পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার সাহসের অনন্য নজির

দিলুয়ারা বেগম :: পদ্মা সেতু নিয়ে পানি কম ঘোলা হয়নি। দুর্মুখেরা চেয়েছিল শেখ হাসিনার শাসনামলে যাতে এ বিশাল সেতু নির্মিত না হয়। তাদের মনোবেদনা ছিল সত্যি সত্যি যদি শেখ হাসিনার সরকার এ সেতু নির্মাণ করতে সমর্থ হয় তাহলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবনযাত্রাই পালটে যাবে।
দেশের অর্থনীতিতে এ সেতু রাখবে বিরাট ভূমিকা- একই কারণে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা এবং তার সরকারের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে বহুগুণ। আর তাই শুরু থেকেই দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র।
আমরা সকলেই জানি যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচারে শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ় এবং শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। জন-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়েও যায় বহুদূর। যারা বাংলাদেশকে নয়া পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল- তাদের স্বপ্ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়। তরুণ প্রজন্ম এবং দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস জেনে নবচেতনায় উদ্দীপ্ত হয়।
জনগণ থেকে বিছিন্ন হয়ে ক্ষমতালোভী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি শেষমেশ দেশ-বিদেশে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্র শুরু করে। ২০১৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য চালায় জোর প্রচেষ্টা।
এ ষড়যন্ত্র বিভিন্ন সময়ে সুবিধাভোগী সামরিক-অসামরিক আমলা ও সুশীল সমাজের কিছু ব্যক্তিরও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা থাকার কথা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার এবং কথিত লবিস্টদের অপতৎপরতায় বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির প্রচেষ্টার অভিযোগ এনে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়।
কোনো কোনো বৃহৎ শক্তি এবং প্রভাবশালীদের অপতৎপরতায় অন্যান্য দাতা সংস্থাও বিশ্ব ব্যাংকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। আর এ সুযোগে চক্রান্তকারী মহল দেশে সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার ও নিন্দার তোপ দাগতে থাকে। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট, কিছু বাম সংগঠন এবং সুশীল সমাজের অনিরপেক্ষ একটি অংশ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে জনমতকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে। নির্বাচনের আগে তারা এ অপপ্রচারের সুযোগ নিয়ে খুশিতে ডগমগ করতে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘ভক্তিভজন’ কবিতায় লিখেছিলেন-

“পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’
মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’- হাসে অন্তর্যামী।”

শেখ হাসিনা যেন ত্রিকালদর্শী। ষড়যন্ত্রের ডালপালা, নাড়ি-নক্ষত্র বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। বাঙালির কপোলে ‘দুর্নীতির’ কলঙ্ক চিহ্ন এঁকে দেয়ার ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই মানবেন না তিনি। সততা আর দেশপ্রেম দিয়ে সকল ষড়যন্ত্রের জবাব দেবেন। মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন- যেখানে বিশ্ব ব্যাংক তখন একটি টাকাও ঋণ ছাড় দেয়নি- সেখানে দুর্নীতি হয় কীভাবে?
কথিত দুর্নীতির প্রচেষ্টার অভিযোগ বিশ্ব ব্যাংককে প্রমাণ করতে হবে- না হলে তাদের কাছ থেকে কোনো ঋণ নেবে না বাংলাদেশ, নিজস্ব অর্থেই আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করব। শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জ এবং সাহসী ঘোষণায় উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ। এ শুধু সরকার বা দলের বিষয় নয়- জাতির সম্মান ও মর্যাদার বিষয়।
সকল ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে ৭ ডিসেম্বর ২০১৪ শুরু হলো পদ্মা বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতুর নির্মাণ কাজ। এ যেন গর্বিত বাঙালির স্বপ্নযাত্রা। সেতু সম্পর্কে কিছু তথ্য দেয়া সমীচীন মনে করছি। নদীর উপর পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। জাজিরা এবং মাওয়া দু’প্রান্তে সংযোগ সড়ক ১৪ কিলোমিটার।
দুই প্রান্তে নদীশাসন ১২ কিলোমিটার। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির উপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ- নিচের স্তরে থাকবে রেলপথ। ব্রডগেজ এবং মিটার গেজ দু’টোরই সুবিধা থাকবে এখানে। পানির সর্বোচ্চ স্তর থেকে সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট। পদ্মা সেতুর মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি। প্রতিটি পিলারের নিচে পাইলিং হয়েছে ৬টি করে। তবে মাটির জটিলতার কারণে ২২টি পিলারের পাইলিং হয়েছে ৭টি করে। মোট পাইলিং এর সংখ্যা ২৮৬টি। প্রতিটি পাইলিংয়ের গভীরতা ৩৮৩ ফুট। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পদ্মা সেতুর নদীর অংশের দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কি.মি.। এ ছাড়াও নদীর তীর সংলগ্ন দুই পাড়ে আরও প্রায় ৪ কি.মি. সেতু নির্মাণ করা হয়। এটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং ভাষায় বলা হয় ‘ভায়াডাক্ট’। এর মধ্যে স্টিলের কোনো স্প্যান নেই। এ অংশে মোট পিলারের সংখ্যা ৮১টি। এগুলোকে বলা হয় ভায়াডাক্ট পিলার। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে শুধু ট্রেন এবং গাড়িই চলবে না- এই সেতুতে থাকবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার পরিবহন সুবিধা।
আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সেতুটি নির্মাণের কন্ট্রাক্ট পায় চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের আওতাধীন ‘চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি’। মূল সেতু নির্মাণের দরপত্রে ৩টি কোম্পানি অংশ নিলেও একমাত্র চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয় এবং দরপত্রের শর্ত মোতাবেক তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

পদ্মা সেতু নির্মাণের নদীশাসনের দরপত্রেও ৩টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এগুলো হলো কোরিয়ান হুন্দাই কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন এবং বেলজিয়ামের দাজানদিনাল। পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ পায় বাংলাদেশের আব্দুল মোনেম লিমিটেড।
পদ্মা সেতুর মোট নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩.৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, তিনটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় অধিগ্রহণকৃত ৯১৮ হেক্টর ভূমির মূল্য পরিশোধ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। বাংলাদেশ সরকারের অর্থ বিভাগ- সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগকে বার্ষিক ১% সুদে ৩৫ বছরে পরিশোধের শর্তে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর ২০১৪। প্রায় পৌনে তিন বছর পর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শরিয়তপুর জেলার জাজিরা প্রান্তে সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নং পিলারের উপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে প্রথম স্প্যান বসানো হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ১২ ও ১৩ নং পিলারে ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পুরো সেতু দৃশ্যমান হয়। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার- সে হিসেবে নদীর উপর সেতুর মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৬.১৫ কি. মি.। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, ইতিপূর্বে যমুনা নদীর উপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুই ছিল বাংলাদেশের দীর্ঘতম সড়ক ও রেল সেতু- যার দৈর্ঘ্য ৪.৮ কি. মি.। সেই সেতুর নির্মাণকাজ সমাপ্ত করার ক্ষেত্রেও ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া এ অঞ্চলে ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এই সেতু দিয়ে শুধু ট্রেন চলাচল করতে পারে। এ সেতুর দৈর্ঘ্য ১.৮ কি. মি.।
পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকারকে দু’টো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। এ লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে সম্পদ বৃদ্ধির জন্য করারোপ এবং অনেক নতুন খাতকে ভ্যাটের আওতাভুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারকে বিশেষভাবে বিবেচনা রাখতে হয়েছে যাতে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত না হয়।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান স্বাভাবিক রাখার বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। সরকার সাফল্যের সঙ্গে সম্পদ আহরণের এ প্রচেষ্টায় সাফল্য অর্জন করে। সর্বস্তরের জনগণের সহায়তা না পেলে সরকারের একার পক্ষে হয়তো এ অর্থ সংগ্রহে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতো।
পদ্মা সেতু নির্মাণের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রমত্তা পদ্মার খেয়ালি চরিত্র। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর পর পদ্মাই হলো সবচাইতে খরস্রোতা ও গভীরতম নদী। নদীতে স্রোতের গতিপথ বার বার পরিবর্তিত হওয়ায় সেতুর নির্মাণকাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তী সময়ে ডিজাইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হয়। স্রোত এবং গভীরতার কারণে ২২টি পিলারে পাইলিংয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পদ্মা বহুমুখী সেতুর নকশা এইসিওএম-এর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ দল প্রণয়ন করে। জাতীয় বিশেষজ্ঞ দলের নেতৃত্ব দেন প্রয়াত ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।
পদ্মার মতো খরস্রোতা ও গভীর নদীতে সেতু নির্মাণ ও নদীশাসন ঝুঁকিপূর্ণ ও দুরূহ কাজ। পদ্মার দুই পাড়ে নদীশাসন হচ্ছে ১২ কি. মি.। এটি একটি বহুমাত্রিক কাজ। নদীর তলদেশ খনন করে ২১২ কোটি ঘনফুট বালি উত্তোলন ও অপসারণ সহজ কাজ নয়। নদীশাসনের জন্য ১ কোটি ৩৩ লাখ কংক্রিটের ব্লক এবং ২ কোটির বেশি বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের সকল ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে যখন সেতু নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের পথে তখন গুজবের আশ্রয় নেয় ষড়যন্ত্রকারীরা। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করা হয় যে, পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে। দ্রুত গুজব ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। দেশের বিভিন্নস্থানে প্রতিবন্ধী এবং মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি এই গুজবের শিকার হয়ে নিগৃহীত হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করে ৯ জুলাই ২০১৯ সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে এক বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এ ধরনের গুজব ছড়ানো থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়।
নিন্দুক এবং ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা থেমে নেই। শেখ হাসিনার সরকার যখন দেশি-বিদেশি সকল চক্রান্ত এবং প্রমত্তা পদ্মার খেয়ালি আচরণকে বাগে এনে ১০ ডিসেম্বর ২০২০ পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি স্থাপন করে নদীর উপর ৬.১৫ কি. মি. সেতু দৃশ্যমান করল, তখন যেন তাদের মাথায় বাজ পড়ল। কী কষ্ট তাদের মনে!
