নিয়ন মতিয়ুল :: ক’দিন আগে আমার পোস্ট ‘সাংবাদিকতার বারোটা বেজে গেছে!’ পড়ে অনার্স পড়ুয়া একজন ইনবক্সে জানতে চাইলেন, “কী জব করেন আপনি?” বললাম, “ফেসবুকে কতদিন?” জানালেন, ১২ বছর। বললাম, “প্রোফাইলে সব তথ্য আছে, দেখেননি?” বললেন, “যদি একটা জব দেন উপকৃত হবো? সাংবাদিকতা আমার পছন্দ।”
আমি তাকে “যে কারণে মেধাবীরা সাংবাদিকতা ছাড়ছেন” শিরোনামে তথ্যবহুল এক লেখার লিংক দিয়ে বললাম, “নতুনদের আমি সাংবাদিকতায় আসতে বলি না। বরং বাধা দেই।” এ কথায় ছাত্রটি বললেন, “কেন বাধা দেন, বলা যাবে?” প্রচণ্ড বিরক্ত লাগল। এ যেন, “সপ্তকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ” আর “ইশারায় পণ্ডিত বোঝে, বোকা বোঝে কিলে” অবস্থা। শঙ্কা জাগল, এই ছেলে সাংবাদিকতায় এলে কতটা বাজাবেন!
২.
বছর দেড়েক একটি রাজনৈতিক দলের বিট করেছি। একবার ক্রিটিক্যাল এক ইস্যুতে দলীয়প্রধানের জরুরি সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে সামনে বসলাম। লিখিত বক্তব্য শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে সরব হলেন রিপোর্টাররা। কয়েকটি প্রশ্নের পরে দেখলাম, ইস্যু বাউন্স করছে। মোড় ঘুরানোর প্রশ্ন করতে গিয়ে দেখলাম রিপোর্টারদের হিরোইজম শুরু। অবশেষে হৈ হট্টোগোলে মাইক বন্ধ করে উঠে গেলেন দলীয়প্রধান।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যদি জানাশোনা, পড়ালেখা না থাকে, ইস্যুর গতিপ্রকৃতি, প্রাসঙ্গিকতার সুদূরপ্রসারী প্রভাব যদি বুঝতে না পারা যায়, তাহলে প্রশ্নগুলো স্টুপিড হয়ে ওঠে। তখন প্রশ্নের মেরিট নয়, রিপোর্টারদের উঁচু গলাটাই চাউর হয়। ক্রমাগত এমন প্রবণতায় মগজ বাদ রেখে পেশীতে ভর দিয়েই শুরু হয় রিপোর্টারদের হিরোইজম। কখনও কখনও সিনিয়ররাই এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেন জুনিয়রদের।
অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় কিনা, সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের পর মেঘের কাছে তথ্য চাওয়া, অভিনেত্রী ময়ুরীর মেয়ে তার মায়ের সিনেমা দেখেছে কিনা, অভিনেত্রী সীমানার মৃত্যুতে তার ছেলের প্রতিক্রিয়া জানা কিংবা ভালো ইংরেজি না জেনে বিদেশিদের দুর্বোধ্য প্রশ্ন করা- নিশ্চিতভাবেই ভালো সাংবাদিকতা নয়। সংবাদমাধ্যমের সাপ্তাহিক মিটিংগুলোতে এসব নিয়ে কি আলোচনা হয় না?
৩.
গণমাধ্যমের প্রধান চরিত্র হলো জনগণের হয়ে ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিমূলক জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রশ্ন ছুঁড়ে উত্তর আদায় করা। এক্ষেত্রে যে কোনো প্রশ্ন করতেই পারেন সাংবাদিকরা। তবে উত্তরদাতার কাছ থেকে কীভাবে উত্তর বের করে আনবেন, তা নির্ভর করে কীভাবে, কোন কৌশলে প্রশ্নটা করছেন। প্রশ্ন করার ভাষা আর স্টাইলের ওপরেই নির্ভর করে আপনি কতটা দক্ষ, যোগ্য, বিচক্ষণ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কতটা জানেন। সাংবাদিকতার পরিচয়টাই বড় নয়, আপনার ব্যক্তিগত জ্ঞান, সুশিক্ষা, যোগ্যতা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
সমস্যাটা হচ্ছে, সাংবাদিকতা এখন রাজনৈতিক ‘বাইনারি’ দৃষ্টিভঙ্গির কাঁটাতারে আটকে গেছে। হয় পক্ষ, নয়তো প্রতিপক্ষ। হয় ডান, নয়তো বাম। হয় ক্ষমতাসীন, নয়তো বিরোধীদল…। সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে সামনে রেখে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রমোটার মূলত রাজনৈতিক দলগুলো। ফলে হরিজন্টাল-ভার্টিক্যাল লেন্সের বাইরে বার্ডস আই বা ড্রোন লেন্স এখন উপেক্ষিত। প্রশ্নকর্তাদের নির্মোহ প্রশ্নগুলো তাই বাইনারি লেন্সে উত্তরদাতাদের ক্ষুব্ধ করে, আগ্রাসী করে।
লেখক : নিয়ন মতিয়ুল, গণমাধ্যমকর্মী।
আরও পড়ুন :
সাংবাদিকতার বারোটা বেজে গেছে!
দেশে ভালো সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকের সংকট
ঘূর্ণিঝড়ে রবীন্দ্রসংগীত, ভুনা খিচুড়ি!
সাংবাদিকতা নিয়ে যখন সাংবাদিকতা
অ-রাজনীতিকে ‘মহিমান্বিত’ করছে গণমাধ্যম
গণমাধ্যমের পুঁজি ‘দুর্নিবার কৌতুহল’
মূলধারায় ‘মাল্টিমিডিয়া’ উন্মাদনা
উদ্বোধনী লিড : কেন কৌতুহল বাড়ায়
সাংবাদিকদের কেন একইসঙ্গে ‘বস্তিজীবন’ আর ‘রাজসিক জীবন?