চট্টগ্রামের সন্তান কিসলু’র “টেবিল টেনিস“ সাফল্যের না জানা অধ্যায়

চট্টগ্রামের হাটজারীর সন্তান কিসলু। সত্তুর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই কিসলুর টেবিল টেনিস জগতে পদার্পণ। প্রায় দেড় যুগেরও বেশী সময় বাংলাদেশে টেবিল টেনিস খেলেছেন, কোচিং দিয়ে নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরী করেছেন। চট্টগ্রামের এই সন্তান টেবিল টেনিস থেকে অবসরে গেলেও তিনি আজ একজন সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। অতিরিক্ত সচিব। মেধার দিক থেকে পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় কিসলু ও তার ছোট বোন ফারজানা মমতাজও একজন সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চট্টগ্রামের গর্বিত ভাই-বোনের বাবা জালাল উদ্দীনও ছিলেন একজন আমলা।

১৯৮৭ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ৩৯ তম বিশ্ব টেবিল টেনিসে কিসলু

 

কিসলু’র পুরো নাম আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ। তবে টেবিল টেনিস ও ক্রীড়াঙ্গনে কিসলু নামেই পরিচিত। মেধা ও আদর্শে একজন চৌকস নীতিবান খেলোয়াড় ছিলেন। এখন সরকারী কর্মকর্তা। শৈশব ও শিক্ষা জীবনে নিজকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন একজন টেবিল টেনিস খেলোয়াড়, কোচ ও সংগঠক হিসেবে। সেই সঙ্গে খেলার সময় খেলা আর পড়ার সময় পড়া পিতা-মাতার এই নীতিগত আদেশ অনুসরণ করেই হয়েছেন একজন দক্ষ বিসিএস অফিসার বা আমলা। কিসলুর শৈশব ও বড় হয়ে উঠা আজিমপুরে। পিতা সরকারি কর্মকর্তা বা বিসিএস অমলা হওয়ায় তার বসবাস ছিলো আজিমপুরের কলোনীতে। পা বাড়ালেই ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ওয়েষ্ট এন্ড হাই স্কুল। স্কুল শেষ করেই ছুটতেন আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য একটাই টেবিল টেনিসের টেবিলটা দখলে নেয়া। কারণ বিলম্ব হলেই আর খেলার সুযোগ পাওয়া যায় না।

১৯৮২ সালে চট্টগ্রামের শুভকরণ রাজগোরিয়া মেমোরিয়াল ওপেন টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টে দলগত ইভেন্টে রানারআপ ও একক এবং দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন পুরষ্কার গ্রহণ করেছেন তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে

 

দুইবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, আজিমপুর ইয়ং স্টার ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ কিসলুর খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুটাই ছিলো এমনই কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে। আর এই প্রতিযোগিতা ছিলো বলেই তার খেলোয়াড়ী জীবনে সাফল্য এসেছে বলে তিনি মনে করেন। কিসলু বলেন, সেই ১৯৭৬ সালের কথা, তখন আমরা আজিমপুর কলোনীর ৫৩/ডি এ থাকি। স্কুল শেষ করেই আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারে খেলতে যেতাম। কিন্তু সেখানে ছিলো মাত্র দুটি টেবিল। সিনিয়র ভাইদের অনুশীলন শেষ হলে পরে আমরা সুযোগ পেতাম। দিন দিন খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সিদ্ধান্ত হয় একটি উন্মুক্ত টুর্নামেন্টের। যে চ্যাম্পিয়ন হবে সে ১ নাম্বার টেবিলে খেলার সুযোগ পাবে। কারণ তখন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ও ভাল র‍্যাংকিং এ থাকা কচি, রচি, হানিফ ভাইদের দখলে থাকতো টেবিল। তাদের খেলা শেষ হলে আমাদের খেলার সুযোগ হতো। তাই আমার লক্ষ্যই ছিলো এই উন্মুক্ত টুর্নামেন্টে আমাকে চ্যাম্পিয়ন হতেই হবে। আমি সেই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হই। সেই থেকেই আমার প্রতিযোগিতামুলক খেলোয়াড়ী জীবন শুরু হয়। এরপর আর থেমে থাকিনি। এরই মধ্যে ১৯৭৭ সালে পুরান ঢাকার আজাদ মুসলিম ক্লাব উন্মুক্ত টেবিল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে তখন আমি স্কুল ছাত্র। ব্যক্তিগতভাবে সেই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করি।সেই টুর্নামেন্টে আমি সেমিফাইনালে গিয়ে লীগের খেলোয়াড় মন্জুর সঙ্গে হেরে যাই। কিশোর বয়সে আমার পারফরমেন্স দেখে প্রয়াত সাংবাদিক, কোচ,জালাল ভাই ইয়াং প্যাগাসাস ক্লাবের অধিনায়ক হানিফ ভাইকে বলে দেন আমাকে ইয়াং প্যাগাসাসে অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে দলভুক্ত করতে। ওই বছরই মেট্রোপলিশ টেবিল টেনিস লীগে ওয়ারীর সঙ্গে খেলায় রচি ভাই অনুপস্থিত থাকলে আমাকে খেলার সুযোগ দেয়া হয়। ওয়ারীর বিরুদ্ধে আমরা ৫-৩ সেটে জয়ী হই। এর মধ্যে আমি একাই ৩ সেটে জয়ী হই। এরপর থেকেই লীগে আমি নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে স্থান করে নেই। টিটি লীগে খেলার অভিষেকটা এভাবেই ছিলো কিসলুর।