দুর্নীতির অভিযোগ কানাডার আদালতে ইতোমধ্যে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে দেশীয় অর্থে বিশাল মেগাপ্রজেক্ট সম্পূর্ণ করল শেখ হাসিনা সরকার। বিশ্বব্যাপী করোনা সংকটের মধ্যেও পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ মন্থর হলেও বন্ধ থাকেনি।
২০২১ সালের ডিসেম্বর কিংবা ২০২২ সালের মার্চে পদ্মা সেতু যানবাহন ও রেল চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষে জাতির জন্য শেখ হাসিনা সরকারের এ এক বড় উপহার।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবনে নতুন সূর্যোদয় ঘটবে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে এক বিশাল জনগোষ্ঠী। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কৃষকের উৎপাদিত পণ্য আর খামারিদের দুধ পৌঁছে যাবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পদ্মা সেতু রাখবে এক বিরাট ভূমিকা।
পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশকে এখন আর কারো অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই।

খাদ্য উৎপাদনসহ বহুক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থে নির্মাণ করে বাংলাদেশ আজ তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। জাতির এ গৌরবের অংশীদার দেশের ১৭ কোটি মানুষ। কিন্তু আমাদের সমাজের কিছু লোক আছে, দল আছে যাদের ভালো কাজে গাত্রদাহ হয়। দেশের উন্নয়ন, মর্যাদায় তারা যেন খুশি নন। আর শেখ হাসিনা যদি এসব ভালো কাজের কাণ্ডারি হন- তবে তো কথাই নেই। ছিদ্রান্নেষণ করে এর ত্রুটি বের করতেই হবে। সেটিও যদি পাওয়া না যায়, তবে মনগড়া মিথ্যাচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার শেষ অস্ত্রও ব্যবহার করতেই হবে। সকল প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু যখন নির্মিত হয়েই গেল; তখন এই নিন্দুকদের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট শুরু হয়ে গেল।
এদের বাঁচার উপকরণ হলো মিথ্যাচার। এরা বলতে শুরু করল পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ অনেক বেশি হয়েছে- দুর্নীতি হয়েছে। সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা করা বিরোধী দলের দায়িত্ব এবং সেটা করাই উচিত। কিন্তু সমালোচনা আর মিথ্যাচার ও কুৎসার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
যারা পদ্মা সেতু নিয়ে এসব বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন- তারা কি গত ১২ বছরে সরকারের একটি ভালো কাজেরও প্রশংসা করেছেন? নিজস্ব অর্থে এত বড় সেতু নির্মাণ করায় সরকারের প্রশংসা করে, তারপর ত্রুটি-বিচ্যুতির সমালোচনা করা কি যৌক্তিক হতো না? আসলে এরাতো তারাই- সেতু নির্মাণের আগেই বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়ে দেশকেই ছোট করেছে।
এ সকল রাজনৈতিক নেতা এবং অনিরপেক্ষ বিশিষ্টজনেরা ভালো করেই জানেন পদ্মা সেতুর ব্যয় কেন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সত্যটাকে আড়াল করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো বক্তব্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশল তারা নিয়েছে। বিবেকবোধসম্পন্ন সাধারণ মানুষও জানেন কেন পদ্মা সেতুর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ কথা সকলেরই জানা যে, প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এ সেতু নির্মাণের কাজ শেষ হবার কথা ছিল ২০১৩ সালে। কিন্তু বিশ্ব ব্যাংক এবং অন্যান্য দাতাসংস্থা মিথ্যা অভিযোগ এনে ঋণ প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে কাজ শুরু করে।
অর্থের জোগান এবং কাজ শুরু হতে কিছুটা বিলম্ব হয়। দ্বিতীয়ত, পদ্মার প্রবল স্রোতে এবং ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় সেতু নির্মাণে এবং নদীশাসনের ডিজাইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হয়েছে। পিলারে পাইলিংয়ের গভীরতা এবং সংখ্যা দু’টোই বৃদ্ধি পায়। একই কারণে কখনো কখনো কাজের গতি শ্লথ এবং দীর্ঘায়িত হয়।