কবি আইউব সৈয়দ :: উনিশ শতকের নব জাগরণের যুগে ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ফেব্র“য়ারি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামে যুগপথিক কবি নবীনচন্দ্র সেন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গোপীমোহন রায় এবং মায়ের নাম রাজরাজেশ্বরী। গোপীমোহন রায় ছিলেন চট্টগ্রাম জজকোর্টের পেশকার। নবীনচন্দ্র সেন ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. এবং স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ. পাস করেন। এফ.এ. পরীক্ষার একমাস আগে অর্থাৎ ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে দশ বছর বয়সী লক্ষ্মীকামিনী দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। কর্মজীবনের প্রথমে কলকাতার হেয়ার স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সাথে সরকারি চাকরি করে ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে কবি নবীনচন্দ্র সেন চট্টগ্রামে বিভাগীয় কমিশনারের পার্সোন্যাল এসিস্ট্যান্ট পদে বদলি হয়ে আসেন। সে সময় চট্টগ্রাম শহরের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভূত উন্নতি সহ ফেনী সাবডিভিশনকে একটি পূর্ণাঙ্গ শহরে প্রতিষ্ঠিত করেন। ছাত্রাবস্থায় প্যারীচরণ সরকার সম্পাদিত এডুকেশন গেজেট পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘কোন এক বিধবা বাসিনীর প্রতি’ তাঁকে কবিখ্যাত দেয়। পরে এই কবিতাটি দেশপ্রেম ও আত্মচিন্তামূলক কবিতা সংকলন অবকাশরঞ্জনী-তে সংকলিত হয়। এটি তাঁর প্রথম গ্রন্থ, যা ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পলাশীর যুদ্ধ (১৮৭৫) কবি নবীনচন্দ্র সেনকে বাংলার কাব্যজগতে স্থায়ী আসন এনে দেয়। তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থ হলো: আখ্যান কাব্য রঙ্গমতী (১৮৮০), মার্কণ্ডের চণ্ডী (১৮৮৯), পদ্যানুবাদ শ্রীমদ্ভগবদগীতা (১৮৮৯), ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রবাসের পত্র (১৮৯২), প্রবাস (১৮৯৬), নাটিকা শুভ নির্ম্মাল্য (১৯০০), উপন্যাস ভানুমতি (১৯০৪), আত্মজীবনী আমার জীবন। কবি নবীনচন্দ্র সেনের আত্মচরিত্র আমার জীবন পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়। প্রথম ভাগের প্রকাশ লেখক জীবদ্দশায় দেখে গেছেন। পরের খণ্ডাগুলো বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক সজনীকান্ত দাশের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটি এদেশে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের প্রামাণিক দলিল হিসেবে বিবেচ্য। এছাড়া তিনি যিশুখৃষ্টের জীবনকাহিনি অবলম্বনে খৃষ্ট, বুদ্ধদেবের জীবনচরিত অবলম্বনে অমিতাভ (১৮৯৫), শ্রীচৈতন্য জীবন অবলম্বনে জীবনীকাব্য অমৃতাভ প্রকাশের পাশাপাশি ত্রয়ীকাব্য নামে পরিচিত বৈরতক (১৮৮৭), কুরুক্ষেত্র (১৮৯৩), প্রভাস (১৮৯৬) রচনা করেন। নবীনচন্দ্র সেন অপরূপ বর্ণনা শক্তির অধিকারী। অসংযত উদ্দাম ও ভাবোন্মাদনা তাঁর কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মহৎ ও মহত্ত্বের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। সেকালের বঙ্গদর্শন, মালঞ্চ, নব্যভারত, ভারতবর্ষ, প্রবাসী ইত্যাদি পত্রিকাতে কবি নবীনচন্দ্র সেনের বাইশটির মতো রচনা প্রকাশিত হয়েছে। অবসর জীবনের একটি অংশ কবিপুত্র ব্যারিস্টার নির্মলচন্দ্র সেনের কর্মস্থল রেঙ্গুনে থাকেন। সেখানেই তিনি আত্মজীবন কাহিনি আমার জীবন রচনা করেন। তবে একথা নিশ্চিত যে, জীবনের শেষ দিনগুলো কর্মযজ্ঞেই ইতিহাসের স্থায়ী আসন অধিকারী যুগপথিক কবি নবীনচন্দ্র সেন নিজ গ্রামেই অতিবাহিত করে ৬৩ বছর বয়সে ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা একাডেমি ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মোবারক হোসেন রচিত নবীনচন্দ্র সেন জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করে। পুঁথিসাহিত্যের প্রত্নততত্ত্ববিদ।
সম্পাদনায় : কবি আইউব সৈয়দ, উপদেষ্টা সম্পাদক, সিটিজি সংবাদ.কম।