ভূমিকম্প সম্পর্কে আপনি কতটুকু সচেতন

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান :: ভূমিকম্প দুয়ারে আঘাত হানলেই আমরা দিক-বিদিক ছুটাছুট করি। কিন্তু আমাদের করণীয় বিষয়ে কতটুকু সচেতন একটু চিন্তা করে দেখি। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলকে প্রশ্ন করেই এ বিষয়ে হতাশজনক উত্তর পাওয়া গেছে। শিক্ষিত মহিলাও রান্না ঘরের গ্যাসের চুলাটা নিভাতে ভুলে যান। আচ্ছা বলুনতো, আমাদের কয়জনের বাসায়/এপার্টম্যান্টে ইমারজেন্সি এক্সিট (জরুরি সময়ে বের হওয়ার বিকল্প) দরজা আছে বা তার চাবিটা কোথায় রেখেছেন? যাই হোক, আসুন ঝটপট জেনে নেই ভূমিকম্পের সময় আমাদের করণীয় কী?

শুরুতেই বলি, ভূকম্পন অনুভূত হলে আতঙ্কিত হবেন না। এ সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনো আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিন। ঘরের বীম, কলাম ও পিলার ঘেষে আশ্রয় নিন। রান্না ঘরে থাকলে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দ্রুত বেরিয়ে আসুন। ঘরের বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দিন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে স্কুল ব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চ অথবা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন।

আপনি যদি কর্মক্ষেত্রে বা ঘরের বাইরে থাকেন তাহলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদি থেকে দূরে খোলা স্থানে আশ্রয় নিন। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী, হাসপাতাল, মার্কেট ও সিনেমা হলে থাকলে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি না করে দু’হাতে মাথা ঢেকে বসে পড়ুন এবং ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসুন। গাড়ীতে থাকলে ওভারব্রীজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে সরে গাড়ি থামান। ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভিতরে থাকুন। উপর তলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে বা লিফট ব্যবহার করে নামা থেকে বিরত থাকুন। কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ুন এবং খোলা আকাশের নিজে অবস্থান নিন।

ভূমিকম্পের বৈশিষ্ট্য হলো একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিন। সাধ্যমত পাড়া-প্রতিবেশীদের এ নিয়ম মেনে চলতে অনুপ্রাণিত করুন। আর আপনি ভাঙ্গা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়া-চড়ার চেষ্টা করবেন না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন, যাতে ধুলাবালি শ্বাস নালিতে না ঢোকে। যে কোনো দুর্যোগের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে বাড়িতে ব্যাটারি চালিত রেডিও, টর্চলাইট, কিছু পানির বোতল, শুকনা খাবার, মাক্স এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম রাখুন।

জাপানে 1995 সালে গ্রেট হানসিন আওয়াজি ভূমিকম্পন জনিত কারণে ইলেকট্রিক ও গ্যাসের লাইন বিছিন্ন হয়ে ১৪ মিনিটে ৫৪টি স্থানে অগ্নিকান্ড ঘটেছিল। তাই ঘরে একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র (ইস্টিঙ্গুইসার) রাখা একান্ত আবশ্যক। ভূমিকম্পন জনিত কারণে অগ্নিকান্ড ঘটলে সবাই বিল্ডিং এর ছাদে দৌড়ে উঠে যায়। কিন্তু নামার উপায় কী? বিল্ডিং এর ছাদে দুইটা মোটা রশি রাখলে আপনি উদ্ধারের পথ পেতে পারেন। প্রত্যেক গ্রামে, কলোনিতে বা বিল্ডিংয়ে অগ্নিনির্বাপক বা ভূমিকম্প থেকে উদ্ধার যন্ত্রপাতি রাখা উচিত। কলোনিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইনের এন্ট্রি পয়েন্টে মেইন সুইচ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ভূমিকম্প বা অগ্নিকান্ড ঘটলে মেইন সুইচ বন্ধ করে দেয়া যায়।

বাসা বা অফিসে ভূমিকম্পের সময় কাঁচ জাতীয় ফার্নিচার থেকে দূরে থাকুন। আপনি তো নিজের জন্য নিজের কষ্টার্জিত টাকায় বাড়ি করছেন। তাই ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে নিজের নিরাপত্তার জন্যই বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করুন।

জাপানের অভিজ্ঞতা বলছি, ওখানে ভূমিকম্পে নিহত মানুষের ৭% ঘরের ফার্নিচারের আঘাতে মারা গেছে। তাই আপনার ঘরের /অফিসের আলমিরা, টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদি দেয়ালে বা ফ্লোরের সাথে সম্ভব হলে ফিক্স করে দিন।

জাপানীরা বলে থাকে “you can’t suddenly react on disaster, you must undergo drills during normal time”, অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিকে দেখেছি ভূমিকম্পে করণীয় বিষয়ে কিছুই জানেন না। ড্রিল ছাড়া এটা সম্ভব না। নিজ নিজ কমিউনিটিতে ফায়ার সার্ভিসের লোকদের সহায়তার ড্রিলের ব্যবস্থা করতে হবে। জাপানে প্রতি তিন মাস অন্তর এটা করে থাকে। নিজ বাসায় বা কর্মস্থলে ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা করুন।

