পুঁথিসাহিত্যের প্রত্নতত্ত্ববিদ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ : ১৮৭১-১৯৫৩

কবি আইউব সৈয়দ :: বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণের অন্যতম পথিকৃৎ-পুরুষ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে পিতৃবিয়োগের তিন মাস পরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুন্শী নূরউদ্দিন মা মিসরীজান। ১১ বছর বয়সে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে চাচাতো বোন বদিউন্নিসাকে বিয়ে করেন। সুচক্রদণ্ডী গ্রামে শুরু হয় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা। পটিয়ার ইংলিশ স্কুল থেকে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। এফ.এ. পড়ার জন্য চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েও সন্নিপাত রোগের কারণে পরীক্ষা দিতে না পারায় উচ্চশিক্ষার  পাঠও চুকে যায়। জীবনের জন্য তাঁকে বিচিত্র পেশায় নিয়োজিত থাকতে হয়েছিল। তবে শিক্ষকতাকে অগ্রগণ্য বিবেচনা করেন। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর তিনি সীতাকুণ্ড মধ্য ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অস্থায়ী পদে যোগদান করেন। পরে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের প্রথম সাব-জজ আদালতে করণিক পদে চাকরি করতে থাকেন। এসময় কবি নবীনচন্দ্র সেনের সহযোগিতায় ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসে কমিশনারের পার্সোন্যাল এসিস্ট্যান্ট হয়ে আসেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়ে চাকরিচ্যুত হন। এরপর ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্তি লাভ করেন। আবারও চাকরি বদল করে ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্কুল অফিসে কেরানির পদে চাকরি করার পর ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্র“য়ারি ঐ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর-জীবনে সাহিত্যসেবা ছাড়াও জনকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং পটিয়া আঞ্চলিক ঋণসালিশি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আজীবন সাহিত্য অনুরাগী আবদুল করিম সাহিত্যবিশরাদ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি (১৯১৯), কলকাতা মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি (১৯৩৯), চট্টগ্রাম সংস্কৃতি সম্মেলনের সভাপতি (১৯৫১) এবং কুমিল্লা সংস্কৃতি সম্মেলনের সভাপতি (১৯৫২) ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স ও বি.এ. পরীক্ষার বাংলার পরীক্ষক  এবং ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  বাংলা অর্নাসের প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক ছিলেন। তিনি কোহিনূর, নবনূর, সওগাত এবং সাধনা পত্রিকার অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রথম মুসলিম পুঁথি সংগ্রাহক যিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ঊর্ধ্বে থেকে পুঁথি সংগ্রহ ও সংকলন করেছিলেন। তাঁর সংগৃহীত পুুঁথির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এর মধ্য প্রায় একহাজার পুঁথি বাঙালি মুসলমানের রচনা। তার সংগৃহীত মুসলিম রচিত ৫৯৭টি পুঁথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হিন্দু রচিত ৪৫০টি পুঁথি রাজশাহী বরেন্দ্র  রিসার্চ মিউজিয়ামে দান করেন। উল্লেখ্য যে, সতেরো শতকের কবি আলাওলের পদ্মাবতী ও অন্যান্য কাব্যের পুঁথি উদ্ধার, পুথিঁ পরিচিতিসহ তথ্যসমৃদ্ধ বহু প্রবন্ধ তাঁর সাহিত্য গবেষণায় সর্বশ্রেষ্ঠ হীরকদ্যুতি হিসেবে বিবেচিত। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি ৯টি পুঁথি সম্পাদনা করেন। এগুলি পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এ পুঁথিগুলো হলো : নরোত্তম ঠাকুরের রাধিকার মানভঙ্গ (১৩০৮), কবিবল্লভের সত্যনারায়ণের পুঁথি (১৩২২), দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৩২২), রামরাজার মৃগলুব্ধ সংবাদ (১৩২২), দ্বিজমাধবের গঙ্গামঙ্গল (১৩২৩), আলী রাজার জ্ঞানসাগর (১৩২৪), বাসুদেব ঘোষের স্ত্রী গোরাঙ্গ সন্ন্যাস (১৩২৪), মুক্ত রামসেনের সারদামঙ্গল (১৩২৪), এবং শেখ ফয়জুল্লাহর গোরক্ষবিজয় (১৩২৪)। পুঁথি সংগ্রহ এবং সম্পাদনা ছাড়াও নানামুখী চিন্তা-চেতনামূলক তাঁর প্রায় ৪১২টির মতো মৌলিক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ইসলামাবাদ (চট্টগ্রামের চিত্র ইতিহাস) এবং আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য (মুহম্মদ এনামুল হকের সঙ্গে যৌথভাবে) তাঁর দু’টি মৌলিক গদ্যগ্রন্থ। তাঁর অসাধারণ সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ চট্টল ধর্মমন্ডলী ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যবিশারদ এবং নদীয়া সাহিত্যসভা ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যসাগর উপাধি প্রদান করে। গবেষণাকর্মে অবদান রাখায় ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করে। এই ঐতিহ্যপ্রেমী অগ্রপথিক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ সেপ্টেম্বরে নিজ গ্রামের বাড়িতে শেষনিঃশেষ ত্যাগ করেন। পরে মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। তাঁর জীবন ও কর্ম সর্ম্পকে প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি ফরহাদ খান ও সৈয়দুর রহমান সম্পাদিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিবেদিত প্রবন্ধ সংকলন (১৯৯৪), ইসরাইল খান সম্পাদিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ অভিভাষণসমগ্র (২০১০),আহমদ শরীফ রচিত আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ জীবনী গ্রন্থ’ (২০০২) এবং আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ রচনাবলী( ২০১৩) প্রকাশ করে।

সম্পাদনায় : কবি আইউব সৈয়দ, উপদেষ্টা সম্পাদক, সিটিজি সংবাদ.কম।

আরও পড়ুন