এসি আকরামের জবানবন্দিঃ ছুটিতে থেকেও রুবেল হত্যার আসামি হয়েছিলাম

প্রথম প্রকাশ : ২ সেপ্টেম্বর ২০২১ইং

এসি আকরাম হোসাইন। বাংলাদেশ পুলিশের এক দুঃসাহসী অফিসার ছিলেন। অপরাধী ধরার কৌশলে তার জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশ পুলিশের এমন কোন পদক নাই যা তার ঝুড়িতে একাধিকবার আসেনি। পুলিশের দাপুটে এই অফিসার সাফল্যে যেমন বীরত্বের পদকে ভূষিত হয়েছিলেন, তেমনি তারই ডিপার্টমেন্টাল ষড়যন্ত্রে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রুবেল হত্যায় অভিযুক্ত হয়ে কারাবরণও করেছেন। যদিও উচ্চ আদালতের নির্দেশে পরে রুবেল হত্যার অভিযোগ থেকে খালাশ পেয়েছিলেন।

আলোচিত -সমালোচিত পুলিশ কর্মকর্তা আকরাম হোসাইন গত ১৬ জুলাই ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। টাঙ্গাইল সদরের হুগরা গ্রামের এই বীর সন্তান তার কর্মময় জীবনের নানা ঘটনাবলী মৃত্যুর ছয় মাস আগে থেকেই বর্ণনা করেছিলেন এই প্রতিবেদকের কাছে। পুলিশের কর্মময় জীবনের ডিপার্টমেন্টের কতিপয় কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে রুবলে হত্যায় কেন তাকে জড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো, এর পেছনের কারিগরদের কথাও তিনি বলেছেন। যখনই তিনি চাকরি জীবনের সাফল্যের চূড়ায় আহরন করলেন তখনই তার জীবনে কলংকের কালিমা লেপন করা হয়েছিলো। সেই ষড়যন্ত্রকারী খেলোয়াড়দের নামও বলেছেন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। মনের দুঃখে তিনি তার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সরকারি চাকরি না করতে অসিয়ত করে গেছেন। মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘকাল কারাবরণ করেছেন। কেন তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন? কারা এই ষড়যন্ত্রের কারিগর ছিলো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন ততকালীন পুলিশ প্রধানের অনৈতিক ও অন্যায় আবদার না রাখায় আমাকে পরিকল্পিত ভাবেই রুবেল হত্যায় ফাঁসানো হয়েছিলো।

সেই ঘটনার বর্ননায় তিনি বলেন ১৯৯৮ সাল ২৩ জুলাই। আমি ছুটিতে। এসময়ে আমার টিমের সদস্যদের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোড থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক হায়াতুল ইসলাম ঠাকুরের নেতৃত্বে ডিবি পুলিশের দলটি। ডিবি পুলিশের নির্যাতনে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয় রুবেলের। সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয় ঘটনাটি নিয়ে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোসহ বিএনপির ছাত্রদল রুবেলকে তাদরে সংগঠনের সদস্য দাবি করে রাজপথে নানা কর্মসূচি দিতে থাকে। হত্যা মামলা দায়ের হয় ডিবির ওই টিমের বিরুদ্ধে।

এসি আকরাম বললেন, আমি নিজেই গ্রেফতার করি আমার টিমের সদস্যদের। মামলার তদন্ত যায় সিআইডির কাছে। সিআইডির তদন্তকালে আমার হাতের লেখা একটি চিরকুট উদ্ধার করে অভিযুক্ত এসআই হায়াতুল ইসলাম ঠাকুরের বাড়ি থেকে। সেই চিরকুটে রুবেলের মগবাজারের বাড়ির পাশের একটি কোচিং সেন্টারের ঠিকানা লেখা ছিলো। এসি আকরাম বললেন, আমার মেয়ে ওই কোচিং সেন্টারে কোচিং করতেন। একবার হায়াতুল ইসলাম ঠাকুরকে আমি ওই কোচিং সেন্টার থেকে মেয়েকে নিয়ে আসতে চিরকুটে কোচিং সেন্টারের ঠিকানাটি লিখে দিয়েছিলাম। তাই চিরকুটটি হয়তো তার বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলো। এই চিরকুটই ষড়যন্ত্রের জালে ফাঁসিয়ে দিতে ব্যবহার করা হয়েছিলো আমার বিরুদ্ধে। কারণ রুবেলের বাড়ির পাশের ওই কোচিং সেন্টারের ঠিকানার পেছনের অংশটি ছিলো অলিখিত সাদা। এসআই হায়াতুল ইসলাম ঠাকুরের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়ার সময় জব্দ তালিকার সাক্ষীরাও নিম্ন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলো একপাশে কোচিং সেন্টারের ঠিকানা তারা দেখেছে আর অপর পাশ সাদা অলিখিত ছিলো। এর আগে তদন্তকালীন সময়েই সংবাদমাধ্যম এই চিরকুটের রেফারেন্স দিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে এসি আকরামকে দায়ী করার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার পরিবেশ তৈরী করা হয়েছিলো। তিনি বলেন, নিম্ন আদালতে বিচার চলাকালে আমি ও আমার আইনজীবী মাননীয় আদালতের বিচারকের কাছে অনুরোধ করেছিলাম হাতের লেখার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে চিরকুটে লেখা কোচিং সেন্টারের ঠিকানার অপর পাশের লেখাটি কার হাতের তা পরীক্ষার করার জন্য। কিন্তু তা আমলে নেয়নি আদালত।

এসি আকরাম বললেন, তার টিমের সদস্য হায়াতুল ইসলাম ঠাকুরকে বাচিয়ে দেয়ার টোপ দিয়ে আমিই রুবেলকে ধরে আনার চিরকুট লিখে দিয়েছিলাম বলে বলানো হয়েছিলো বলে কারাগারে হায়াতুল ইসলাম ঠাকুর আমাকে জানিয়েছিলো। এসি আকরাম মনে করেন, সেই দিন যদি আইজিপি”র অনৈতিক ও অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত করে নিজের নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার, বলে ওকে স্যার এক্ষুনি ছেড়ে দিচ্ছি বলতাম তবে হয়তো আমাকে এই ষড়যন্ত্রের জালে আটকাতে হতো না। আমার চাকরি জীবনের এতো সাফল্যেও কালিমা লেপন হতো না। কারাগারেও যেতে হতো না। যে দেশে সন্ত্রাসী ধরায় আমি জয়ী হলেও ডিপার্টমেন্টাল কতিপয় কর্মকর্তার চালবাজি ও ষড়যন্ত্রের কাছে আমি হেরে গিয়েছিলাম।

দীর্ষশ্বাস নিয়ে এসি আকরাম বললেন, মহান সৃষ্টিকর্তা বলেতো একজন আছেন। তার দয়া ও সহযোগিতায় আমি যেমন চাকরি জীবনে সফলতা, পদক প্রাপ্তির পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছি আবার মহান আল্লাহর রহমতে উচ্চ আদালতে আমি যে ষড়যন্ত্রের শিকার তা প্রমান করে রুবলে হত্যার অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছি। তবে আমার জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছে। যা আর ফিরে আসবে না। সেই ষড়যন্ত্রের কথা ও বাস্তবতা পরবর্তিতেই বর্ণনা করবো ইনশাল্লাহ।

আরও পড়ুন