শ্বশুড়বাড়ীর গরু ছাগল প্রথাকে না বলুন !
“বহুকাল থেকে চট্টগ্রামে কয়েকটি প্রথা চালু হয়েছে। মেয়েকে পাত্রস্থ করাতে মোটা অংকের টাকাসহ টিভি, ফ্রিজ, মোটরবাইক তো আছেই! তার ওপর বিয়ের বছর যেতে না যেতেই সিজনাল ফল ও পিঠাপুলি মাফ নেই! বছরে দু’টো ঈদে মেয়ের শ্বশুড়বাড়ীতে পাঠাতে হয় নানা কিছু। ঈদুল ফিতরে চোখ জুড়ানো ইফতার সামগ্রী ও বাড়ীর সবার জন্য জামা-কাপড়। ঈদুল আযহা আসলেই আরেকটা প্রথা দেখা যায়, মেয়ের শ্বশুড়বাড়ীতে গরু না হয় ছাগল পাঠানো। এটা পাঠাতেই হয়, নতুবা মেয়েকে শ্বশুড়বাড়ীর লোকজন খোঁটা দিয়ে থাকে। এই প্রথাগুলো বড়ই জঘণ্য মনে হয়। এসব এক ধরণের জুলুম। কারো সামর্থ্যের বাহিরে গিয়েও তা পূরণ করতে হয়, মেয়ের সুখের জন্য। নিরুপায় মেয়ের পরিবার বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এই অসামাজিক ও অমানবিক প্রথার শিকার হয়।”
কোরবান একটি পবিত্র ইবাদত। ত্যাগের মহিমায় উত্তীর্ণ হয়েই ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ হালাল রুজি থেকে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে কোরবানি সম্পন্ন করেন। এটা অনেক পুরোনো প্রথা ; প্রাক ইসলামি যুগ থেকেই চলে আসছে। এই কোরবানির মূল কথাটা হচ্ছে ত্যাগ। অর্থাৎ ত্যাগটাকে আমি কতটা আন্তরিকতার সাথে করতে পারি সেটাই মূল বিষয়। যে জিনিসের প্রতি আমার সামান্য আকর্ষণ আছে সেটাকে ত্যাগ করা কঠিন নয়। যে জিনিসের প্রতি আমার বেশ আকর্ষণ আছে তাকেও ত্যাগ করা কঠিন নয়। কিন্তু যে জিনিসের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক অর্থাৎ তাকে যদি আমার আত্মজ বলা হয়, তাকে ত্যাগ করা মানে সর্বোচ্চ ত্যাগ করা। সেই সর্বোচ্চ ত্যাগ করার জন্যই তো এই ধর্মীয় নির্দেশটা এসেছিল। কোরাবনির পশু ক্রয় করার ক্ষেত্রে হালাল রুজি অবশ্যই হতে হবে। সুদ, ঘুষ, সুবিধাভোগী পরকে ঠকানো কোন টাকায় কোরবানি হবেনা। ধর্মীয় এই আচরণটা আজকাল আমাদের সমাজের কিছু ব্যক্তি নানা প্রথায় রূপ দিয়ে সমাজকে অস্থির করে তুলেছে। কোরবান আসলেই আতঙ্কে পড়েন কিছু কিছু পরিবার! বিশেষ করে সদ্য বিয়ে দেওয়া কন্যার পিতারাই এই আতংকে ভোগেন।
ঈদ আসে ঈদ যায়, পরিবর্তন আসেনা আমাদের সমাজে। দিন দিন কমে যাচ্ছে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ। হারাতে বসেছি ঐতিহ্য। সমাজটা আজকাল ঐতিহ্য হারাতে বসেছে কেবল কিছু অপসংস্কৃতির কবলে পড়ে। সমাজ হিতৈষিরা কতো চেয়েছিল ঘূণে ধরা সমাজকে পরিবর্তন করতে। কিন্তু অপসংস্কৃতির গন্ডি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছিনা কোনো মতেই। যৌতুক প্রথা সমাজের বৃহত্তম একটি কৃত্রিম সৃষ্ট অভিশাপ। যার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। ধনীর দুলালীরা বাবার বিত্ত সম্পদের স্রোতে পার পেলেও নির্ঘুম অশ্রু ঝরে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে। যৌতুকের বোঝাটা বহন করতে পারেনা পরিবারগুলো। যেখানে উপযুক্ত মেয়েকে পাত্রস্থ করাতে হিমশিম খায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো, সেখানে বছর না ঘুরতেই এ চাহিদা কতোটা নির্মমতা বয়ে আনে পরিবারে সেটা সহজেই অনুমেয়।
