এসি আকরামের জবানবন্দিঃ ঢাকার অপরাধ জগতের ত্রিরত্নের কথা
প্রথম প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২১ইং
সত্তুর দশকের মাঝামাঝি সময় হতে ৯০ দশকের শেষ পর্যন্ত এসি আকরাম হোসাইন ছিলেন অপরাধী গ্রেফতারে এক অপ্রতিরোধ্য পুলিশ অফিসার। ৭০ দশকের মাঝামাঝি লালবাগ থানায় এসআই থাকাকালীন সময় থেকেই তিনি শুধু ঢাকা নয়, দেশের যেকোন এলাকা থেকেই অপরাধীদের গ্রেফতার করে নিয়ে আসতেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বা ওই এলাকার থানা পুলিশকে না জানিয়ে। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন ভাল কাজের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। এরপর পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ পরিদর্শক হওয়ার কয়েক বছর পরই আবার লালবাগ থানায় ওসি হিসেবে যোগদান করেছিলেন।
আশির দশকের প্রথম দিকে লালবাগ থানায় ওসি থাকাকালীন সময়েই তিনি বিএনপির সাত্তার সরকারের শাসনামলে মিন্টু রোডের মন্ত্রীর বাসা থেকে খুনী ইমদু, মহাখালি থেকে গালকাটা কামাল, আজিমপুরের নিউপল্টন থেকে মন্টু, লিয়াকত, যুবলীগ নেতা হান্নানসহ বহু চিহ্নিত অপরাধীকে গ্রেফতার করেছিলেন। এছাড়া নব্বই দশকে দেশে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেককেই তিনি গ্রেফতার করেছিলেন। যাদের অন্যতম সুইডেন আসলাম, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ ও বিকাশ। তবে যুবলীগের ত্রিরত্ন খ্যাত আওরঙ্গ-লিয়াকত-হান্নানের মধ্যে আওরঙ্গকে তিনি আটক করতে পারেননি। সত্তুর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই যুবলীগ নেতা আওরঙ্গের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তৎকালীন যুবদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা’র বিরোধ ছিলো। আওরঙ্গের অনুসারীরা মনে করেন (বর্তমানে এমপি) ওই নেতার সঙ্গে বিরোধের কারণেই ৮০ সালে সাকুরা হোটেলের বারে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার এক নায়েক খুনের ফাঁদে ফেলা হয় আওরঙ্গকে। যার ফলে ১০ বছরেরও বেশী সময় আওরঙ্গকে ভারতে পালিয়ে থাকতে হয়েছে।
আওরঙ্গ ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হলে আওরঙ্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল করার কিছু দিনের মধ্যেই গ্রেফতার হন। এর বছর খানেক পরই কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়েন।
রাজনৈতিক মহলে যুবলীগ নেতা লিয়াকত-হান্নানের গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গজেব। পাকিস্তান আমল হতে স্বাধীনতার পরবর্তী বেশ কয়েক বছর হাজারীবাগের ১নং মানেশ্বর প্রথম লেনের একটি সেমি পাকা টিনশেড বাড়িতে থাকতেন। পরে রাজধানীর হাতিরপুল এলাকায় স্হায়ীভাবে বসবাস করেন।
আওরঙ্গ ২০০৬ সালে বিএনপিতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৯১ সালে আওয়ামীলীগের টিকেটে শরিয়তপুর-১ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর পুরনো মামলায় ৯২ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত তাকে আবারও কারাবরণ করতে হয়। পরে উচ্চ আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান।
২০১৩ সালের ৩আগষ্ট নিজ এলাকা শরিয়তপুরে জাকাতের টাকা বিতরণে যাওয়ার পথে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে দূর্ঘটনায় নিহত হন তিনি।
আওরঙ্গের প্রধান শিষ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকতকে ১৯৮২সালে আজিমপুরে নতুন পল্টন লেন থেকে গ্রেফতার করেছিলেন এসি আকরাম হোসাইন। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে লিয়াকত ঢাকায় ১৯৮০ সালের ২৩মে বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম গেটে বঙ্গবন্ধুর খুনী খন্দকার মোশতাকের জনসভায় গ্রেনেড হামলার চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করেন। এছাড়াও ঢাকার অপরাধ জগত ও তার গুরু খ্যাত আওরঙ্গের উত্থান-পতনের কাহিনী বর্ণনা করেন।
লিয়াকতের জুটি মানিকগঞ্জের মুশফিকুর রহমান হান্নানের অপরাধ জগতের বহু কাহিনী বর্ণনা করেন এসি আকরাম হোসাইনের কাছে। এরশাদ সরকারের শাসনামলে ডিবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদে লিয়াকত ঢাকার অপরাধ জগতের কারা গডফাদার, কাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এরা এই অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছিলো এর সবই বর্ণনা করেছিলেন।
ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দীনের জরুরী সেনাশাসনের সময় ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকার লালমাটিয়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে আইন-শৃংখলা বাহিনী পরিচয়ে লিয়াকতকে তুলে নেয়া হয়। সেই থেকে তিনি আজ পর্যন্ত নিখোঁজ। অপরদিকে আওরঙ্গ এক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন। এদিকে হান্নান বর্তমানে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছেন বলে জানা গেছে।