ফ্রান্সের বিখ্যাত টিটি খেলোয়াড় সিক্রেটিনের সঙ্গে কিসলু

 

ছোটবেলায় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলায় আগ্রহ থাকলেও ক্রিকেট কোচ জালাল ভাই বললেন, তুমি টেবিল টেনিসে মনোযোগ দাও। এখানেই তুমি সফল হবে। তোমার মধ্যে মেধা আছে। তুমি টিটিতেই আরো মনযোগী হও। এরপর থেকেই কিসলু টিটি”র সঙ্গেই মিশে যান। কখনো খেলোয়াড়, কখনো কোচ আবার কখনো সংগঠক হিসেবে। আজিমপুরর ক্রীড়াঙ্গনে ইয়াং প্যাগাসাস ক্রিকেট ও টেবিল টেনিসে বহু খেলোয়াড় তৈরী করেছে। তাই পাড়ার সিনিয়ররা যখন আস্তে আস্তে পেশাগত এবং নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেন তখন কোন পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই স্কুলে পড়াকালীন সময়েই কিসলু নিজেই একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন শুধুমাত্র টেবিল টেনিস প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য। নাম আজিমপুর ইয়ংস্টার টেবিল টেনিস ক্লাব। তখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী রায়হান ভাই, আজিমপুরের বধু ভাই ও হাজারীবাগের বাদল ভাই আর্থিক সহায়তা দিয়ে ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসেন। স্কুল ছাত্র কিসলুর নিজের কোন টাকা-কড়ি নেই। সেই সময় খেলাধূলার প্রতি তাদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতার কথা আজও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। আজিমপুর ইয়ং স্টার টিটি ক্লাব থেকেই অসংখ্য খেলোয়াড় তৈরী হয়। যারা পরবর্তিতে লীগ ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। যাদের মধ্যে আখলাক, বাদল, রিপন, মোহাম্মদ আলী, রিটু, রিমন, বাবু, মুসা, তন্ময় উল্লেখযোগ্য। ৮৮তে ঢাকায় একটি আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্টে আখলাখ জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্ট হওয়ার গৌরব অর্জন করলে আমার ছাত্র আখলাখকে জুটি করে জাতীয় টিটির পুরুষ দ্বৈত-এ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করি। জাতীয় চ্যাম্পিয়ান টিটি তারকা কিসলু এভাবেই তার সাফল্যের স্মৃতিচারণ করেন। ঢাকার টেবিল টেনিস বা অন্য কোন খেলায় কোন খেলোয়াড় নিজে খেলে এবং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে কোচিং করিয়ে খেলোয়াড় তৈরীর নজির কিসলু ছাড়া আর কারো আছে বলে তার জানা নেই।

ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে কিসলু (দাড়িমুখে নীল গেঞ্জি পরিহিত)

 

কিসলু আজিমপুর ইয়াং প্যাগাসাসের হয়ে টেবিল টেনিস খেলা শুরু করলেও পরবর্তীতে পল্লী বিদ্যুৎতায়ন বোর্ড (আরইবি) আরমানীটোলা জেএস ক্লাব, ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, বাংলাদেশ আনসার, বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প কর্পোরেশন(বিটিএমসি) এবং ইন্টার স্পোর্টস টিটি ক্লাবের হয়ে ঢাকার লীগ, টুর্নামেন্ট ও বিভিন্ন আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে একবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নিয়ে দলগত ও পুরুষ দ্বৈত-এ রানার্সআপ হয়েছেন।

