এসি আকরামের জবানবন্দিঃ গ্রেনেড হামলায় পন্ড করা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর খুনির জনসভা

প্রথম প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২১ইং

আশির দশকে অপরাধীদের গ্রেফতারে আকরাম হোসাইন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ঢাকা শহর। অপরাধীদের কাছে তিনি ছিলেন এক আতংকের নাম। লালবাগ থানার এসআই ও পরে পদোন্নতি পেয়ে ওসি থাকাকালীন সময়েও তিনি মিন্টু রোডে মন্ত্রীর সরকারি বাড়ি থেকে আটক করেছেন কুখ্যাত সন্ত্রাসীকে ইমদুকে। মহাখালী থেকে আটক করেছেন বহু খুনের মামলার আসামি গালকাটা কামালকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে তিনি আটক করেন সে সময়ের যুবলীগ নেতা লিয়াকতকে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ঢাকায় অপরাধ জগতের সম্রাট হিসেবে যাদের নাম আলোচিত হতো এদের অন্যতম লিয়াকত- হান্নান-জুটি। আর এই মানিকজোড়ের ওস্তাদ ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত হোসেন আওরঙ্গ। ১৯৭৫এ জাতির জনকের হত্যাকান্ডের পর যুবলীগ নেতা আওরঙ্গ-লিয়াকত-হান্নান তাদের অপরাধ জগতের অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনী খন্দকার মোশতাকের ডেমোক্রেটিক লীগের উত্থানে আঘাত হেনে। তছনছ করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনী মোশতাকের দলকে।খুনী মোশতাকের জনসভায় সাপ ছেড়ে ছত্রভঙ্গ করে গ্রেনেড হামলা ইতিহাসেও ঠাঁই করে নিয়েছে।

১৯৭৫ সালে জাতির জনককে স্বপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। মাত্র ৮২ দিন প্রেসিডেন্ট থাকার পর ৭৫ এর ৭ নভেম্বর তার সরকারের পতন হয়। এরপর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর মোশতাককে দূর্নীতির দায়ে জেলে পাঠান। তার পাঁচ বছরের সাজা হলেও ১৯৭৬ সালেই তিনি মুক্তি লাভ করে নিজেই ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান তখনও কোন রাজনৈতিক দল গঠন করেননি। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনী মোশতাক গঠন করেন ডেমোক্রেটিক লীগ। দলের আত্মপ্রকাশ প্রকাশ উপলক্ষে ১৯৮০ সালের ২৩ মে বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম গেটে জনসভার ডাক দেন খন্দকার মোশতাক। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর এই খুনীর প্রকাশ্য জনসভা মেনে নিতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আওরঙ্গ- লিয়াকত গং। তাই বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ তার বিশ্বস্ত যুবলীগের দুই কান্ডারী লিয়াকত-হান্নানকে দায়িত্ব দেন যেকোনো মূল্যে বঙ্গবন্ধুর খুনী বিশ্বাস ঘাতক খন্দকার মোশতাকের জনসভাকে পন্ড করে দেয়ার।

সেসময় ঢাকার অপরাধ সাম্রাজ্যে আওরঙ্গ সবার কাছে আওরঙ্গ দাদা বলেই পরিচিত ছিলেন। আগের দিন রাতে মোশতাকের জনসভা পন্ড করার ছক চূড়ান্ত করা হয়। তবে এদের পরিকল্পনার বিষয়ে যুবলীগের শীর্ষ নেতারা কিছুই জানতো না। তাদের এই পরিকল্পনা কোন রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তও ছিলো না। মূলত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর খুনীর রাজনৈতিক দলের উত্থানকে তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই আওরঙ্গ মূলতঃ লিয়াকতকে হামলার নেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত দেন। কৌশল হিসেবে জনসভায় প্রথম সাপ ছেড়ে দেয়া হয়। সাভার বেদে পল্লী থেকে সাপুড়ে ভাড়া করা হয়। তার কাজই ছিলো জনসভায় সাপ ছেড়ে চলে যাওয়া। সাপ ছাড়ার উদ্দেশ্য ছিলো সভাস্থল ফাঁকা করে জনমনে আতংক তৈরী ও সবার দৃষ্টি সাপের দিকেই রাখা। এই ফাঁকে মোশতাকের সভা-সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করা।

আওরঙ্গ’র দুই পাশে লিয়াকত ও হান্নান

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৩মে বিকেল ৫টায় সমাবেশস্হলে মোশতাক উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশে সাপ ছেড়ে দেয়া হয়। সমাবেশেস্থলে সবার মাঝে দৌড়া-দৌড়ি ও হুলস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হলে এই সুযোগে কাজে লাগিয়ে লিয়াকতের বাহিনী মোশতাকের মঞ্চ লক্ষ্য করে দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। দূর্ভাগ্যক্রমে একটি গ্রেনেড মোশতাকের মঞ্চে না পরে পাশে থাকা সাংবাদিকদের বসার স্থানে বিস্ফোরিত হয়। ওই ঘটনায় একজন সাংবাদিকসহ ৭ জন নিহত হয়। অনেকে আহত হয়। এদের এক সাংবাদিক সালেহ।

স্বাধীনতার পর কোন জনসমাবেশে এটাই ছিলো প্রথম গ্রেনেড হামলা। এই হামলার পর বঙ্গবন্ধুর খুনী মোশতাক আর জনসভা ডাকেননি। রাজনৈতিক ভাবেও তার দল দাঁড়াতে বা জনসভা ডাকার সাহস পায়নি। অঙ্কুরেই তার দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মাধ্যমে তাদের মিশন সফল হয়েছিলো বলে লিয়াকত মনে করেছিলেন।

এসি আকরাম লিয়াকতকে আটকের পর মোশতাকের জনসভায় গ্রেনেড হামলার কারণ এ ভাবেই বর্ণনা করেছিলেন। লালবাগ থানা এলাকার নতুন পল্টন লাইনের একটি বাড়ি থেকে লিয়াকতকে আটক করা হয়েছিলো। সোর্সের নিশ্চিত খবর ছিলো লিয়াকত নতুন পল্টনের একটি বাসায় অবস্থান করছেন, আকরাম হোসাইন তার টিম নিয়ে বাড়িটিতে অভিযান চালান। বাড়ির গেট খুলতে অনেক সময় নষ্ট করা হচ্ছিল। এরপর গেট খোলা হলে নারী সদস্যরা জানাচ্ছিলেন, তাদের বাড়িতে লিয়াকত আসেনি। হঠাৎ করেই বেড রুমে একটি টি টেবিল নজরে আসে আকরাম হোসাইনের। তিনি দেখতে পান একটি সিগারেট অর্ধেকটা জ্বলছে। কিছু নাস্তাও সামনে পড়ে আছে। তাই তার সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। তিনি তার সঙ্গীয় ফোর্সদের পুরো ফ্লাটের প্রতি ইঞ্চি জায়গা তল্লাশি করতে বলেন। এক পর্যায়ে ঘরের একটি বড় স্টিলের আলমারির ভেতরে শিশুদের মতো লেপ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় লিয়াকতকে। এরপর মিন্টু রোডের ডিবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদে বঙ্গবন্ধুর খুনী খন্দকার মোশতাকের জনসভায় গ্রেনেড হামলাসহ বহু চাঞ্চল্যকর হত্যার বর্ণনা দেন লিয়াকত। ওই সময় দেশের শীর্ষ স্হানীয় দৈনিক ইত্তেফাকসহ বহু সংবাদপত্রে তা ফলাও করে প্রকাশিত হয়।

আরও পড়ুন