একটা ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কী ধরনের ঝাঁকুনি হতে পারে তার ড্রিল করার সুযোগ পেয়েছিলাম জাপানে। ধরুন, আপনি কোনো একটা অফিসে বসে আছেন, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে আপনি সামনের টেবিল ঝাপটে ধরে থাকলেও টেবিলসহ ছিটকে পড়ে যাবেন। টেবিলটা ফ্লোরের সাথে স্ক্রু দিয়ে শক্তভাবে আটকানো থাকলে আর সেটা শক্ত করে ঝাপটে ধরে থাকলে হয়তো সে যাত্রায় বেঁচে যাবেন। কিন্তু বাসা বা অফিসের আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ ইত্যাদি তছনছ হয়ে যাবে। তার আঘাতে পরিবারের সদস্যরা আহত হবেন। কিন্তু আমাদের দেশে চেয়ার-টেবিল, খাট-আলমিরা, কোনো কিছুই ফ্লোরের সাথে স্ক্রু দিয়ে আটকানো থাকে না। আলমিরা-খাটতো দীর্ঘদিন একই স্থানেই থাকে। আমরা সহজেই এগুলো ফ্লোরের সাথে স্ক্রু দিয়ে আটকে দিতে পারি। সবচেয়ে ভালো হয় ওয়ালের সাথে ফিক্স আলমিরা ব্যবহার করলে।

একটা বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে আমরা কোথায় আশ্রয় নেবো, কোন পথে আশ্রয় কেন্দ্রে যাবো তার দিক-নির্দেশক সিটি করপোরেশন করে দেয়নি। আসলে এখনো আমাদের শহুরে আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণাই তৈরি হয়নি। ধরে নেওয়া যাক, আমরা শহরের খোলা মাঠে গিয়ে আশ্রয় নিবো কিন্তু এমন একটা পথ থাকা চাই যে পথে আশ্রয় কেন্দ্রে গেলে বিদ্যুতের ছেঁড়া তার, গ্যাসের পাইপলাইন পড়বে না। কারণ, এমন পথে গেলে আপনি নিশ্চিতই ঝুঁকিতে পড়বেন। জাপানে শহুরে আশ্রয়কেন্দ্র নির্দিষ্ট করা আছে। জরুরি সেবা প্রদানের জন্য প্রত্যেক আশ্রয়কেন্দ্রের ছাদে হেলিকপ্টার নামার ব্যবস্থা আছে। প্রত্যেক আশ্রয়কেন্দ্রে একাধিক লাইনের বিদ্যুৎ আছে, একাধিক লাইনের পানি সরবরাহ আছে। সে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথ-নির্দেশক তীরের মত করে দেখানো আছে। সেখানে প্রত্যেক কমিউনিটির জন্য হেঁটে যেতে পাঁচ-সাত মিনিট লাগে এমন পরিধির মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র আছে। এতে ভূমিকম্পের কারণে পরিবারের কোনো সদস্য নিখোঁজ রইল কিনা সনাক্ত করা সহজ হয়। তাদের খাবার, চিকিৎসা, রাত্রি যাপনের ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। পর্যাপ্ত শুকনো খাবার থাকে সেখানে। প্যাকেটগুলোর খাবার পাঁচ বছর পর্যন্ত ভাল থাকে। মাঝারি মানের দেওয়াল অপসারণ, রাস্তা পরিষ্কার, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের সকল উপকরণ সে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে। ড্রিল করে কমিউনিটির সকলকেই প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়েই পানির মোটা পাইপ বসানো থাকে।

জাপানের আশ্রয়কেন্দ্রে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, ধোলাই মেশিন সবই আছে। কারণ ভূমিকম্প ধনী-গরিব বাছ-বিচার করে না। একজন গরিব মানুষ সাধারণ ব্যবস্থাপনায় থাকা-খাওয়া করতে পারে। কিন্তু একজন ধনী মানুষ হয়তো এসি ছাড়া থাকতে পারে না, ধোলাই মেশিন ছাড়া কাপড় পরিষ্কার করতে পারে না, তার জন্য তো ব্যবস্থা থাকা চাই।

বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে, প্রতি একশো বছর পরপর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশে ১৮৯৮ সালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল এলাকার ভূমিরূপের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। একশো বছর পার হয়ে গেছে। ভূমিকম্পের ছোট ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে প্রকৃতি আমাদের সতর্ক হতে বলছে। আসুন, আমরা নিজ নিজ পরিসরে ভূমিকম্প নিয়ে সচেতন হই, সতর্ক হই, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করি।

লেখক: মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ।

আরও পড়ুন :

ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে শিশুদের অধিকার ও পরিবেশ উন্নয়নের আহবান

আমি বাজের মতই এক ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছিলাম—গো অন, চার্জ

গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা : বর্তমান প্রবণতা

আরও পড়ুন