এসি আকরামের জবানবন্দিঃ পুরান ঢাকার এক মূর্তিমান আতংকের নাম গালকাটা কামাল

প্রথম প্রকাশ : ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ইং

এসি আকরাম হোসাইন ৭০দশকের শেষ সময়ে পুরান ঢাকার তৎকালীন লালবাগ থানায় প্রথমে এসআই ও পরে ওসি হিসেবে আশির দশকে অপরাধী নির্মূলে দূর্দান্ত সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চেলের অপরাধী পাকড়াওয়ে। আগেও বলেছি ভাল কাজে তিনি কোন সীমারেখায় সীমাবদ্ধে বিশ্বাসী ছিলেন না। যখনই কোন অপরাধী বা সন্ত্রাসীর খবর পেয়েছেন তার অবস্থান বাংলাদেশের যে স্থানেই হোক না কেন, তাকে তিনি গ্রেফতার করে নিয়ে আসতেন। বঙ্গবন্ধুর খুনী মোশতাক সরকারের পতনের পর জিয়ার শাসনামলে বহুদলীয় গনতন্ত্রের চর্চা শুরু হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো ঘর থেকে বের হতে শুরু করে। সন্ত্রাসীরা নিজেদের বাঁচাতে সুবিধাজনক রাজনৈতিক দল খুঁজতে শুরু করেন।

পুরান ঢাকার তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজে তখনও আওয়ামী ছাত্রলীগেরই প্রভাব ছিলো। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নতুন দর্শনে রাজনৈতিক দল করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। শুরু হয় দেশের রাজনীতিতে বহুদলীয় গনতন্ত্রের যাত্রা। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় গণতান্ত্রিক দল সংক্ষেপে জাগদল।

জাগদলেই সরকারের ছায়ার প্রত্যাশায় ডান, বাম, মধ্যপন্থী সব রাজনৈতিকদলের নেতারা লাইন ধরেন নিজেদের অস্থিত্ব রক্ষায়। অন্য সবার মতোই পুরান ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্র আবুল হাসনাত কামাল নাম লেখান বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের জাগদলে। আবুল হাসনাত ওরফে কামাল এরই মধ্যে ফরিদপুরের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম হত্যাকান্ডের অভিযুক্ত হওয়ায় ফরিদপুর থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলেন।

তৎকালীন জগন্নাথ কলেজর আরেক ছাত্রনেতা আব্দুল হালিমের হাত ধরে কামাল পুরান ঢাকায় সন্ত্রাসের জগতে নতুন আঙ্গিকে কর্মকাণ্ড শুরু করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ সাল। একবছরেই জাগদলের নানা কর্মকাণ্ডে জিয়াউর রহমান বিরক্ত হন। এরই মাঝে কামাল জাগদলের যুব সংগঠন জাগযুব দলের সূত্রাপুর থানার সভাপতি পদ বাগিয়ে নেন। ঢাকার উত্তরে মিরপুর আর পশ্চিমে পুরান ঢাকার বহু সন্ত্রাসী নাম লেখায় জাগযুব দলে। কামাল ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন পুরান ঢাকার ভয়ংকর এক সন্ত্রাসী। জিয়াউর রহমান জাগদলের এমন কর্মকান্ডে অসন্তোষ হন। ফলে ১৯৭৮ সালের ২৮ আগষ্ট আব্দুস সাত্তার জাগদল বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।

১৯৭৮ সালের ১সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান ১৯দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন রমনা রেস্তোরাঁয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। যার ফলে জাগদলের সঙ্গে থাকা প্রায় সবাই বিএনপি”র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পরেন। পিছপা হননি পুরান ঢাকার সন্ত্রাসী কামালও। তিনিও বিএনপির ছায়া সংগঠন যুবদলের সূত্রাপুর থানার সভাপতির পদটি জাগযুব দলের মতো ধরে রাখতে সক্ষম হন। তাই কামাল দিন দিন হয়ে উঠছিলেন বেপরোয়া। একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তিনি পুরান ঢাকার অপরাধ সম্রাটে পরিনত হন।