বিয়ের পর আমার কাছে মেয়ে বাবার বাড়ী ছেড়ে শ্বশুরবাড়ী চলে যাওয়াকে পৃথিবীর সপ্তাচার্যের একটি মনে হয়। তবে সেটা পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মেই হয়। কতো আদুরে লালিত কন্যা, মায়ের চোখের মণি, বাবার কলিজার টুকরো, ভাইয়ের আদুরের বোন যখন শ্বশুরবাড়ীতে চলে যায় সব মায়া মমতা ত্যাগ করে তখন বড্ড অবাক হই! অচেনা এক জগৎকে ধীরে ধীরে আপন করে নেয় মেয়েটি। কিন্তু তার স্বাধীনতা শ্বশুড়বাড়ীতে কামলার মতো। অথচ মেয়েটির বেশীদিন টিকেনা শান্তিতে যমপুরী শ্বশুড়বাড়ীতে। কারণ শ্বশুড়বাড়ীতে নানা বাহনা দিয়ে মেয়েকে বলে, “তোমার বাবার বাড়ী থেকে এ বছর ঈদুল ফিতরে সেমাই চিনি পাঠালে কম দিতে বলিও না, নতুবা আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারবোনা! কোরবানীর ঈদ এলে বলে, “গরু ত চাইনি! ছাগলটা একটু সাইজের হলে ভালো হয়! সমাজের কাছে যাতে বলতে পারি আমার ছেলের শ্বশুরবাড়ী থেকে দ্যাখো দ্যাখো কত বড় ছাগল পাঠাইছে! আজব, এসব বলতে অনেকের জিবে লজ্জাও বাঁধেনা। লজ্জা ওঠে গেছে সমাজ থেকে। আত্মসম্মান চলে গেছে আমাদের মনুষ্যত্বে। দিন দিন ব্যক্তিত্ব হারিয়ে সমাজে কুপ্রথাগুলো গেড়ে বসেছে। সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে বিষফোঁড়ার মতো রুপ নিয়েছে কিছু কিছু কৃত্রিম সৃষ্ট প্রথা।
বছরে দুটো ঈদ আসে আনন্দ নিয়ে। ঈদে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হয়, সামাজিক কলুষতা দূর হয়। কিন্তু ঈদ আসে মধ্যবিত্ত বাবাদের জন্য অভিশাপ হয়ে! কোরবানীর ঈদে মেয়ের শ্বশুরবাড়ীতে গরু-ছাগল দেওয়ার যে একটা অদ্ভুত নিয়ম প্রচলিত, তা আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিনা। কোরবানিটা সম্পূর্ণ ধর্মীয় একটা বিষয়। যার সামর্থ্য আছে সে দিবে, আর অন্যদিকে যার সামর্থ্য নাই সে দিবে না। এটাই মূলত সওয়াবের আশায় মহান আল্লাহর রেজামন্দী হাসিলের একটা সহজ পথ। এইতো সমাজের দুস্থ, অসহায়, গরীবদের খাওয়ানোর সুন্দর একটা পন্থা। তো মেয়ের শ্বশুড়বাড়ীর লোকজন কি ফকির মিসকিন! যে তাদের আস্ত গরু/ছাগল দিতে হবে? নাকি মেয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই এইটাও বাধ্যতামূলক হয়ে যায় যে, ছেলের বাড়ির সব ধর্মীয় নিয়মকানুন পালনের দায়িত্ব মেয়ে পক্ষের? এমনিতেই লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিয়ে দেয়। এভাবেই চলছে আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজ। এসব দৃশ্য দেখে সভ্যতার সংজ্ঞাটাও ভুলে যাই।
