নিয়ন মতিয়ুল:: সকালে ঝড়ো হাওয়ার ‘রিল’ দিয়ে সঙ্গিনী লিখল, ‘জৈষ্ঠে শ্রাবণ ধারা…’, সুর দিল, ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে…’। আমি বৃষ্টি-হাওয়ার দাপটে দক্ষিণের দরজা বন্ধ করে দিলাম।
ফেসবুক খুলতেই দেখি ঝড়ের ছবিতে এক ছোটবোনের অনুভূতি, ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা..। স্ক্রল করতেই এক সহকর্মীর রিলের ঘনমেঘ-বৃষ্টির অসাধারণ দৃশ্যে সুর, ‘কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না…’।
অদ্ভুত এক নস্টালজিক সুর, তন্দ্রাচ্ছন্নতার হাতছানি। ভাবি, আমরা কি ঘূর্ণিঝড়ে খুঁজছি সুর, ছন্দ, অতীতের সুখানুভূতি, ফেলে আসা স্মৃতি? ডুবে যেতে চাই কি রবীন্দ্রজগতের মোহচ্ছন্নতায়? বড্ড অবাক লাগছে!
একুশ শতকের দুই যুগ কাটল। ষড়ঋতু সেই কবেই বিদায় নিয়েছে। কবেই হারিয়েছি জীববৈচিত্রের ঐতিহ্য। হারিয়ে গেছে বর্ণ, গন্ধ, সৌন্দর্য, মানবিকবোধ। হারিয়ে যাচ্ছে রবী, নজরুল, জীবনানন্দের কবিতার উপযোগিতা। বর্তমান বাস্তবতাকে আর রাঙাতে পারে না ষাট-সত্তর দশকের গানের মোহ।
সভ্যতার নির্মমতায় দানব হয়ে উঠেছে চিরচেনা প্রকৃতি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হিংস্র হয়ে ওঠা প্রকৃতি সভ্যতাকে যেন উৎখাত করতে চাচ্ছে। খেলার পুতুল আমরাও হারাচ্ছি মানবতাবোধ। কদিন আগে প্রতিবেশী দেশে এক মাননীয় সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ড হার মানিয়েছে সব পাশবিকতাকে। হতভম্ভ হয়ে পড়েছে গোটা দেশ।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে থাকা গোয়েন্দাপ্রধানের বিস্ময়কর উপলব্ধি, ‘সভ্য সমাজে এত নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড হতে পারে না।’ আসলেই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হয়েও যারা সীমাহীন ক্ষমতা ব্যবহার করে সম্পদের কেওক্রাডং বা হিমালয় গড়ে তোলেন তাদের সঙ্গে সভ্যতা, সংস্কৃতি যায় না। মেলে না বরীন্দ্রসংগীত, নজরুল গীতি কিংবা জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে।
কিন্তু কি আশ্চর্য, বিরূপ আচরণের ঘূর্ণিঝড় রেমালে যখন অর্ধকোটির বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, ডজনখানেক প্রাণহানি, কোটি কোটি মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ তখন রাজধানীর ঘরে ঘরে ভুনা খিচুড়ির তীব্র ঘ্রাণ। এক তারকা সাংবাদিকের পোস্টে দেখলাম, বৃষ্টিবিলাসের দারুণ এক রোমান্টিক কবিতা।
বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন এই আমদের নেই কোনো বর্তমান। নেই নিজস্বতা। আধুনিক জটিল, কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজিত হওয়ার কোনো সুর, সংগীত, কবিতা নেই আমাদের। ভাষাহীনতা কুরে কুরে খায়। তাই হাতড়ে বেড়াই, চলে যাই অতীতে, রবী ঠাকুরে, নজরুলে, জীবনানন্দে কিংবা ষাট-সত্তর দশকের সোনালি দিনের গানে। মহাবিপদেও আমরা সেলফিবাজি করি, বর্ষার রোমান্টিক কবিতায় ভাব প্রকাশ করি।
পুনশ্চ: সকালে সঙ্গিনী ফেবু রিলে ‘শ্রাবণের ধারার’ যে সুর দিয়েছিল তা নাকি তার ছাদবাগানের গাছদের আনন্দে সঙ্গি হতে। আর রাতে যে ‘ভুনা খিচুড়ি’ করছে তা নাকি ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিয়ে ভিজে আসা তরুণ পূরপ্রকৌশলী ছেলেটির জন্য। শুনে চুপসে গেলাম।
লেখক: নিয়ন মতিয়ুল, গণমাধ্যমকর্মী।
আরও পড়ুন ::
হেডিংয়ের টোপে পাঠক শিকার
সাংবাদিকতা নিয়ে যখন সাংবাদিকতা
অ-রাজনীতিকে ‘মহিমান্বিত’ করছে গণমাধ্যম
গণমাধ্যমের পুঁজি ‘দুর্নিবার কৌতুহল’
মূলধারায় ‘মাল্টিমিডিয়া’ উন্মাদনা
উদ্বোধনী লিড : কেন কৌতুহল বাড়ায়
সাংবাদিকদের কেন একইসঙ্গে ‘বস্তিজীবন’ আর ‘রাজসিক জীবন?