যেখানেই ঘটনা সেখানেই লাইভ!

নিয়ন মতিয়ুল :: ক’দিন আগে ‘সকালসন্ধ্যা’ নামে বনেদিধারার এক পোর্টালের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে । উত্তরের এক মেধাবী সংবাদকর্মী বিষয়টি নিয়ে লেখার অনুরোধ করায় ‘হ্যাঁ’ সূচক ইঙ্গিত করলাম। পরে ভাবলাম, লিখে কী হয়? অনেকে পণ্ডিতি, অনধিকারচর্চা ভাবেন। কারণ ‘স্পয়েলড’ সোসাইটি বা কমিউনিটি খোঁজে ব্রান্ড। কী লিখলো সেটা নয়, কে লিখলো সেটাই ম্যাটার। আজ হিম শীতের অলস ভোরে হঠাৎ কিছু ভাবনা জাগালো ‘ইন্টারনেট বেইজড’ জার্নালিজম।

মনে পড়লো, প্রায় একযুগ আগে ‘বাংলামেইল’-এর থিম ছিল, ‘যখনই ঘটনা, তখনই ক্লিক’। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই ‘হেডিং’। পরে ইন্ট্রোতে স্থান, কাল, পাত্র। এরপর নিউজের ডেভেলপমেন্ট। কৌতুহলী পাঠক সেঁটে থাকতো পোর্টালে। থরথর উত্তেজনায় ভিউ, স্কোর বেড়ে যেত। তখনই মনে হয়েছিল, বেশি উত্তেজনা অস্বাস্থ্যকর। ‘পারদ’ একবার ঢিলা হয়ে গেলে উঠানো কঠিন। তাই পাঠকের উত্তেজনা স্বাস্থ্যকর মাত্রায় রাখা গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব।

বছর পাঁচেক আগে প্রিন্টমিডিয়ায় ‘সম্ভবত’ প্রথম মাল্টিমিডিয়া শুরু হয়েছিল ভোরের কাগজে। থিম ছিল, ‘যেখানেই ঘটনা, সেখানেই লাইভ’। অর্থাৎ ক্লিক নয়, সরাসরি লাইভের ভিউয়ার শিকার। টিমপ্রধান হিসেবে পরিকল্পনার সব তোড়জোর করেছিলাম লাইভের চমক আর ভিউয়ার টার্গেটে। তবে সেবারও মনে প্রশ্ন, অডিয়েন্স শিকারের এ অভিযান কি স্বাস্থ্যকর?

মাঝখানে কয়েক বছর। এখন মাল্টিমিডিয়া কনটেন্টের সুনামি কাল। সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার কোটি কোটি কনটেন্টের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সেদিন একজন বললেন, অডিয়েন্সের বিশুদ্ধ কৌতুহলও এখন দূষিত; ঢিলাও হয়ে পড়েছে উত্তেজনা। সুপার কোয়ালিটির মূলধারার সব লেখা, নিউজ, ভিউজ- এমনকি অনুসন্ধানী স্টোরিও আর চমকাতে পারছে না। নিরূপায় হয়ে ‍উত্তেজনা বাড়াতে কনটেন্ট ‘পারভার্ট’ করছে সোশ্যালমিডিয়ার সঙ্গে মাল্টিমিডিয়াও।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে র‌্যাংকিংয়ের তোয়াক্কা না করেই ‘বাংলাট্রিবিউন’ বা ‘নিউজবাংলা’র মতো পোর্টালগুলো স্পেশাল, এক্সক্লুসিভ স্টোরির মাধ্যমে অনলাইনের মূলধারা হিসেবে নিজেদের ক্যারেক্টার অক্ষুণ্ণ রাখছে। আবার ‘ঢাকাপ্রকাশ’র মতো তারকাসমৃদ্ধ কোনো পোর্টাল হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়েই হারিয়ে যাচ্ছে। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট করে ভর্তুকির ভারে ভারাক্রান্ত অনেকে টিকে থাকার লড়াই করছে। তবে এর মধ্যেই টেকসইভার্সন হিসেবে কচ্ছপগতির উচ্চমার্গীয় নিউজ পোর্টাল খুলছেন কতিপয় ‘বিদগ্ধ সংবাদশিল্পী’। যারা পাঠকের ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধ ফেরাতে গবেষণাধর্মী লেখা, ইনডেপথ স্টোরি, ফ্রেশ কনটেন্ট দিয়ে অভিয়েন্স মোটিভেট করার মহান উদ্যোগ নিচ্ছেন।

তবে সমালোচকদের নির্মম ভাষ্য হচ্ছে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অর্থ আর অর্থ আয়ের সহায়ক ক্ষমতা-ই সব। এক্ষেত্রে অপশন মাত্র দুটি- হয় বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ ফেরত দিন; নয়তো সংবাদের ক্ষমতায় তাকে ক্ষমতাবান করুন। মাঝামাঝি ঝুলে থাকা মানেই বিলুপ্ত হওয়া। কারণ দিনশেষে নিউজমিডিয়া একটা বিজনেস; কোনো ধর্মগ্রন্থ বা চ্যারিটি নয় যে, নীতিকথা বিলিয়ে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন!

লেখক : নিয়ন মতিয়ুল, গণমাধ্যমকর্মী।

আরও পড়ুন :
অবদমিত কৌতুহল থেকেই ‘গুজব’

গণমাধ্যমের পুঁজি ‘দুর্নিবার কৌতুহল’

টার্গেট হিট, ভাইরাল কন্টেন্ট?

মূলধারায় ‘মাল্টিমিডিয়া’ উন্মাদনা

উদ্বোধনী লিড : কেন কৌতুহল বাড়ায়

সাংবাদিকদের কেন একইসঙ্গে ‘বস্তিজীবন’ আর ‘রাজসিক জীবন?

সংবাদমাধ্যম থেকে ‘রাজমাধ্যম’: গণমাধ্যম আটকে আছে কোথায়

‘টেনশন’ বাড়াচ্ছে নতুন পত্রিকা

আরও পড়ুন