প্রথম প্রকাশ : ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ইং
সুইডেন আসলাম। সুইডিশ ছোট অস্ত্রের যেমন খ্যাতি আছে তেমনি ঢাকার অপরাধ জগতে ছোট অস্ত্র চালনায় পারদর্শী এক দুঃসাহসিক খেলোয়াড়েরর নাম শেখ মোঃ আসলাম। অপরাধ জগতে যিনি সুইডেন আসলাম নামেই পরিচিত। আশির দশকে ঢাকার ফুটবলে কিংবদন্তি স্ট্রাইকার ছিলেন ফুটবলার শেখ মোঃ আসলাম। একজন ফুটবল মাঠে আরেকজন অপরাধ জগতে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে। খ্যাতিমান দুই জগতের দুইজনেরই নাম এক হওয়ায় অপরাধ জগতের আসলামের সঙ্গে সুইডেন জুড়িয়ে দেয়া হয়। কারণ সুইডেন থেকে বাংলাদেশে এসে খুন করে আবার সুইডেনে ফিরে যেতেন, তাই তিনি সুইডেন আসলাম।
ঢাকার দোহারে আসলামের পূর্ব পুরুষদের বসবাস হলেও তার জন্ম রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে। ১৯৮৬ সালে পূর্ব রাজাবাজারের কিশোর শাকিলকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে তার খুনখারাবি”র হাতেখড়ি। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক হত্যা, চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধে হাত পাকিয়ে ফেলেন রাজাবাজারের সেই কিশোর ফুটবলারটি।
খুনখারাবিতে হাত পাকিয়ে তিনি হয়ে উঠেন ভয়ংকর সুইডেন আসলাম। ফার্মগেট, রাজাবাজার ও তেজগাঁও এলাকায় হয়ে উঠেন অপ্রতিরোধ্য অপরাধী। পুলিশও এই ভয়ংকর আসলামকে গ্রেফতারে তৎপর হয়ে উঠলে আসলাম পাড়ি জমান সুইডেনে। এরপর কেটে যায় অনেক বছর। বিদেশে থেকেই আসলাম তার বাহিনী ও অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। কিন্তু একটি ঘটনাই সুইডেন আসলামকে আবার দেশে আসতে বাধ্য করে। সুইডেনে থাকা তার স্ত্রী শিরিন আক্তার ইতি দেশে ফিরে তার কলেজ প্রেমিক ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মামুনকে বিয়ে করেন। এই সংবাদ সুইডেন পৌঁছালে আসলাম দেশে ফিরে মামুনকে খুন করে প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করেন। দেশে ফিরে সমঝোতার কথা বলে আসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পুরান ঢাকার আগামাসী লেনের শামীম আহমেদ ওরফে আগা শামীমের এলাকায় বসার জন্য মামুনকে আসতে বলেন।
১৯৯৫ সালের ৪ অক্টোবর। রাত তখন আনুমানিক পৌনে ন”টা কিংবা নয়টা হবে। পুরান ঢাকার ৪ নাম্বার আব্দুল হাদী লেনের একটি পরিত্যাক্ত ড্রাম ফ্যাক্টরী। মামুন আসলেন সঙ্গে তার দুই সঙ্গী সন্ত্রাসী গোপাল কর ও গোপীবাগের নুরুল ইসলামকে নিয়ে। তখন মোবাইলের ব্যাপক ব্যবহার শুরু না হলে পেজার চালু হয়েছিলো। বলে রাখা দরকার, গোপাল কর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি ও খ্যাতি ছিলো। তার কোমরে পেজার। মামুন হয়তো তখনও জানতো না এইটাই তার শেষ রাত। আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা সুইডেন আসলাম ও তার বাহিনী মামুন, গোপাল ও নুরুল ইসলামকে কোন সুযোগ না দিয়েই তাদের উপর উপর্যুপরি গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। আব্দুল হাদী লেনের ড্রাম ফ্যাক্টরী থেকে গোলাগুলির শব্দে পুরো এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পরে।মুহূর্তেই গোটা এলাকা জনশূন্য হয়ে পরে।
