নারীর অনিয়মিত মাসিক নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি
ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ :: নারীর অনিয়মিত মাসিক নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের প্রয়োগ সংকেত নিয়ে আজকের নিবন্ধ।
মেনোপজ বা নারীর মাসিকের ক্ষেত্রে বেশিরভাগেরই বছরে ১১ থেকে ১৩ বার হয়ে থাকে। এর যে ব্যতিক্রম হয় না, তা নয়। তা নির্ভর করে ব্যক্তিভেদে। কারো কারো এর বেশি বা কম হতে পারে। তাই কোনো নারীর মাসিক অনিয়মিত কিনা, তা নির্ভর করে তার স্বাভাবিক মাসিক চক্রের ওপর। সাধারণত প্রথমবার মাসিক শুরু হওয়ার পর শরীরে হরমোনগত বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। ফলে প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত মাসিক অনিয়মিতভাবে হতে পারে। তবে মাসিক বন্ধ হওয়ার পূর্বাবস্থায়ও মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। বেশিরভাগ নারী এটি মেনেপজ শুরু হওয়ার পূর্বলক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। গর্ভধারণের কারণেও মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। তবে সন্তানসম্ভবা কিনা, তা পরীক্ষা করেই জেনে নিতে হবে।
মাসিক অনিয়মিত হওয়ার কারণ : মাসিক অনিয়মিত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সন্তানসম্ভবা হলে এবং সন্তান জন্মের পর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। খাদ্যভ্যাসে ত্রæটি যেমন- ক্ষুদামন্দার কারণে মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়তে পারে। ওজন খুব কমে গেলে ও অতিরিক্ত অনুশীলনের কারণে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ডোম বা পিসিওএস হলো একটি হরমোনজনিত ব্যাধি। এ অবস্থায় ডিম্বাশয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির সিস্ট দেখা দেয়। অপরিণত অবস্থায় ডিম্বাশয়ের কার্মকারিতা নষ্ট হয়ে গেলে একজন নারীর দীর্ঘ সময়ের জন্য মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় একজন নারীর চল্লিশ বছর বয়সের আগেই ডিম্বাশয়ের স্বাভাবিক কার্মক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ বা পি আইডিতে আক্রান্ত হলে নারীর জননেন্দ্রিয়ে ইনফেকশন হয়। ফলে মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ইউটেরাইন ফাইব্রয়েডস হলো জরায়ুর এক ধরনের টিউমার। এটি ক্যানাসার সৃষ্টি করে না সত্য, তবে জরায়ুতে টিউমার হলে মাসিকের সময় বেশি রক্তপাত হয় এবং মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
মাসিক অনিয়মিত হওয়ার লক্ষণ: এ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলো- মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, পেটে তীব্র ব্যথা, মাসিকের সময় ব্যথা হওয়া, পেলভিস বা শ্রেণিচক্রে ব্যথা হওয়া, যোনি দিয়ে ¯্রাব নির্গত হওয়া, হঠাৎ গরম অনুভব করা, ঘাম হওয়া, অনিচ্ছায় মূত্রত্যাগ, দীর্ঘায়িত মাসিক, বন্ধ্যত্ব, মাংসপেশির খিঁচুনি বা টান, মাসিকের আগে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়া।
মাসিক অনিয়মিত হলে ক্ষতি: অনিয়মিতের ক্ষেত্রে বয়স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনÑ যেসব অল্পবয়সী নারীর এগারো বছর বয়সেই মাসিক শুরু হয়ে যায়, তার পরবর্তীকালে মাসিক চলাকালীন তীব্র ব্যথা হতে পারে। একই সঙ্গে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি সময় মাসিক স্থায়ী হয়। ২০-৯০ শতাংশের ক্ষেত্রেই মাসিকের সময় ব্যথা হয় এবং ১৫ শতাংশের ক্ষেত্রে ব্যথা তীব্র হয়। মেনোপজের আগে বা পেরিমেনোপজ পর্যায়ে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। একই সঙ্গে মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাতও হতে পারে। এছাড়াও যেসব কারণে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে তা হলো Ñ অতিরিক্ত মেদ বেড়ে যাওয়া, ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ, দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ। বেশ কয়েকবার সন্তান প্রসব করা ইত্যাদি। আবার একটিও সন্তান জন্ম দেননি, এমন নারীরও মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা হতে পারে।
পরামর্শ: রোজ নিয়মিতভাবে শীতল জলে স্নান উপকারী। অবশ্য রোগীর সহ্য শক্তি অনুসারে। শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম খুব বেশী করা উচিত নয়। স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় সাধারণ নিয়মকানুন সর্বদাই মেনে চলতে হবে। রাত জাগরণ নিষেধ। আহার ও পানীয় গ্রহণে যথেষ্ট সতর্কতা থাকতে হবে। সহজে পরিপাক দ্রব্যাদি খাওয়া নিষেধ। যথারীতি এবং সময়মত আহার এবং নিদ্রা। ব্যবহৃত জামা কাপড় সর্বদাই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ক্যালেন্ডার অথবা ডায়েরিতে মাসিক শুরু বা শেষ হওয়ার তারিখ এবং মাসিকের আগের উপগর্সগুলো লিখে রাখা যায়। যাতে কোনো আস্বাভাবিকতা সহজেই বোঝা যায়। মাসিকের সময় সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। তবু রক্তপাত বেশি হলে বিশ্রাম নিতে হবে। চিকিৎসকেরও পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
যোগব্যায়াম: অত্যধিক বিলাসবহুল নারীরাই প্রায় এই রোগে কষ্ট পান। এটি সকল বয়সে এবং সবসময় হতে পারে। নি¤œলিখিত আসনগুলো অভ্যাসে এই রোগে ভাল ফল পাওয়া যায়। যেমনÑসকালে বস্তিক্রিয়া, সর্বাঙ্গাসন, মৎস্যাসন, হলাসন, যোগমুদ্রা, নৌলিক ক্রিয়া, উষ্ট্রাসন, শীর্ষাসন, ভদ্রাসন।
হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান: অনিয়মিত মাসিক নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিতে ফলদায়ক ওষুধ আছে। নির্দিষ্ট মাত্রায় লক্ষ্য সাদৃশ্যে নিম্নলিখিত ওষুধ ব্যবহারে এই রোগ সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে।
১) ক্যালকেরিয়া কার্ব,২) পালসেটিলা,৩) কোনিয়াম,৪) সিপিয়া ৫) ম্যাগনেসিয়া কার্ব ৬) ফসফরাস ৭) সিনিসিও ৮) প্লাটিনা,৯) কার্বোভেজ ১০) ইগ্নেসিয়া ১১) থুজা ১২) মেডোরিনাম ১৩) সালফার ১৪) কেলিকার্ব ১৫) ইপিকাক ও ১৬) ল্যাকেসিস উল্লেখযোগ্য। তারপরেও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করা উচিত।
লেখক : ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ (ডি.এইচ.এম. এস (ঢাকা), এম.এ, হোমিও চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক।
আরও পড়ুন :