সময়টা ছিলো সত্তুদশকের শেষ সময়। সোহরাওয়ার্দী কলেজের ভিপি দিলা ও জিএস মোখলেসকে পিছনে ফেলে নিজের খুনখারাবির রাজত্ব কায়েম করেন কামাল। এর মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে এক আড্ডায় মামুন সেভেন আপের বোতল ভেঙ্গে তার গালে আঘাত করলে তার গাল কেটে যায়। এরপরই পুরান ঢাকায় তার টাইটেল হয় গালকাটা কামাল। ফরিদপুর থেকে প্রতিশোধ পরান হয়ে ঢাকায় ঠাই পাওয়া গালকাটা কামাল খুন করেন তারই দুই বন্ধু সূত্রাপুরের ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক রানা ও ফিরোজ আলম মামুনকে। জোড়া খুনের এই মামলায় কামাল ছিলেন ৯নাম্বার আসামী। অন্যতম আসামী ছিলেন মহিউদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টু, আবুল কাশেম মানিক ও শহীদ হোসেন।ঝন্টু সুইডেনে পালিয়ে গেলেও মন্টু ও শহীদ গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। কিন্তু গালকাটা কামাল অধরাই থেকে একের পর এক অপরাধ করতে থাকেন।

এ সময় তৎকালীন যুবদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা কামালকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করলে কামাল হয়ে উঠেন ভাড়াটে খুনী। কামাল টিকাটুলির অভয়দাস লেনের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন। সেই সঙ্গে সূত্রাপুর থানা যুবদলের সভাপতি। পুরান ঢাকায় অনুসন্ধানে গালকাটা কামালের এই খ্যাতির পেছনের কারনটিও বের হয়ে আসে। সোহরাওয়ার্দী কলেজে তখন ছাত্রলীগের একছত্র প্রাধান্য। ৭৮-৭৯ সালের কথা।জাগছাত্র দল সেখানে কোন অবস্থান নিতে পারছিলেন না। কলেজের প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম থাকতেন বংশালে। মালিটোলার জাগদল নেতা সাঈদ একজনকে পরামর্শ দিলেন কাটা দিয়েই কাটা তুলতে হবে। তাই সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রিন্সিপালের সহায়তায় দিলা-মোখলেসকে ভর্তি করানো হলো সোহরাওয়ার্দী কলেজে। দিলদার বাড়িটির নাম ছিলো “জামদানী ভিলা ” তাই কলেজে দেলোয়ার হোসেন দিলা জামদানী দিলা নামেই পরিচিত হয়ে উঠেন। কলেজের ভিপি হন দিলা আর জিএস হন মোখলেস। সোহরায়ার্দী কলেজের দিলা-মোখলেস জুটি সদরঘাট, লালকুঠি, ফরাশগঞ্জ,বাবুবাজার ও নয়াবাজারসহ পুরান ঢাকার ত্রাস হয়ে উঠেন। চাঁদাবাজি, বিচার সালিশ, ঘাট দখল টেন্ডারবাজি সবই চলে যায় দিলা-মোখলেস জুটির কথায়। পুরান ঢাকার এই অপরাধ সাম্রাজের একক শাসক হতে আঘাত হানেন দিলা-মোখলেসের দূর্গে।

গালকাটা কামালের দোর্দণ্ড প্রতাপে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না দিলা-মোখলেস জুটি। কামালের পৃষ্ঠপোষক যুবদলের ওই কেন্দ্রীয় নেতা (বর্তমানে জাপার এমপি)র সঙ্গে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সুসম্পর্ক থাকায় কামাল তাকে ব্যবহার করেন। দিলা-মোখলেসসহ তার দলবলকে ধরিয়ে দিয়ে নিজের একক প্রাধান্য গড়ে তোলেন। মিরপুর, মোহাম্মদপুর থেকে ঢাকার মতিঝিল, টিকাটুলি গোপীবাগ, সূত্রাপুর, নয়াবাজার, সদরঘাটসহ পুরো এলাকায় এক মূর্তিমান আতংকের নাম হয়ে উঠেন গাল কাটা কামাল। প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে মানুষ খুন করা যেন গালকাটা কামালের নেশা হয়ে গিয়েছিলো। সূত্রাপুরে তারই দুই ব্যবসায়ী বন্ধু রানা ও মামুন খুনের পর কামাল আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় কামাল অপরাধ জগতের দানব হয়ে উঠেন। নয়াপল্টনে খুন, গোপীবাগে খুন, গুলিস্তানে খুন, জগন্নাথ কলেজ খুন একের পর এক খুন করে পুরান ঢাকায় জনমনে আতংক তৈরী ও ব্যবসায়ীরা ভয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন মোবাইলের যুগ ছিলো না,শ্বশরীরে এসে হুমকি দিয়ে অস্ত্র প্রদর্শন করে টাকা চাইতো।গালকাটা কামালকে ব্যবহার করে আজ অনেকেই নেতা,এমপি হয়েছেন।
গালকাটা কামালের স্ত্রী হয়েছেন বিধবা, সন্তান হয়েছেন এতিম। ঢাকার ভয়ংকর এই আলোচিত খুনি গালকাটা কামাল গ্রেফতারের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের কাহিনী পরের পর্বে।

আরও পড়ুন