এসি আকরামের জবানবন্দিঃ দুর্ধর্ষ খুনি গালকাটা কামাল গ্রেফতারের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনি

প্রথম প্রকাশ : ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ইং

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ৮১”র নভেম্বরে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশের মানুষ সাত্তার সরকারের শাসনামল প্রবেশ করেন। বয়োবৃদ্ধ এই বিচারপতি দেশ শাসনে কঠোর হতে পারছিলেন না। সর্বস্তরেই মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে দূর্নীতি,সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়সহ ঢাকা যেন অপরাধীদের অভয়াশ্রমে পরিনত হয়ে উঠছিলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন খ্যাতিমান চক্ষু চিকিৎসক সিরাজগন্জের ডাঃ এমএ মতিন। যিনি চক্ষু মতিন নামেই পরিচিত ছিলেন। বিএনপি”র বর্তমান স্হায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বোন জামাই এই ডাঃ মতিন।

আইজিপি ছিলেন এবিএমজি কিবরিয়া। পুলিশের এরই মধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে থেকেই পুলিশকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা আসে। খুন, লাশ গুম, জবাই, মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার আর বিভিন্ন গ্রুপের গোলাগুলি যেন নিত্যদিনের ঘটনা। এই সন্ত্রাসীদের পেছনে তৎকালীন সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের নাম আলোচনায় উঠে আসছিলো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে। বয়োজেষ্ঠ সাত্তার সরকারও অসহায় হয়ে পরেছিলেন। লালবাগ থানার ওসি আকরাম হোসাইনের কাছে সংবাদ আসলো পুরান ঢাকার অভয় দাস লেন, টিকাটুলি ও নবাবপুর এলাকার অন্ততঃ তিন যুবক নিখোঁজ। মাত্র সপ্তাহের ব্যবধানে তিন যুবক নিখোঁজের বিষয়টি পুরান ঢাকার অপরাধী আটকে অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তা আকরাম হোসাইন গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধানে নামেন। হ্যাঁ, সব তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেলো এই সব অপরাধের পেছনে একজনেরই নাম চলে আসছে তিনি হলেন গালকাটা কামাল। আর এই গালকাটা কামালের প্রশ্রয়-আশ্রয়স্থল ক্ষমতাসীন বিএনপির নয়াপল্টন অফিস এবং তার পাশেই তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি”র সহযেগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় এক যুবদল নেতার ম্যানপাওয়ার অফিস (বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য)। কামালের সন্ত্রাসের শক্তি মূলত এই নেতা।

কামালের গতিবিধি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিনেমা পাড়ায় তার যাতায়াত রয়েছে। চলচ্চিত্র পরিচালক ফজলুর রশিদ ঢালির সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। কারণ কামাল সঙ্গিত শিল্পীও। তাই ক্ষমতাসীন দলের কোন নেতার অফিস নয়, তাকে সিনেমা পাড়া থেকে আটক করতে হবে। সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা আকরাম হোসাইন ছক কষতে শুরু করলেন কিভাবে দূর্ধর্ষ গালকাটা কামালকে আটক করা যায়।দেখা করলেন, পরিচালক ফজলুর রশিদ ঢালির সঙ্গে তার মোহাম্মদপুরের বাসায়। গালকাটা কামাল তার গাড়িতে চলাচল করে এবং তার সঙ্গেই থাকেন। তাই তাকে গ্রেফতারের ঢালির সহযোগিতা চান আকরাম হোসাইন। প্রথমে ঢালি রাজি হননি। পরে আকরাম হোসাইন জানান, আমিতো জেনেই গেছি এই কুখ্যাত খুনি আপনার সঙ্গি। তাই আমি তাকে যেকোন মূল্যে ধরবোই। আর আপনি সহযোগিতা করলে একটু সহজ হবে এবং আপনিও সেফ হলেন। এবার ফজলুর রশিদ ঢালি রাজি হলেন। আকরাম হোসাইন তাকে ধরার ছক কষে (প্রোগ্রাম) দিলেন কিভাবে তাকে আটক করবেন। ঢালিকে একটিই কাজ দিলেন।তৎকালে মোবাইল বা মোবাইল ট্রাকিং সিষ্টেম ছিলো না, যে অপরাধীর অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়। তাই সোর্সের তথ্য, বিশ্বাস, অপরাধীর গতিবিধি অনুসরণ ও অপরাধীকে চিনতে পারার উপরই আটকের সফলতা নির্ভর করতো।