জাতীয় পর্যায়ের কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই কয়েক বছরের মধ্যেই কিসলু হয়ে ওঠেন এক চৌকস খেলোয়াড়। ১৯৮২ সালের আরমানিটোলা জেএস এর হয়ে কিসলু টেবিল টেনিস লীগে একক ও দ্বৈত অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।দেড় যুগ টেবিল টেনিস খেলার পর আনুষ্ঠানিক বিদায় না নিলেও তার খেলোয়াড়ী জীবনের দুঃখজনক ঘটনা হ্যাটট্রিক শিরোপা হাতছাড়া হওয়া। সেই স্মৃতিচারণে বলেন, ১৯৮৯ সালের ঘটনা। এ যেনো ফাইনালের আগেই ফাইনাল খেলা। আমি পর পর দুই বার এককে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। এবার সেমিফাইনালে মুখোমুখি হই রচির। জিতলেই শিরোপা জয়ের হ্যাটট্রিকের হাতছানি। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ খেলা ২-২ সেটে সমানে সমান, শেষ সেটে রচির স্কোর ২০। আর আমার ১৪। রচির প্রয়োজন মাত্র ১, আর আমার ৮। এক পর্যায়ে আমি পর পর ৭ পয়েন্ট অর্জন করে রচিকে আটকে রাখি। এক সময় দুজনেরই পয়েন্ট ২১ হলে খেলা গড়ায় ডিউজে। এতে রচি শেষ পর্যন্ত আমাকে ৩০-২৮ পয়েন্ট হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই দিনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ ম্যাচ টি আজও আমার খেলোয়াড়ী জীবনের বেদনাদায়ক বলে মনে করি। কারণ আমার হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নের সুযোগটি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। কিসলু মনে করেন রচির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেও হেরে যাওয়াটা ছিলো ভাগ্য আমার পক্ষে না থাকা। আর ফাইনালটি রচির সঙ্গে একতরফা হয়েছিলো। তাই সেই শিরোপা জয়ের হ্যাটট্রিক সুযোগটির কাছাকাছি গিয়েও ছিটকে পড়ার দিনটির কথা মনে হলে আজও কষ্ট পাই, ভুলতে পারি না। তবে এই দুঃখটার আগে সাফল্যও ছিলো।

১৯৮২ সালে চট্টগ্রামে শুভকরণ রাজগোরিয়া মেমোরিয়াল ওপেন টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পক্ষে আমি দুইজন জাতীয় চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে পুরুষ একক ও দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করি। সেই সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে কিসলু বলেন, এককে আমি কোয়াটার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ধারাবাহিকভাবে হ্যাপি, রিন্টু ও কচিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। আমরা ছিলাম সেই টুর্নামেন্টে আনসিডেট খেলোয়াড়। সেই টুর্নামেন্টে আমরা পুরুষ একক ও দ্বৈত শিরোপা জয় করি। এছাড়া দলগত ইভেন্টে আমাদের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব রানার্সআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো। সেই দিনের খেলার কথা মনে হলে আনন্দে মন আজও উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কঠোর পরিশ্রম, নিয়মিত অনুশীলনের মধ্যে কিসলু টেবিল টেনিসে দেড় যুগ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশে। হোক না সেটা লীগ, জাতীয় টিটি বা কোন আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্টে। এশিয়ান টেবিল টেনিস হতে শুরু করে বিশ্ব টেবিল টেনিসেও বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন কিসলু। দেড় যুগ টেবিল টেনিসে ফুটওয়ার্কের ছন্দে ছোট্টো বলটির নিপুণ নিয়ন্ত্রণে প্রতিপক্ষের সীমানায় ড্রপ করেছেন বিশ্বস্ত হাতের নিখুঁত পাওয়ারফুল শটে।১৯৭৭ থেকে ১৯৯৫ শুধু খেলেই যাননি, তার প্রতিষ্ঠিত আজিমপুর ইয়ংস্টার টিটি ক্লাবের মাধ্যমে শিশু-কিশোর ও তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরী করেছেন শতাধিক খেলোয়াড়। যারা জাতীয় ও ক্লাব পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।তাই কিসলু শুধু খেলোয়াড়ই ছিলেন না, তিনি ছিলেন কোচ ও সংগঠকও।

