এসি আকরামের জবানবন্দিঃ আইজিপির অধীনস্থ কর্মকর্তা হলেও মূলত আমরা পাবলিক সার্ভেন্ট

প্রথম প্রকাশ : ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ইং

রুবেল হত্যার কয়েক মাস আগের কথা। ডিপার্টমেন্টাল প্রধানের অন্যায় ও অনৈতিক নির্দেশ পালন না করায় আমার বিরুদ্ধে ৩/৪ মাস আগে থেকেই ষড়যন্ত্রের জাল বুনা শুরু হয়েছিলো। ডিপার্টমেন্টাল ষড়যন্ত্র যে কত ভয়ানক তা আমি বুঝতে পেরেছি। একজন কর্মকর্তা বা কর্মজীবীর সারাজীবনের অর্জিত সকল সফলতাকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। সেই সঙ্গে পারিবারিক-সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন করে একটি পরিবারে মহাবিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। আমি নিজেই ছিলাম তার বাস্তব উদাহরণ। ষড়যন্ত্রের জালে আমাকে মিথ্যা খুনের কলংক মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর জেলে কাটাতে হয়েছে। আমার পরিবারের সদস্যরা যেমন আমার আদর-ভালবাসা স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তেমনি তাদের সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন এবং ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ষড়যন্ত্রের জাল বুননকারীরা কি পারবে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে? ওরা কি পারবে আমার চাকরি জীবনের কলংক মুছে সোনালী অতিত ফিরিয়ে দিতে?

এসি আকরাম হোসাইন চাকরির জীবনে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কারণ বর্ননা করলেন এভাবেই। চাকুরী জীবনের শেষ প্রান্তে চূড়ান্ত সফলতাকে পদদলিত করে বিশাল শক্তিশালী চুড়ান্ত ষড়যন্ত্রের অল্প ক’দিন আগের ঘটনা। দুই দূর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে সেভেন এম.এম. রাইফেল, একানব্বই রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করি। যথাযথ নিয়মে মামলা রুজু করে আদালতে প্রেরণ করে আসামিদের পুলিশ রিমান্ডে আনা হয়। আসামিদের একজন ছিলো ওই সময়ের প্রচন্ড ক্ষমতাধর উচ্চপদস্থ এক আমলার বখে যাওয়া সন্তান। সঙ্গত কারণেই ডিবি অফিসে সাংবাদিকদের আনাগোনা ছিলো একটু বেশি। সকাল আনুমানিক ১০টা। কয়েকজন সাংবাদিকের অনুরোধে আসামিদের আমার অফিস কক্ষে এনে কথা বলার সুযোগ করে দেই। আচমকা দুইজন মধ্যে বয়সী আমার কক্ষে প্রবেশ করে। পরিবেশ পরিস্থিতির কোন তোয়াক্কা না করেই একজন বলেন আমি সাদা বিড়ালের চাচা (প্রধান আসামির কাল্পনিক নাম), “আই.জি. সাব আমাকে পাঠিয়েছে”। শুনে, আমার তো কান গরম, সাংবাদিকদের ও কান খাড়া। পরিস্থিতি সামলাতে বললাম, আপনারা বসুন, ওনারা সাংবাদিক, ওনাদের সাথে কথা শেষ করে আপনাদের সাথে কথা বলব। এসময় সাংবাদিকরা তাদের নানা প্রশ্ন করতে শুরু করায়, তারা কোন রকমে সটকে পড়েন। সাংবাদিকদের টার্গেট তখন আমি। একটাই প্রশ্ন, এই জঘন্য আসামীর চাচাকে আইজি পাঠাল কেন?

