ইকবাল কবির, ঢাকা ব্যুরো চীফ :: ৩০ মে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর ৩৬তম মৃত্যু বার্ষিকী। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে গভীর রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে বিপথগামী কিছু সামরিক কর্মকর্তার এক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন। জেনারেল জিয়ার জানাজায় বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহত্তম জনসমাগম ঘটে।বাংলাদেশের রাজনীতির এ ক্যারিশম্যাটিক লিডারের নিহত হওয়ার দিন সেখানে ছিলেন পুলিশের এক জোয়ান নায়েক সারোয়ার। সেদিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরতে সিটিজি সংবাদ২৪.কম এর ঢাকা ব্যুরো প্রধান ইকবাল কবির মুখোমুখি হয়েছিলেন নায়েক সারোয়ারের। নায়েক সারোয়ারের জবানীতে ওঠে আসা সে লোমহর্ষক ঘটনার স্মৃতিচারণ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রথম প্রহরের পর পরই ২০/৩০ জনের একটি সেনাদল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে প্রবেশ করেন। জোয়ানরা সেনা বাহিনীর পোষাক পড়া থাকলেও তাদের কারো নামফলক ব্যাজ ছিলো না। অধিকাংশের পায়ে ছিলো সাধারন কেড্স, হাতে একে ৪৭, সাব মেশিন গান ও ওজি। গেটে পুলিশ সদস্যরা তাদের প্রবেশে আপত্তি করতেই গুলী করে হত্যা করা হয় দুলাল নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে, এরপর অন্য পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলী করে মূহুর্তেই সিড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে যান সৈনিকরা। গুলির শব্দ পেয়ে ২য় তলার ২নং (সম্ভবত) কক্ষে থাকা তৎকালীন দেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রুম থেকে বের হয়ে আসেন। তারই নিরাপত্তায় থাকা কর্ণেল মাহফুজের কাছে গোলাগুলি’র কারণ জানতে চেয়ে মাহফুজের হাতে থাকা অস্ত্রটি তিনি চাইলেই তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এ সময় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে দুই পক্ষের গোলাগুলি হয়। জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরপরই কর্ণেল মাহ্ফুজ ও ক্যাপ্টেন জামিল ওয়াকি টকিতে বারবার কারো সঙ্গে কথা বলছিলেন। সব ঘটনাই ঘটে গেল আধ থেকে পৌনে একঘন্টা সময়ের মধ্যে। নিঃস্তব্দ হয়ে গেল গোটা সার্কিট হাউজ। সেই রাতে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল । ভোরের আলো ফোটার আগেই কর্ণেল মাহ্ফুজের নেতৃত্বে সৈনিকরা ত্রিপল দিয়ে জিয়ার লাশটি পেঁচিয়ে সেনাবাহিনীর ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। বীরমুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার স্বাধীনতার ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার বিবরণটি এভাবেই বর্ণনা করছিলেন, ওই রাতে সার্কিট হাউজে ডিউটিতে থাকা পুলিশের নায়েক মোঃ সারোয়ার হোসেন।
ঢাকায় সিটিজি সংবাদের কাছে প্রথমবারের মতো ভয়াবহ সেই রাতের বিবরণ দিতে গিয়ে সারোয়ার হোসেন বলেন, মহান আল্লাহ নতুন জীবন দান করেছেন বলেই আজও দুঃসহ স্মৃতিবহন করে বেড়াচ্ছি। কারণ চোখের সামনে একজন মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রনায়ককে মরতে দেখলাম, বাঁচাতে পারলাম না। বেঁচে যাওয়ার বিবরণ দিয়ে সারোয়ার জানান রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার ৩দিন পূর্বেই আমাদের (পুলিশ)কে নিরাপত্তা মহড়ায় অংশ নিতে হয়। নিরাপত্তা মহড়ায় থাকা কালেই রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় থাকা কর্ণেল মাহ্ফুজ ও ক্যাপ্টেন জামিলকে চিনি। ঘটনার