কিসলুর বাবা একজন বিসিএস আমলা ছিলেন। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তিন আমলেই দক্ষতা, সততা ও ন্যায়পরায়নতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। মন্ত্রী পাড়ায় তার বাবার সততা, ন্যায়পরায়নতা ও দক্ষতায় একটি ইমেজ ছিলো। তার পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিলো ছেলে-মেয়েরাও বাবার মতো আমলা হবে,পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হবেন। ১২ ভাই-বোনের মধ্যে কিসলু আর ছোট বোন ফারজানা মমতাজ একসঙ্গেই ১৫তম বিসিএস-এ মেধা তালিকায় স্থান করে নেন। দুজনই বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন। কিসলুর মাতার নাম মমতাজ বেগম। তার বাবা তার সব সন্তানের নামের সঙ্গে তাদের মায়ের মমতাজ নাম যুক্ত করেছেন। তাই ক্রীড়াঙ্গনে কিসলু নামে পরিচিত হলেও সচিবালয়ে বা আমলা পাড়ায় সবার কাছে মমতাজ নামেই পরিচিত কিসলু। ৯৫ সালে কিসলু সরকারি চাকরিতে যোগদান করায় তার প্রীয় টিটি”র ব্যাট হাতে টেবিলে মনোযোগ দিতে পারেননি।চাকরির কারণে দেশের বিভিন্ন জেলা আবার কখনো কখনো প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বাহিরেও যেতে হয়েছে। তবে দেশের যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই টেবিল টেনিস খেলোয়াড় তৈরীর কাজটি করেছেন। জেলা,উপজেলা বা থানা সদরে টেবিল টেনিস খেলার ব্যবস্থা না থাকলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রশিক্ষণ হতে শুরু করে খেলার আয়োজনসহ সকল ব্যবস্থাই করে দিতেন।

পরিবারের সাথে কিসলু

 

বর্তমানে টিটির কিসলু সরকারের অতিরিক্ত সচিব। সাভারে বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এমডিএস এর দায়িত্ব পালন করছেন। পড়াশুনায় মেধাবী কিসলুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষতার অফার দেয়া হলেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ঢাবিতে পড়াশোনাকালীন সময়েই কিছু দিন সিটি কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে কিসলু বিবাহিত। তার সহধর্মিনী টিটির ছাত্র ও পাটনার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন আখলাখের বোন ডাক্তার শারমিন মিজান। তিনিও পিএইচডি করেছেন। আরবান হেলথ কেয়ার প্রজেক্টের উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। দুই মেয়ে সুমাইয়া সাদিয়া মমতাজ ও আফিয়া মাহমুদা মমতাজ ও ছেলে সাদ আস সামী। তিন সন্তান নিয়েই তাদের পরিবার। কিসলু একজন প্রশাসন ক্যাডারের পদস্থ কর্মকর্তা হওয়া সত্বেও ঢাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট নেই। রাষ্ট্রের জনগনের টাকায় যে বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সুসন্তান হিসেবে যেন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কিছু করতে পারেন সেই চেষ্টাই করছেন কিসলু। সৎ ও ন্যায়পরান কিসলুর পূর্ব পুরুষদের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার উত্তর মাদারশার বদিউল আলম হাট এলাকায়।

কিসলুর আক্ষেপ দুই দুই বার জাতীয় চ্যাম্পিয়নসহ লীগ, টুর্নামেন্ট, আমন্ত্রণমূলক অনেক প্রতিযোগিতায় এতো সাফল্য ও নিজে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে কোচিং করিয়ে বহু খেলোয়াড় তৈরীর পরও কোন পুরষ্কার তার ভাগ্যে জোটেনি। তাই মাঝে মধ্যে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন, ‘পুরষ্কারের আসলে যোগ্যতা কি?

পরিবারের সাথে কিসলু

 