রক্তাক্ত তিনটি লাশ পরে আছে। ত্রিপল মার্ডার। পুরান ঢাকার এই নির্মম খুনের সংবাদ মূহুর্তেই ছড়িয়ে পরে গোটা ঢাকা শহরে। পুলিশের ওয়ারলেস বার্তার মাধ্যমে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসেন তৎকালীন ঢাকার উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। ডিবির এসি আক্তারুজ্জামান রুনু তার টিমের চৌকস অফিসার ইন্সপেক্টর হামিদুল হক, ইন্সপেক্টর বাবুল ও এসআই আলমগীরকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তখনও লাশগুলোর শরীর থেকে রক্ত ঝরছিলো। এমনই এক সময়ে সন্ত্রাসী গোপালের কোমড়ের পেজারটি টু–টু—শব্দে বেজে উঠছিলো। উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন। এরপর গোপালের কোমর থেকে পেজারটি খুলে নিয়ে নাম্বরটি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বলে ফোন দিয়ে সনাক্ত করেন।
পরদিন দেশের সকল প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদ ছিলো পুরান ঢাকায় ত্রিপল মার্ডার। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বিএনপি আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন চিরকুমার রুপগন্জের আব্দুল মতিন চৌধুরী। আর এই দুঃসাহসিক খুনের নায়ক হিসেবে শেখ মোঃ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলামের কথাই আলোচনায় উঠে আসলো। আসলামের স্ত্রী ইতিকে বিয়ে করার প্রতিশোধ নিতেই মামুন ও তার খুটি গোপাল করকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। সঙ্গে গোপীবাগের নুরুল ইসলাম টার্গেটে না থেকেও কেবল সঙ্গে থাকায় নিহত হয়।
তিন খুনের পর আসলাম আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ঘটনার পর থেকেই আজও পলাতক আগা শামীম। পুরান ঢাকায় আজও মানুষের মুখে মুখে এই লোমহর্ষক হত্যার কাহিনী। পরদিন ৫ অক্টোবর মামুনের পিতা অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর আবু তালেব আখন্দ কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা (১৬) তারিখ ৫/১০/১৯৯৫ দায়ের করেন। মামুনের পুরো নাম এটিএম আব্দুলাহ আল হাসান মামুন। ক্যান্টমেন্ট দামাল কোট এলাকার দীন মোহাম্মদ কলোনীতে তার পিতার সঙ্গেই থাকতো। তাদের গ্রামের বাড়ি লক্ষিপুর জেলায়। সে ছিলো সন্ত্রাসীদের গুলী সাপ্লায়ার ও গোপাল করের ঘনিষ্ঠ।
ঢাকায় অপরাধ জগতের ভয়ংকর খুনী হিসেবে পরিচিত শেখ মোঃ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম যেনো আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেন। গ্রেফতারের দুই মাস আগে ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের পাশের গলিতে প্রকাশ্যে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে খুন করেন যুবলীগের নেতা মাহামুদুল হক খান গালিবকে। তখন ক্ষমতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মেজর(অবঃ) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম। ফার্মগেটের মতো জনবহুল এলাকায় এই নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা পুলিশ প্রশানের ভিতকেও কাঁপিয়ে দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে আসলামের নাম ঘোষিত হয়। সেই সঙ্গে সরকার ১লাখ টাকার পুরষ্কার ঘোষনা করে তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য।
