কবি আইউব সৈয়দ :: বিনীত বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব, সত্যনিষ্ঠ জ্ঞানসাধক স্বনির্মিত ব্যক্তি, স্থানিক ইতিহাস রচিয়তা আবদুল হক চৌধুরী চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াজিশপুর গ্রামে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ আগস্ট শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলহাজ্ব সরফুদ্দীন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন রেঙ্গুন পোর্ট কমিশনের দ্বিতীয় প্রকৌশলী। তাঁর মায়ের নাম মোমেনা খাতুন চৌধুরী। ঐতিহ্যসন্ধানী গবেষক আবদুুল হক চৌধুরী বংশপরিচয়ের দিক থেকে চন্দ্রাবতী কাব্যের রচিয়তা মধ্যযুগের কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের সপ্তম অধস্তন পুরুষ। নিজ গ্রামের নতুনহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। পরে ডাবুয়া মধ্য ইংরেজি স্কুলে দুবছর অধ্যায়ন শেষে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে রাউজান আর. আর. এ. সি. ইনস্টিটিউশনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে বাবার মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার ইতি ঘটে। পরে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাবার প্রতিষ্ঠিত নোয়াজিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাসিক পনেরো টাকা বেতনে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। এই সময় জুবাইদা বানুর সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষকতা ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। এর আগে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সান্নিধ্যে এসে তাঁর উপদেশ মতো ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ ও পড়াশোনায় ব্রতী হন। তাঁর বয়স প্রায় পঞ্চাশ তখন তিনি দীর্ঘদিনের সংগৃহীত তথ্য, উপকরণ নানাভাবে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার পর ব্যবসা ছেড়ে পুরোদমে গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করেন। আবদুল হক চৌধুরী চট্টগ্রামের সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইতিহাসকে সাধনায় এবং আত্মœত্যাগে বিলুপ্তির অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে এসে, সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। চট্টগ্রাম ইতিহাস প্রসঙ্গ (১৯৭৬), চট্টগ্রামের চরিতাভিধান (১৯৮০), চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি (১৯৮০), সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ (১৯৮১), শহর চট্টগ্রামের ইতিকথা (১৯৮৫), চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা (১৯৮৮), চট্টগ্রামের আরাকান (১৯৮৯), চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ (১৯৯২), প্রাচীন আরাকান, রোহিঙ্গা, হিন্দু ও বড়–য়া, বৌদ্ধ অধিবাসী (১৯৯৪), বন্দর শহর চট্টগ্রাম (১৯৯৪) প্রবন্ধবিচিত্রা : ইতিহাস ও সাহিত্য (১৯৯৫) প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। তাঁর রচিত, চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ এবং চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি বই দুইটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহায়ক গ্রন্থ হিসাবে পাঠ্যক্রমভুক্ত। চট্টগ্রামের রাউজান অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুল হক চৌধুরী ১৯৭১-এ নদীর মতো নিজেই নিজের পথ করে নিয়েছেন। কারো হাত ধরে জীবন ও সাহিত্যের সাফল্যের শিখরে পৌঁছাননি- যা কিছু করেছেন তা তার নিজস্ব উদ্যমে নিজস্ব পরিশ্রমে, আপন প্রত্যয়ের অবিচলতায় ও অদ্যম অধ্যবসায়। ফলে চট্টগ্রাম সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য চট্টলতত্ত্ববিদ উপাধি লাভ করেন। পাশাপাশি নতুন চন্দ্র সিংহ স্মৃতি পদক ১৯৮৪, চট্টগ্রাম গ্র“প থিয়েটার পদক ১৯৮৬, এক্স-ক্যাডেট এসোসিয়েশন পদক ১৯৮৭, চট্টগ্রাম সম্মিলিত ১ বৈশাখ উদযাপন পরিষদ পদক ১৯৯৪, অনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পদক ১৯৯৮, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ পদক ১৯৯৮, মহান একুশে সম্মাননা পদক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২০০১, হিলালী স্মৃতি স্বর্ণপদক ২০০৬, চট্টগ্রাম সমিতি ঢাকা সম্মাননা পদক ২০০৩ এ ভূষিত হন। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার দেশ পত্রিকায় সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ চট্টগ্রামের লৌকিক জন্য তাঁকে মহাফেজ খানা উপাধি দিয়েছেন। তাছাড়া অনেক সংগঠন থেকে সংবর্র্ধিত হন। এর বাইরেও তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের, কুণ্ডেশ্বরী কলেজের গভর্নিং বডির, বাংলাদেশ ফোকলোর সোসাইটির, যোগেশচন্দ্র সিংহ স্মারকগ্রন্থের সদস্য ছিলেন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে সাপ্তাহিক চলতি দিন পত্রিকার প্রকাশকও ছিলেন। উল্লেখ্য যে জীবদ্দশায় পত্রিকাটি তাঁর পুত্র মনজুর-উল-আমিন চৌধুরী’র সম্পাদনায় ৪৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। কক্সবাজার ফাউন্ডেশন কর্তৃক ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত কক্সবাজারের ইতিহাস, গ্রন্থের অন্যতম প্রণেতা যেমন ছিলেন তেমনি নোয়াজিশপুর প্রাইমারী স্কুুলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানও ছিলেন। অতীতের রহস্য-সন্ধানী ইতিহাসের অনুরাগী পাঠক চট্টলতত্ত্ববিদ আবদুল হক চৌধুরীকে গবেষণা কর্মের জন্য বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে। ইতিহাসের সংরক্ষক ও ইতিহাসের বরপুত্র আবদুল হক চৌধুরী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৬ অক্টোবর ১৯৯৪, বুধবার, রাত সোয়া সাতটায় ৭২ বছর বয়সে ইহজগতের মায়া ছেড়ে পরলোকগমন করেন। গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তার জীবন, কর্ম ও গবেষণা সংক্রান্ত গ্রন্থ হলো : ডক্টর আবদুল করিম সম্পাদিত আবদুল হক চৌধুরী রচনাবলী এবং আবদুল হক চৌধুরী ও তার গবেষণা কর্ম (১৯৯৮)। তাছাড়া ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত মুহম্মদ মজিরউদ্দিন মিয়া এবং তসিকুল ইসলাম সম্পাদিত আবদুল হক চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ। অন্যদিকে চট্টগ্রাম থেকে অমিত চৌধুরী সম্পাদিত গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর কর্মকৃতি মূল্যায়ণ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে।
সম্পাদনায় : আইউব সৈয়দ, উপদেষ্টা সম্পাদক, সিটিজি সংবাদ.কম