বিএনপি’র আন্দোলনের স্টিয়ারিং এখন তৃণমূলে

সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে এক দফার আন্দোলনে ধারাবাহিক কর্মসূচিতে রয়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। হরতাল ও তিন দিন অবরোধ পালনের পর আজ থেকে আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দিয়েছে দলটি। এই সময়ে সারাদেশের সড়ক পথ, রেল পথ ও নৌ পথ অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, অবরোধের সময়ে ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের, এক জেলার সঙ্গে অন্য জেলা এবং এক উপজেলার সঙ্গে অন্য উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে। তবে অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্র ও জরুরি ঔষধ সরবরাহকারী যানবাহন অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে। যদিও এই অবরোধের মধ্যে বাস ও নৌযান চলাচল করার ঘোষণা দিয়েছে বাস মালিক সমিতি ও লঞ্চ মালিক সমিতি। তবে প্রথম দফার অবরোধেও একই ঘোষণা থাকলেও ঢাকা ছেড়ে যায়নি কোন দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চ। ঢাকায়ও চলাচল করেছে যৎসামান্য পরিবহন। যদিও মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যাত্রী না থাকায় কোন পরিবহন ছাড়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে বিরোধী দলের কর্মসূচির মধ্যে ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি জানান, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল বিকেল পর্যন্ত) বিএনপির ১৭৬জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৬টি এবং আসামী করা হয়েছে ৫৭৫ জনকে। এছাড়া গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গতকাল পর্যন্ত বিএনপির ৫ হাজার ২৩জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, মামলা হয়েছে ১১৩টি, আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৮৭ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮ জন নেতাকর্মী ও একজন নেতার স্ত্রী। এর মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির দুইজন সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেক নেতাই রয়েছেন আত্মগোপনে। অনেকেই আবার ঘরছাড়া। তবে এসব গ্রেফতার বা মামলাকে স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। চূড়ান্ত পর্যায়ের এই আন্দোলন শুরুর আগে এসব ঘটনা ঘটতে পারে সে বার্তাও তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ফলে আগে থেকেই আন্দোলনের একাধিক পরিকল্পনা সাজিয়ে মাঠে নেমেছেন তারা। বিশেষ করে এবার কেন্দ্রীয় নেতার পরিবর্তে মধ্য সারি এবং তৃণমূলের নেতাদের মাধ্যমে আন্দোলন-কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে দলটি।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলনে নামার আগে দলের একাধিক নেতা বিভিন্ন জেলা সফর করেছেন। এসব সফরে প্রস্তুতি সভার পাশাপাশি স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আন্দোলন পরিচালনার বিভিন্ন কৌশল ও পদক্ষেপও জানিয়ে দেয়া হয় তাদেরকে। পরিস্থিতি যাই থাকুক একদফা দাবিতে কঠোর কর্মসূচি থেকে পিছু না হটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। গ্রেফতার-মামলার কারণে কিছুটা চাপে পড়লেও আন্দোলনের সফলতা নিয়ে আশাবাদী দলটি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই দাবি আদায় করতে চায়। সেভাবে নেওয়া হচ্ছে নানা প্রস্তুতি। অতীতের আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, বিগত দিনে যেমন একইসঙ্গে সকল নেতাকর্মী মাঠে ছিলেন, এবার সেটি করা হচ্ছে না। আন্দোলনের দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি সরাসরি দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও কথা বলছেন। কখন কি করতে হবে দিচ্ছেন সেই নির্দেশনা। এছাড়া প্রতিটি কর্মসূচিও ঘোষণা করা হচ্ছে শেষ মুহূর্তে।
তারা আরো জানান, বিগত কয়েকবছর ধরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জেলা ও উপজেলার নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। তাদের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন আত্মিক সম্পর্ক। ফলে এসব নেতা তারেক রহমানের নির্দেশে জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দুইজন নেতা জানান, আন্দোলন শুরু হলে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হবে এটি আগে থেকেই ধারনা ছিল। তাই নেতৃত্বও সাজানো হয়েছে সেভাবে। বিশেষ করে দলের মধ্য সারি এবং জেলা ও উপজেলার নেতাদেরকে নিয়ে সাজানো হয়েছে একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা। একজনের পর একজন কিভাবে নেতৃত্ব দেয়া হবে সেভাবেও তাদেরকে প্রস্তুত করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, বিএনপির চলমান আন্দোলন পুরোপুরি পরিকল্পনা অনুযায়ীই হচ্ছে। নেতাকর্মীরা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন-এমন ধারণা নিয়েই ২ মাস ধরে দলের ৮২টি সাংগঠনিক জেলা সফর করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু নেতা। তারা নানা নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাদের ফোন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। যা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে রয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বিএনপির নেতৃত্বে অবরোধ কর্মসূচিতে ভীত হয়ে পড়েছে বলেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সরকার ভাবছে, এভাবে গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন এবং জুলুম চালালে আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বিএনপি দেশের বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। তবে মনে রাখতে হবে, এ দলটির সঙ্গে জনগণ রয়েছে। কাজেই আন্দোলন দমানোর জন্য সরকারের কোনো কৌশলই সফল হবে না। বিএনপির নেতৃত্বকেও দুর্বল করা যাবে না। কারাগারের বাইরে থাকা বিএনপির সর্বশেষ ব্যক্তিটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পদত্যাগসহ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে জনগণ সংকল্পবদ্ধ। অচিরেই অবৈধ সরকারের পতন হবে।

পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেন, চলমান আন্দোলন দীর্ঘমেয়াদী হবে এটি আমাদেরকে অবহিত করা হয়েছে। তাই একসঙ্গে সমস্ত শক্তি ক্ষয় না করে ধাপে ধাপে কিভাবে আন্দোলন বেগবান করা যায় সেই কৌশল নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া সরকার হয়তো দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করবে কিন্তু এখন ইউনিয়নের নেতারাও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করেছে। দলের একটি নেতাও অবশিষ্ট থাকতে আন্দোলন ধমকে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।

বিএনপি সূত্রে আরো জানা যায়, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি নিয়েই মাঠে থাকবে বিএনপি। এতে কাজ না হলে তফসিল ঘোষণার পর আরো কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে। এছাড়া এখন ঢাকার বাইরে আন্দোলন জোরদার করার ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী দলের শীর্ষ নেতা। তফসিল ঘোষণার আগে পরে ঢাকায় সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে থাকবেন দলের নেতারা। এজন্য দলের নেতাদেরকে আপাতত নিরাপদে থেকে যথাসম্ভব কর্মসূচি সফল করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, যারা ভাবছেন সরকারের প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে ও মিডিয়ায় অপপ্রচারের সুযোগ নিয়ে বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য ও নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে হয়, বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যার ভিত্তি হচ্ছে তৃণমূলের জনগণের শিকড়ে। তার ওপরে রয়েছে মধ্য সারির ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। সবার শীর্ষে এই দুইয়ের ওপরে শক্ত মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপিকে যারা সমন্বয় করে দিক নির্দেশনা দেয় সেই কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

তিনি বলেন, গত কয়েকদিনে আপনারা সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন যে, যাকেই যেখানে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠছে জনগণের মধ্য থেকে। যতদিন না এদেশের মানুষের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হবে ততদিন আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলতেই থাকবে। কাজেই, মিথ্যা মামলা-হামলা আর গ্রেফতার-আটক এর মাধ্যমে এই জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে না।

উৎস : দৈনিক ইনকিলাব

আরও পড়ুন