকেজো। নতুন সমৃদ্ধ ইতিহাস তৈরিতেও তা ব্যর্থ। ফলে ভালো মানুষ আর সমাজ তৈরির বদলে প্রদর্শনযোগ্য উন্নয়নেই মনোযোগী হতে হচ্ছে। বিপরীত দিকে, জ্ঞানভিত্তিক সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। যদিও বর্তমানকে আপাতভাবে বিজয়ী দাবি করলেও নীরব ইতিহাসে তা পরাজয় হিসেবেই লেখা থাকছে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক দর্শনও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে চলেছে নীরবে।

এভাবে রাজনীতির যে বাঁকবদল ঘটছে, তা যদি বোধ্যগম্য না হয়, সে অনুযায়ী পথরেখা তৈরি করতে না পারা যায় তাহলে সময় থেকে ছিটকে জাদুঘরে স্থান পেতেই হবে। আমাদের দেশীয় রাজনীতির মুখপাত্র হিসেবে গণমাধ্যমও তার দায়িত্ববোধ থেকে বহুযোজন দূরে সরে গেছে। সময়ের দাবির মুখে অচল, অযোগ্য, অদক্ষ, আদর্শ ও লক্ষ্যহীন রাজনীতিকে মহিমান্বিত করে সমাজকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত গণমাধ্যমের স্বার্থপর, অদূরদর্শী ভূমিকা নতুন প্রজন্মের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকবেই।

লেখক : নিয়ন মতিয়ুল, গণমাধ্যমকর্মী।

লেখকের আরও লেখাঃ

ভালো সাংবাদিকতা সংকুচিত!

যেখানেই ঘটনা সেখানেই লাইভ!

অবদমিত কৌতুহল থেকেই ‘গুজব’

গণমাধ্যমের পুঁজি ‘দুর্নিবার কৌতুহল’

টার্গেট হিট, ভাইরাল কন্টেন্ট?

মূলধারায় ‘মাল্টিমিডিয়া’ উন্মাদনা

উদ্বোধনী লিড : কেন কৌতুহল বাড়ায়

সাংবাদিকদের কেন একইসঙ্গে ‘বস্তিজীবন’ আর ‘রাজসিক জীবন?

সংবাদমাধ্যম থেকে ‘রাজমাধ্যম’: গণমাধ্যম আটকে আছে কোথায়

‘টেনশন’ বাড়াচ্ছে নতুন পত্রিকা

আরও পড়ুন