১৯৮২ সাল।শীতের সকাল। শীতকালটা গ্রামেগন্জে বা আউটডোর শ্যুটিং এর সময়কাল। আকরাম হোসাইনের কাছে তথ্য আছে ১০ জানুয়ারি “রসের বাঈদানি” ছবির শুটিং হবে মানিকগঞ্জে। সকাল থেকেই আকরাম হোসাইন তার টিম নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আগের দিন অপারেশনের স্পটটি ভাল করে পরিদর্শন করেছেন।আসামী হাত ছাড়া বা পালানোর সুযোগ আছে কিনা। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী চিত্রপরিচালক ফজলুর রশিদ ঢালিকে একটি কাজই দেয়া হয়েছিলো। তিনি এমনভাবে গাড়ি ড্রাইভ করবেন যাতে মহাখালী রেলক্রসিং এর সিগনালে তার গাড়িটি থেমে যায়।

ভোরে সোনালী সূর্য যখন ঢাকার পিচঢালা কালো পথকে আলোকিত করছে তখন পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইন ক্ষুধার্ত বাঘের মতো মহাখালীর সিগনাল পয়েন্ট শিকারের অপেক্ষা করছিলেন। গালকাটা কামাল গ্রেপ্তার অভিযানে সার্জেন্ট ইব্রাহিমের নামটিও চলে আসে। ওইদিন মহাখালী পুলিশ বক্সের চার শতগজ দক্ষিণে যেদিক থেকে কাংখিত সে গাড়ি আসার কথা সিভিল কাপড়ে সার্জেন্ট ইব্রাহিমকে সেখানে বাইকসহ অপেক্ষ্যমান রাখা হয়েছিল। তাকে পার হয়ে গাড়িটি আসতে থাকলে পিছন থেকে সে গাড়িটি ফলো করবে। বহুল কাংখিত প্রাইভেট কারটি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সার্জেন্ট ইব্রাহিম গাড়িটি অনুসরন করতে শুরু করলো। আকরাম হোসাইনের টিমের সবার মাঝেই উত্তেজনা বিরাজ করছে। মূহুর্তেই মানুষ খেকো এক দানবের মুখোমুখি হচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে শিকারীর থাবার, কিন্তু এ কি? চালকের সিটে যে ঢালি নেই, তবে কি ভুল গাড়ি? না নাম্বার প্লেট তো তা বলছে না। ইব্রাহিম তো সঠিক গাড়িটি ফলো করেছে। এটিতো চিত্রপরিচালকেরই গাড়ি। প্রত্যাশিত সিগনালে এসেও থামলো। আকরাম হোসাইন দলবল নিয়ে গাড়িটির নিকট যেতেই স্টিয়ারিং বসা যুবক বিদ্যুৎ গতিতে গাড়িটি ঘুড়িয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকার দিকে পালাতে লাগলেন,আর বুঝতে বাকি নেই মানব শিকারী দানবটি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন। পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইন এক লাফে নিজের গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করলেন।সার্জেন্ট ইব্রাহিম আকরাম হোসাইনের দ্বিতীয় সঙ্গী হিসেবে ছুটলেন পিছু পিছু।এ যেন সিনেমার শ্যুটিং দৃশ্যায়িত হচ্ছে, ঝড়ের বেগে দুটি গাড়ি ছুটে চলছে নির্জন রাস্তায় অনেকটা কার রেসিংয়ের প্রতিযোগিতার মতো। পেছনে পেছনে ছুটছে বাইক, পুলিশের গাড়ি। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ঢুকে এক পর্যায়ে একটি বাইলেনে ঢুকে রাস্তা শেষ, পালানোর পথ নেই। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমেই দেয়াল টপকে একটি ফ্যাক্টরিতে ঢুকে গেলেন চালকের আসনে থাকা যুবকটি।আকরাম হোসাইন দেয়াল টপকে তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলেন। গাড়ি রেসিং এর পর এবার হার্ডেল দৌড়। একটা পর একটা দেয়াল টপকাচ্ছেন। এ ভাবেই ১২/১৪ টি ফ্যাক্টরির দেয়াল টপকানোর একপর্যায়ে বেলবেটম প্যান্ট হাইহিলের জুতা পায়ে ক্লান্ত যুবক পড়ে যান মাটিতে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঝাপটে ধরে হাত করা পরিয়ে দেন পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইন। ততক্ষণে তাকে অনুসরণ করে সহকর্মী সাদা পোষাকের পুলিশের দলটিও পৌছে গেছে ঘটনাস্থলে। পরিসমাপ্তি ঘটলো শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের।হ্যা তিনিই সেই বহুল আলোচিত গালকাটা কামাল। পুরো নাম মোহাম্মদ আবুল হাসনাত কামাল।গাড়িতে তুলে নিয়ে আসা হয় লালবাগ থানায়।

আরও পড়ুন