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ-সামগ্রীর উৎসস্থল চীনের উহানে ভয়াবহ করোনার প্রাদুর্ভাবে সেতুর মালামাল তৈরি এবং সরবরাহে বিলম্ব ঘটে। বাংলাদেশে সেতু নির্মাণে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি অনেক শ্রমিক ও কারিগরি কর্মকর্তা করোনায় প্রাণ হারান। এ জটিল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতেও পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ কখনো থেমে থাকেনি। সকল বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সরকারের দৃঢ় অবস্থান এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতায় পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রথম যখন পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়- তখন শুধু সড়কপথ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সময় ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট সড়ক সেতুর নির্মাণব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ২০১১ সালে শুরু করে ২০১৩ সালে সমাপ্ত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পদ্মা সেতুতে রেলপথ যুক্ত করেন এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস, অপটিক্যাল ফাইবার লাইন যুক্ত করায় এটি বহুমুখী সেতুর চরিত্র অর্জন করে।
সে সময় সংশোধিত বাজেট দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সেতু নির্মাণে বাস্তব পরিস্থিতির কারণে বার বার ডিজাইন পরিবর্তন এবং সময় দীর্ঘায়িত হওয়ায় পরবর্তী সময়ে দেশি-বিদেশি পরামর্শক প্যানেলের সুপারিশের ভিত্তিতে দ্বিতীয়বার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ব্যয় আরও ১৪ শ’ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে পদ্মা সেতুর মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৭৯৩.৩৯ কোটি টাকা।
এ কথা সকলের জানা যে, বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্যাস সরবরাহ, তথ্য প্রযুক্তির প্রসার, রপ্তানি এবং শিল্পায়নের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন স্থাপন, পোশাক শিল্প ও শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রির প্রসার, দেশব্যাপী যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ব্যাপক উন্নয়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মৎস্য উৎপাদনে বিপুল অগ্রগতি, ওষুধ শিল্পে বিদেশি বাজার দখল, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সম্প্রসারণসহ সার্বিকভাবে দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে অগ্রসরমান।
আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যখন বিশ্বের গণমাধ্যমসমূহ শেখ হাসিনার সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনকল্যাণে গ্রহণ করা নানাবিধ কর্মসূচির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন- তখন আমাদের দেশের একটি বিশেষ মহলের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।
যারা মনগড়া দুর্নীতির কথা বলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন, তারা আজও বলতে পারেননি এই সেতুর কোন কাজে কোথায় দুর্নীতি হয়েছে। যারা সমালোচনা করছেন তারা এবং তাদের স্বগোত্রীয় বন্ধুরা দীর্ঘ ২১ বছর দেশ শাসন করলেও দেশ ও জনগণের কল্যাণে এ ধরনের একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে পারেননি। শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা আজ মিথ্যাচারে নেমেছে। নিজেদের অযোগ্যতা, অক্ষমতাকে আড়াল করার জন্য পরনিন্দা যাদের ব্রত তাদের কাছে এর চাইতে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আমরা মুখে বলি ‘দলের চাইতে দেশ বড়’ কিন্তু বাস্তবে করি তার উলটোটা। পদ্মা সেতুর মতো এত বড় একটা সেতু নির্মাণ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকেও বিস্মিত করেছে- শুধু দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সে কাজের প্রশংসা আমরা করতে পারলাম না।
সারা বিশ্ব যখন শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম, সততা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নে পারঙ্গমতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে, তখন আমাদের এসব দলকানা এবং অনিরপেক্ষ সুশীল সমাজের সদস্যরা অনুবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়ে পদ্মা সেতুর ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজতে লেগে গেল। কথায় বলে না, ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’। এদের অবস্থা হয়েছে অনেকটা সেরকম।

আরও পড়ুন