এসি আকরাম বলছিলেন, এই ভয়ংকর অপরাধী আসলামকে গ্রেফতারের পেছনের কাহিনী। সুইডেন আসলামকে গ্রেফতারে জাল বিছিয়ে দেয়া হয়েছিলো ঢাকার সর্বত্র। যেকোন মূল্যে তাকে আটক করতেই হবে। ১৯৯৭ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহ। একটি সুত্রে খরব আসলো সুইডেন আসলাম তার দ্বিতীয় স্ত্রী’র সঙ্গেই থাকছেন। স্ত্রী’র জন্য একটি নতুন ফ্রীজ কিনেছেন ঢাকা স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি দোকান থেকে। এসি আকরাম ভাবলেন, এই ফ্রীজটি পৌঁছে দিতে পারে সুইডেন আসলামের কাছে। সত্যতা যাচাইয়ে কৌশলে তিনি স্টেডিয়াম মার্কেটের সেই দোকানের তিনি চার দিনের সেল রিপোর্ট ও মাল ডেলিভারির চালানের ঠিকানা সংগ্রহ করলেন।দোকান মালিক বা কর্মচারীদের কিছুই বুঝতে দেননি কোন ক্রেতার ঠিকানা খুঁজছেন। তিনি কাংখিত ফ্রীজ ডেলিভারির একটি ঠিকানা সোর্সের দেয়া এলাকার সঙ্গে মিল পেলেন। বিচক্ষণ পুলিশ অফিসার এসি আকরামের বুঝতে বাকি নেই ফ্রীজের এই ঠিকানায় লুকিয়ে আছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম।
১৯৯৭ সালের সম্ভব ২৫ অথবা ২৬ মে। মহাখালী ডিওএইচএস এর সেই বাড়িটিকে ঘিরে ফেলা হলো। এসি আকরামের সঙ্গে তার চৌকস কয়েকজন পুলিশ অফিসার। সবার সতর্ক দৃষ্টি সেই ফ্ল্যাটটির একটি কক্ষের দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে ধরতে হবে।কারণ দুঃসাহসী সুইডেন আসলাম টের পেলে গুলি করতে পারেন। তাই তাকে কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। ফ্ল্যাটটি আগেই ঘিরে ফেলা হলো। পালানোর সব পথেই সবার সতর্ক অবস্থান। ছাদের উপর যাতে উঠতে না পারেন সেখানেও গোয়েন্দাদের সতর্ক অবস্থান।
মহাখালী ডিওএইচএস এর কাংখিত সেই ফ্ল্যাটে নক করতেই ভেতর থেকে কেউ কোন সাড়া শব্দ করছিলেন না। বারবার কলিং বেল বাজানোর পরও যখন কেউ খুলছিলেন না, এসি আকরাম তখন নিজের পরিচয় দিয়ে দরজা ভেঙ্গে ফেলার কথা বলেন।এ-ও জানান পুলিশ তার ফ্লাটের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। এক পর্যায়ে সুইডেন আসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী দরজা খুলে দেন। সতর্কতার সঙ্গে এসি আকরাম অস্ত্র তাক করে রুমে প্রবেশ করে সুইডেন আসলামের হাতে আইনের শিকল পরিয়ে দেন। সেই সঙ্গে ঢাকায় অপরাধ জগতের এক ভয়ংকর খুনী সুইডেন আসলাম অধ্যায় শিকল বন্দী হয়।
১৯৮৫ থেকে ১৯৯৭ সাল এক যুগ। ঢাকার অপরাধ জগতের এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একযুগ বিচরণেরও অবসান ঘটে। এসি আকরাম দুর্ধর্ষ আসলামের ভদ্র বিনয়ী ব্যবহারে হতবাক হয়েছিলেন। কি করে এমন একজন বিনয়ী তরুণ এমন ভয়ংকর খুনী হতে পারে, এমন প্রশ্নই তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো বার বার।
মিন্টু রোডের ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হয় সুইডেন আসলামকে।এসি আকরাম সুইডেন আসলামকে গ্রেফতারে কে তথ্যটি দিয়েছিলো তা প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন। এসি আকরাম সুইডেন আসলামকে গ্রেফতারের বর্ণনা দিয়ে বলছিলেন, কারাগারেও তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে। এসি আকরামের হাতে হ্যান্ডকাপ পরা সুইডেন আসলাম আজ দুই যুগ ধরেই কারাগারের চার দেয়ালে বন্দী। তবে সরকারের ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তার নাম তালিকা ভুক্ত হলেও গালিব হত্যা মামলা ছাড়া সব মাললায় তিনি খালাস পান। দুটি মামলায় নিম্ন আদালতে সাজা হলেও উচ্চ আদালত হতে খালাস পান। কারাগারে বসেই ঢাকার অপরাধ সাম্রাজ্য শাসন করে আসছেন এমন অভিযোগ সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে গত দুই যুগ ধরেই শোনা যাচ্ছে। তবে কারাগারে থাকা আসলামের কাছে তার জামিন কিংবা মুক্তির সংবাদটি অপ্রিয়। কারণ গুম ক্রস আর র্যাব বাহিনী অন্তত কারাগারে প্রবেশের সুযোগ নেই। তাই কারাগারকেই এখন তার নিরাপদ জীবন বলে মনে করছেন বলে সে এসি আকরামকে জানিয়েছিলেন।