বাঁশখালীতে পুকুরে ডুবে পাঁচ মাসে ৩৪ শিশুর মৃত্যু
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে। প্রতি বছরই এই ঘটনায় শিশুর মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হলেও এ হার কমিয়ে আনতে কোনো উদ্যোগ নেই, নেই কোনো পদক্ষেপ কিংবা গণসচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবকরা সচেতন না হলে এই হার কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।
চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে ১০ জুন পর্যন্ত পাঁচ মাসে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালের পরিসংখ্যান রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু পানিতে ডুবে ৩৪ জন শিশু মারা গেছে।
বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ১৪ জন শিশু পুকুরে ডুবে মারা যায়। বেসরকারি হাসপাতাল গুনাগরি মা-শিশু জেনারেল হাসপাতালের সিইও মো. খোরশেদ আলম জানান, চলতি বছরের ১০ জুন পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালের পরিসংখ্যান রিপোর্টে পুকুরে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা (স্পটডেট) ১৩ জন, চাম্বল জেনারেল হাসপাতালের ম্যানেজার আব্দুর রহিম জানান, এ পর্যন্ত আমাদের এখানে পুকুরে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা (স্পটডেট) ৩ জন, বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে অন্তত ১০ থেকে ১২ জন। জলদী আধুনিক হাসপাতালের ম্যানেজার মান্নান বলেন, এ পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালে পুকুরে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা (স্পটডেট) ৪ জন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৫ এপ্রিল শীলকুপ ইউনিয়নের মাইজপাড়া ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাবিয়া বাপের বাড়ীর রিয়াজ উদ্দিনের কন্যা মারিয়া আক্তার (৫) ও আবু ছালেকের কন্যা ওয়াজিফা (৫) উঠোনে খেলতে গিয়ে একইদিনে পুকুরে ডুবে মারা যায়। ১৪ এপ্রিল শেখেরখীল ইউনিয়নের সরকার বাজার ২ নম্বর ওয়ার্ডের পেঠান মিয়াজী পাড়ার বাকপ্রতিবন্ধি মো. ইউসুফের পুত্র সন্তান আইয়ুব মিয়া (২) ও পৌরসভার উত্তর জলদি বাহার উল্লাহ পাড়ার মাওলানা আবুল কাশেমের ১ বছর বয়সী শিশু আয়েশা পুকুরে ডুবে মারা যায়। ১৫ এপ্রিল ছনুয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মো. ইসহাকের আড়াই বছর বয়সী ছেলে মো. ইসমাইল সবার অগোচরে পুকুরে ডুবে মারা যায়। ২০ মে দুপুরে আলী রেজা মোহাম্মদ আবরার (৭) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়। সে উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ছাপাছড়ি সমদ চৌধুরী বাড়ির নুরুল আবচারের ছেলে। ২২ মে পৃথক স্থানে পুকুরে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া শিশুরা হলো উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আল মামুন ফয়সালের কন্যা রোমাইসা জান্নাত (২) ও বাঁশখালী পৌরসভার উত্তর জলদী ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নেয়াজর পাড়া এলাকার আবু হামিদের ছেলে মেহাম্মদ আবির (৩)।
তাছাড়া, পুকুরে গোসল করতে গিয়ে ৩ জুন পুইছড়ি ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব-পুইছড়ি সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ হাবিবের সন্তান তানভির হোসাইদ (১২) এবং ৭ জুন শুক্রবার পুঁইছড়ি ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব পুইঁছড়ির গিয়াস উদ্দিনের কন্যা আফিয়া জন্নাত (২) ও একই দিনে শেখেরখীল ইউনিয়নের মামুনুর রশীদের কন্যা মিফতাহুল জান্নাত মাঈশা (৭) পুকুরে ডুবে মারা যায়। সর্বশেষ গত রোববার ৯ জুন দুপুরে খানখানাবাদের দিঘীর পাড়ার কায়চার উদ্দিনের কন্যা শিশু কলি আক্তার (৩) পুকুরে ডুবে মারা যান।
পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করা বাঁশখালী টাইমস সম্পাদক আবু ওবাইদা আরাফাত বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করছি যে, বাঁশখালীতে প্রতিনিয়ত আশঙ্কাজনক হারে পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত দুই বছর আগে সালমা আদিল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার রোধের উপায়’ শীর্ষক মাসব্যাপী বাঁশখালী জুড়ে ক্যাম্পেইন করেছি। আমাদের এ ক্যাম্পেইনে বাঁশখালীর ডজন খানেক সামাজিক সংগঠন একসাথে কাজ করেছিল। বাচ্চাদের বিষয়ে আমাদের সচেতনতার বিকল্প নাই।
বাঁশখালী আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক, গুনাগরি মা-শিশু জেনারেল হাসপাতালের চেয়ারম্যান এ্যডভোকেট মো. আবু নাছের বলেন, ‘আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বেশি হলেও পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে প্রথমত আমাদের মায়েদের নজরদারি প্রয়োজন। সকাল বেলার টাইমে পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। ওই সময়ে মায়েরা কাজে ব্যস্থ থাকেন। তখন তারা শিশুদের তদারকিতে না থাকার কারণে পানিতে ডুবে মৃত্যু হচ্ছে বেশি। তাই শিশুদের নজরদারিতে রাখতেই হবে।’ তাছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশে শিশু বয়স থেকেই সাঁতার শেখানো হলেও বাংলাদেশে এই পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা সামাজিকভাবে নেওয়া হয়না। ফলে সাঁতার না জানার কারণেও পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।’
বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ বলেন, ‘বাঁশখালীতে পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যু হার বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে আমাদের মা-বাবাদের বিশেষ করে মায়েদের অসচেতনতাই কম দায়ী নয়। পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যুর হার রোধে বাড়ির পাশের পুকুরের চারপাশে বাউন্ডারি বা ফেন্সিং করা জরুরী। সবসময় শিশুদের আগলে রাখতে হবে। পুকুরে পড়ার সাথে সাথে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ করলে যথাযথ চিকিৎসা পাবে। সর্বোপরি আমাদের সকলের সচেতনতার কোন বিকল্প নাই।’
তাছাড়া, ‘কোথাও বেড়াতে গেলে নিজ সস্তানদের প্রতি অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে। তাহলেই পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমিয়ে আসতে পারে বলেও জানান তিনি।’