মধ্যরাতে কর্ণেল মাহ্ফুজ ও ক্যাপ্টেন জামিল ২০/৩০ জন সেনাকে নিয়ে সার্কিট হাউজের ২য় তলায় প্রবেশ করতে চায় কারো ব্যাজ না থাকা পায়ে সাধারন কেডস থাকা ও সৈনিকদের হাতে আধুনিক ভারী অস্ত্র থাকায় আমরা বাঁধা দিতেই গুলি করে দুলাল নামে এক কনস্টেবলকে হত্যা করে (আমাকে সহ) আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করলে আমাদের পাশ দিয়ে গুলি চলে যায় । আমরা মাটিতে লুটিয়ে পরলে আমাদের মৃত ভেবে ওরা ২য় তলায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কক্ষে চলে যায়। আমি সিঁড়ির নীচে ময়লার স্তুপের ভেতর শুয়ে দোতলার কাঠের সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে সব ঘটনা দেখি। আমার সহকর্মী মনু সার্কিট হাউজের একটি রুমে আশ্রয় নেয়। সারোয়ার জানান সব কিছুই যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো। একি দেখছি, দেশের একজন রাষ্ট্রনায়কের এভাবেই মূহুর্তের মধ্যেই শহীদ হয়ে গেলেন। সারোয়ার হোসেন বলেন, ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে এসপি সালাম স্যার ও ডিআইজি শরীফ স্যারকে সার্কিট হাউজে প্রবেশ করতে দেখে তাদের ঘটনাটি জানাই। তারা আমাকে দুলালের লাশসহ দামাপাড়া পুলিশ লাইনে পাঠিয়ে দেন।
এর পূর্বে আমরা সার্কিট হাউজে দ্বায়িত্ব পালনকালে চট্টগ্রাম ডিভিশনের জিওসি বীরমুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরকে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। জেনারেল মঞ্জুর নাকি জিয়াউর রহমানকে তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা অবহিত করেছিলেন এমনটিই শুনেছি। কিন্তু অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা জিয়া মঞ্জুরের কথায় কর্ণপাত করেননি। জেনারেল মঞ্জুর এসবির এসি সাত্তার সাহেবকে ও প্রেসিডেন্ট এর নিরাপত্তার ব্যাপারে তার শঙ্কার বিষয়টি অবহিত করেছিলেন বলে শুনেছি। সারোয়ার হোসেন কোন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বা সমর্থক না হলেও তিনি জানান, শুধু জিয়া হত্যাকান্ডই নয়, সেই দিন জিয়ার হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে বহু মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে কোর্ট মার্শাল করে ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো। সিভিল কোর্টে আজো জিয়া হত্যার বিচার হয়নি। জিয়া হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে আরেকজন মেধাবী মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছিলো। মঞ্জুর হত্যার বিচার আজও ঝুলে আছে। মঞ্জুরের খুনিরা জিয়ার আসল খুনী বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
সারোয়ার হোসেন বলেন, মঞ্জুর হত্যার বিচার হলেই জিয়ার আসল খুনীর চেহারা দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হয়ে যাবে। তাই জিয়াকে হত্যার পর যারা দেশে রাজনৈতিকভাবে ও রাষ্ট্র পরিচালনায় লাভবান হয়েছিলেন তারাই আজ মিলে মিশে নৌকার যাত্রী ও মাঝি মাল্লা। মঞ্জুর হত্যার মামলা ঝুলিয়ে রেখে একটি মহল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করছেন।
সারোয়ার হোসেন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, দেশের জনগন এখন অনেক সচেতন। আদালতের রায় বিলম্বিত হলেও দেশের পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোর বদৌলতে মানুষের বুঝতে বাকী নেই। জিয়াকে কারা হত্যা করে আজ জিয়া পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করছেন তখনকার খুনী ও তাদের দোসররা। জাতি একদিন এর বিচার করবে বলেই সারোয়ার হোসেন বিশ্বাস করেন