তারা সিদ্ধান্ত নিল বিষয়টি তারা পত্রিকায় লিখবে। আমি তাদের বললাম, কোথাকার কোন টাউট বাটপার কি বলল,যাচাই না করে লেখা কি ঠিক হবে? ওনাদের মধ্যে এক ভাই সবাইকে অনুরোধ করে বললেন, লেখাই উচিৎ তবে, আকরাম সাহেব রোষানলে পড়বেন। লোক দুজন চলে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পরই অফিসের ফোন বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে আইজিপি সাহেবের ষ্টাফ অফিসার জানালেন, আমার ডাক পড়েছে। তখনও সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে এই ডাকের কোন যোগসূত্র থাকার কোন চিন্তাই আমার মাথায় ছিল না। উপস্থিত সবাইকে জরুরী কাজের কথা বলে পুলিশ সদর দপ্তরে যাই। এখানে একটি কথা বলে রাখি, অপরাধ দমন, আটক, বিশেষ করে সরকার ঘোষিত টপটেররদের একচেটিয়া দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে আটক করায় সকল মহলেই আকাশ ছোয়া সম্মান আর ভালবাসার অবস্থান হয়েছিলো আমার। হয়তোবা সে জন্যই সবত্রই অগ্রাধিকার ছিল, সবাই আমার সময়ের মূল্য দিত।কিন্তু এই প্রথম ব্যতয় ঘটল। আমার গমন সংবাদ আইজিপি,মহোদয়কে দিয়ে খুবই গোমরা মুখে ফিরে ষ্টাফ অফিসার বললেন, বসতে হবে। ধাক্কা খেলাম, কিন্ত বসতেই হল। আমার জন্য বিষয়টি ছিল অভাবনীয় । এসময়ে অন্য একটি আলোচিত অভিযানের বিষয় আমার মাথাচাড়া দিচ্ছিল। পুরো চল্লিশ মিনিট পরে বললাম, তাহলে পরে আসি। ষ্টাফ অফিসার কিছুটা বিব্রতভাবে, শুনে আসি বলে উঠে গেলেন। অল্প সময়েই ফিরে বললেন, স্যারের রুমে যান। আমি রুমে ঢুকে কয়েক কদম এগিয়ে টেবিলের এ পাশের একটি চেয়ারে বসলাম। ততোক্ষণ তিনি টেবিলে থাকা কাগজের প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন। হঠাৎ ই বললেন, “আপনি নাকি অনেক বড় অফিসার হয়ে গেছেন? আপনি বলেছেন, আপনি আইজিপি’র চাকুরী করেন না।” আমি কিন্ত যেকোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুুত ছিলাম। জবাব দিলাম, সরি স্যার,আপনি বিভাগীয় প্রধান, আপনার চেয়ে বড় অফিসার হওয়ার সুযোগ এ বিভাগে আপনার বর্তমানে কারোর নেই। আমি আইজিপি’র চাকুরী করিনা কিন্তু তার অধিনস্থ কর্মকর্তা। আমরা সবাই Public servent.সাংবাদিকদের উপস্থিতি এবং কথিত দুই ব্যাক্তির প্রসঙ্গ টানতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ছেলেটাকে আপনি ছাড়বেন কিনা? আমিও স্বভাব সুলভভাবে বললাম, ছাড়ব না, ছাড়ার কোন সুযোগও নাই। কারণ তাকে রিমান্ড আনা হয়েছে, আপনিও ওকে ছাড়তে পারবেন না। তিনি আরো উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমি যদি বলি? খুব নরম সুরে বললাম তবুও না স্যার। মানুষ উত্তেজিত হলে অস্বাভাবিক আচরণ করে। তাই ওনাকে বাস্তবতায় ফিরাতে বললাম, আপনি যদি আমাকে লিখিত নির্দেশ দেন তাহলে চেষ্টা করব। এবার স্যার অস্বাভাবিকভাবে গলা ছড়িয়ে বললেন, You go, I will see you.মোটেই বিচলিত হইনি কারণ এরি মধ্যে বহুবার এসব দেখেছিলাম। বিনয়ের সাথে বলে আসলাম, Sir please, don’t consider me, as your personal servant.

গাড়ীতে বসে, ড্রাইভারকে অফিসে যাওয়ার কথা বলার পর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। অঝোরে চোখের জল পড়ছিল, কোন ভয়ে নয়, একেবারেই অচেনা এমন আচরণের জন্য । তাছাড়া নিজে কিছু সহকর্মী নিয়ে পুলিশ বাহিনীর জন্য যে সুনাম অর্জনে অবদান রেখেছিলাম তার অপ্রত্যাশিত বদলা ভেবে। চল্লিশ বয়সের যে সকল সম্মানিত নগর বাসী, সরকারি কর্মচারি, কর্মকর্তাগন, আশি ও নব্বই শতকের লোম হর্ষক খুন, ডাকাতি, চরম সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং প্রতিকার দেখেছেন, সংবাদপত্র পড়েছেন, নিশ্চয়ই প্রত্যক্ষও করেছেন ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার জনগণ পুলিশকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া শুরু করেছিলো। পুলিশের ভালো কাজ জনসাধারণকে অনেক বেশি আপ্লুত করে। যার কিছু নমুনা বর্তমান করোনা ভাইরাসের সময় সবাই দেখেছেন। আগের প্রায় সব পুলিশ প্রধানদের কাছে যে সম্মান, স্নেহ পেয়েছি তাই মনে হয়ে নিজেকে সামলাতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। তাছাড়া চাকুরী জীবনে প্রথম কোন অফিসার সরাসরি এমন অবহেলা দেখাল। যদিও কাজে ও নামে অনেক এগিয়ে থাকায়, অনেকেই ভীষণ প্রতিহিংসা পোষন করত।মৃত্যুর আগে এভাবে অব্যক্ত কিছু দুঃসাহসিক কর্মকান্ডের জবানবন্দি এই প্রতিবেদককে দিয়ে গেলাম।

আরও পড়ুন