এখানেই শেষ নয়। তারপর শুরু হয় সিজনাল যা যা আছে। ধরুন, ফলমূল থেকে শুরু করে সব মৌসুমে পীঠাপুলি, রমজানে ইফতারি, ঈদে শ্বশুরবাড়ীর সবার জন্য কাপড়, তারপর আবার কোরবানীর গরু/ছাগল দেওয়া। অথচ কোরবানীর উদ্দেশ্যটাই পাল্টে দেয় এসব নিয়মকানুন। একেকটি ঈদ মেয়ের মধ্যবিত্ত বাবাদের জন্য আসে অভিশাপ হয়ে, হিমালয়ের বরফগলা কষ্টের জল হয়ে। খুশির চাঁদটিই যেন তাদের কাছে শনির দশা, কালো রেখা। আজকাল ধর্মীয় নিয়মকানুনের মাঝে ঢুকে গেছে এই দেওয়া নেওয়ার প্রথা। এভাবে সমাজে জঘণ্য কিছু নিয়ম কানুন কিংবা প্রথা গুলোই অস্থির করে তুলেছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে।
অদৃশ্য চোখের জল দেখে কে? বিয়ের পর মেয়ের বাবারা আরো বেশী অসহায় হয়ে পড়ে। মেয়ের শ্বশুড়বাড়ীর লোকজন কোরবানির সময় মেয়ে পক্ষ থেকে গরু/ছাগল দাবী করে বসে অথচ যাদের কোরবানি করার সামর্থ্য নেই। তারপরও আমাদের সুশীল সমাজের কুশিলব গং কি করে বলে নারী স্বাধীনতার কথা? নারীরা তো সবচেয়ে বড় অবহেলিত এখানেই। নারী নেতৃত্বের দেশে এসব প্রথা চরম হাস্যকর। এসব বিদঘুটে অন্ধকার কবে আলোর পথ দেখাবে? কবে সমাজ কলঙ্কমুক্ত হবে? কবে সমাজের পরিবর্তন আসবে? কবে সাম্যবাদের নীতি বাস্তবায়ন হবে? কবে দূর হবে এই বৈষম্যনীতি?
আমাদের সম্মানিত উচ্চবিত্ত পরিবার! আপনারা এসবের পিছনে অনেকাংশেই দায়ী। কারণ আপনাদের সামর্থ্য আছে তাই সমাজে জন্ম নিলো যৌতুক প্রথা, কোরবানীর ছাগল দেওয়া প্রথা, ঈদে সবার জন্য কাপড় পাঠানো প্রথা, ভূরি ভূরি ইফতার সামগ্রী পাঠানোর মতো প্রথাগুলো। আপনারা (উচ্ছবিত্ত) পরিবারগণ শুরু করেছেন বিলাসিতায়, কিন্তু সমাজে সেটা প্রথা হয়ে গেছে। আর এসব প্রথাগুলো অভিশাপে রূপ নিয়েছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারে। এই জন্যে আপনাদের দায়ী করি।
আসুন আমরা মহান হই, উদার হই। সমাজকে কলঙ্কমুক্ত করি। পরের দিকে আর না! ভাবুন জুলুম হচ্ছে আপনার এপারের আবদার ওপারের কাছে। আপনি ছেলের বাবা মানে এই আত্মসম্মানের নয় যে, আপনি সবকিছুতে মোড়ল। যদি তা ভাবেন তাহলে আপনি ক্ষুদ্র, হীনচেতা লোক, ফকির মিসকিনের একাংশ, লেশমাত্র নাই। এসব দেওয়া নেওয়াকে আমি সম্মান ও মার্যাদা হানিকর মনে করি। সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক এসব প্রথা কিছুতেই মানবসমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। আপনি বিবেক দিয়ে বিচার করুন, এটা অন্যায় কিনা, যদি তাই মনে হয় তবে পরিহার করুন। কোরবানীর ঈদে গরু-ছাগলকে না বলুন, ঈদে পরিবারের সবার জন্য কাপড় দেওয়া নেওয়াকে না বলুন। এই অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে সমাজকে মুক্ত করতে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখকঃ শিব্বির আহমদ রানা, শিক্ষক ও সাংবাদিক।