একনজরে কিসলু : নাম আবু মমতাজ সাদ উদ্দীন আহমেদ কিসলু। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে টেবিল টেনিসে অংশগ্রহণ করেছেন।১ ৯৮১ সালে পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড (আর,ই,বি) হয়ে দলগত ইভেন্টে রানার্সআপ। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রামের শুভকরণ রাজগোরিয়া মেমোরিয়াল ওপেন টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টে দলগত ইভেন্টে রানার্সআপ, পুরুষ এককে চ্যাম্পিয়ন এবং পুরুষ দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮২ সালে আরমানিটোলা জে,এস, ক্লাবের হয়ে মেট্রোপলিশ টেবিল টেনিস লীগে দলগত ইভেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন, ১৯৮৩ একই ক্লাবের হয়ে মেট্রোপলিশ টেবিল টেনিস লীগের দলগত ইভেন্টে রানার্সআপ, ১৯৮৪ সালে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে মেট্রোপলিশ টেবিল টেনিস লীগে দলগত রানার্সআপ, ১৯৮৪ সালের জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আনসার দলের হয়ে দলগত ইভেন্টে রানার্সআপ, ১৯৮৫ সালেও জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আনসার দলের হয়ে দলগত ইভেন্টে রানার্সআপ, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ আনসার দলের হয়ে মেট্রোপলিশ টেবিল টেনিস লীগে দলগত ইভেন্টে রানার্সআপ, ১৯৮৭ সালে জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় রানার্সআপ, পুরুষ এককে চ্যাম্পিয়ন ও পুরুষ দ্বৈত রানার্সআপ, ১৯৮৮ সালে জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আনসার দলের হয়ে দলগত চ্যাম্পিয়ন, পুরুষ একক, দ্বৈত ও মিশ্র দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন, ১৯৮৮ সালের বাংলাদেশ গেমসে বাংলাদেশ আনসার দলের হয়ে দলগত রানার্সআপ, পুরুষ এককে তৃতীয়, পুরুষ দ্বৈত রানার্সআপ এবং মিশ্র দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন, ১৯৮৮ সালে মেট্রোপলিশ টেবিল টেনিস লীগে বাংলাদেশ আনসার দলের হয়ে দলগত রানার্সআপ, ১৯৮৯ সালে জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প কর্পোরেশন(বিটি এমসি)”র হয়ে দলগত চ্যাম্পিয়ন,পুরুষ এককে তৃতীয়, পুরুষ দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন ও মিশ্র দ্বৈত রানার্সআপ, ১৯৮৯ সালে মেট্রোপলিশ টেবিল টেনিস লীগে বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প কর্পোরেশনের(বিটিএমসি)”র হয়ে দলগত রানার্সআপ, ১৯৯০ সালে জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প কর্পোরেশন(বিটিএমসি)”র হয়ে দলগত রানার্সআপ, পুরুষ দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন এবং মিশ্র দ্বৈত রানার্সআপ, ১৯৯১ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আমন্ত্রণমূলক টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় দলগত ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন,পুরুষ একক চ্যাম্পিয়ন এবং পুরুষ দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯৩ সালে জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প কর্পোরেশন(বিটিএমসি)”র হয়ে দলগত রানার্সআপ, পুরুষ দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন ও মিশ্র দ্বৈত রানার্সআপ, ১৯৯৪ সালে জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে দলগত ইভেন্টে রানার্সআপ এবং পুরুষ দ্বৈত রানার্সআপ, ১৯৯৪ সালে মেট্রোপলিশ টেবিল টেনিস লীগে ইন্টার স্পোর্টস টিটি ক্লাবের হয়ে দলগত ইভেন্টে রানার্সআপ, ১৯৯৫ সালে জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প কর্পোরেশন(বিটিএমসি)”র হয়ে দলগত ইভেন্টে রানার্সআপ এবং পুরুষ এককে রানার্সআপ। এছাড়া ১৯৮১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক আমন্ত্রণমূলক টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের দলগত অংশগ্রহণ, ১৯৮৬ সালে চীনে অনুষ্ঠিত ৭ম এশিয়ান টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের হয়ে অংশগ্রহণ, ১৯৮৭ সালে কোলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমসে বাংলাদেশ দলের হয়ে অংশগ্রহণ, ১৯৮৭ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ৩৯তম বিশ্ব টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের হয়ে অংশগ্রহণ, ১৯৮৮ সালে জাপানের নিগাতা শহরে অনুষ্ঠিত ৮ম এশীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণ, ১৯৮৯ সালে জার্মানের ডর্টমুন্ডে অনুষ্ঠিত ৪০তম বিশ্ব টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণ, ১৯৯১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২য় উইলস আন্তর্জাতিক আমন্ত্রণমূলক টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে মিশ্র দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় কাপ টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের হয়ে দলগত অংশগ্রহণ এবং ১৯৯৯ সালে ভারতের মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত ৭ম এশীয় জুনিয়র টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের হয়ে দলগত অংশগ্রহণ করেন।

এ ছাড়া টেবিল টেনিসে কিসলুর অসাধারণ সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ক্রীড়া পুরষ্কার ব্লু প্রদান করা হয়। দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে ঢাকার টেবিল টেনিস অঙ্গনে অসাধারণ সাফল্যের জন্য ২০১৬ সালে খিলগাঁও পল্লীমা সংসদ বিশেষ পুরষ্কারে ভূষিত করে।