আমি বাজের মতই এক ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছিলাম—গো অন, চার্জ
‘রাত ১০টা থেকেই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। দূর থেকে তখন গুলির শব্দ ভেসে আসছিল। দেখলাম প্রতিটি শব্দ-তরঙ্গের সাথে সাথে শেখ সাহেব সমস্ত ঘরটার মাঝে পাইচারী করছিলেন। অস্ফুটভাবে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলছিলেন- এভাবে বাঙালীকে মারা যাবে না। বাংলা মরবে না। রাত ১২টার পর থেকেই গুলির শব্দ এগিয়ে এলো। ছেলেমেয়েদের জানালা বন্ধ করতে যেয়ে দেখতে পেলাম পাশের বাড়ীতে সৈন্যরা ঢুকে পগেছে। স্পস্ট মনে আছে এ সময় আমি বাজের মতই এক ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছিলাম— গো অন, চার্জ —।’
১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ দৈনিক বাংলায় এক স্মৃতিচারণমূলক সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে সে রাতের অনেক কথাই উঠে এসেছে। এসব কথা ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ তথ্য। নতুন প্রজন্ম এ থেকে জানতে পারবে ৩২ নম্বরে সে রাতে কি ঘটেছিল। দৈনিক বাংলা সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম দিয়েছিল ‘প্রথম থেকেই ইয়াহিয়া পশুটাকে আমি বিশ্বাস করতাম না: বেগম মুজিব’। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
“গত বছরের এই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গেলে প্রথমেই আমার মন কেঁদে ওঠে। সেই ভয়াল ২৫শে মার্চের কালো রাত থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পযর্ন্ত এ দেশের পরিজন-হারা লাখো লাখো পরিবারের কথা ভেবে অশান্ত হয়ে ওঠে মন। তাই পৃথক করে হিংস্র ঐ রাতের কোন কথা বলতে বা ভাবতে আমার মন সায় দেয় না। বললেন শেখ ফজিলতুন্নেসা মুজিব। কথা বলছিলাম ৩২ নং রোডের সেই। একটা বছর আগের একরাশ স্মৃতির ছায়ায় বসে বেগম মুজিব বলছিলেন অবিস্মরণীয় সেই ২৫শে মার্চের রাত ও তারও আগেকার দিনগুলোর কথা।
অসহযোগ আন্দোলনের সেই অনন্য দিনগুলো। ধনী-দরিদ্র শিক্ষিত- অশিক্ষিত বাংলার মানুষ এক হয়ে গেছে। ঠিক এমনি মুহুর্তে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে ইয়াহিয়া ঢাকা বাংলায় এলো। প্রথম থেকেই পাকিস্তানী নৃশংস এই পশুটাকে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না। আলোচনা বৈঠকের প্রথম থেকেই এক অশুভ কালো ছায়াকে আমি যেনো দেখতে পেয়েছিলাম সেদিনের জাগ্রত বাংলার অঙ্গনে। শেখ সাহেবকেও আমি বলেছিলাম যারা তাঁকে আগরতলা মামলায় জড়িয়েছে, তারা ভালোভাবেই জানে যে শেখ সাহেব বাংলাদেশ আর বাঙালীদের চিন্তা-ভাবনাই করেন- পাকিস্তান প্রশ্নে তার আগ্রই নেই। পাকিস্তানের ক্ষমতা তারা শেখ সাহেবকে দেবে না। কাজেই আলোচনা আরম্ভ করে তারা অন্য কোন নতুন কৌশল বের করার সুযোগ খুঁজছে মাত্র। আমার কথা শেখ সাহেব শুনলেন। মুখে কিছুই বললেন না। তিনি দলীয় নেতাদের বৈঠক ছাড়া বাইরে তেমন কিছু বলতেন না তখন।
গত বছর ২৫শে মার্চের সকাল থেকে বাড়ির অবস্থা ভার ভার লাগছিল। দুপুর তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। আমাদের বাসার সামনে দিয়ে সৈন্য বোঝাই দুটো ট্রাক চলে গেল। দোতলা থেকেই ট্রাকগুলো দেখে আমি নীচে নেমে এলাম। শেখ সাহেব তখনো আগত লোকদের সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত। তাঁকে ভেতরে ডেকে মিলিটারি বোঝাই গাড়ী সম্বন্ধে বলতেই দেখলাম পলকের তরে মুখটা খুব গম্ভীর হয়ে গেল। পরক্ষণেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। সমস্ত দিনটা কেটে গেল থমথমে ভাবে। এলো রাত। সেই অশুভ রাত। রাত সাড়ে আটটায় তিনি সাংবাদিকদের বিদায় দিলেন। আওয়ামী লীগ সহকর্মীদেরও কিছু কিছু নির্দেশ দিয়ে দ্রুত বিদায় দিলেন।
রাত প্রায় ১০টার কাছাকাছি। বাগান থেকে এক ভদ্রলোক এসে শেখ সাহেবের সামনে একেবারে আছড়ে পড়লেন। তার মুখে শুধু এক কথা-আপনি পালান। বঙ্গবন্ধু পালান। ভেতর থেকে তার কথা শুনে শঙ্কিত হয়ে উঠলো আমারও মন। বড় মেয়েকে তার ছোট বোনটাসহ তার স্বামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। যাবার মুহুর্তে কি ভেবে যেনো ছোট মেয়েটা আমাকে আর তার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। শেখ সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বললেন-বিপদে কাঁদতে নেই মা।
তখন চারিদিকে সৈন্যরা নেমে পড়েছে। ট্যাঙ্ক বের করেছে পথে। তখন অনেকেই ছুটে এসেছিল ৩২ নং রোডের এই বাড়ীতে। বলছিল-বঙ্গবন্ধু আপনি সরে যান। উত্তরে দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়েছিলেন তিনি-না কোথাও আমি যাব না। রাত ১০টা থেকেই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। দূর থেকে তখন গুলির শব্দ ভেসে আসছিল। দেখলাম প্রতিটি শব্দ-তরঙ্গের সাথে সাথে শেখ সাহেব সমস্ত ঘরটার মাঝে পাইচারী করছিলেন। অস্ফুটভাবে তিনি বলছিলেন- এভাবে বাঙালীকে মারা যাবে না। বাংলা মরবে না। রাত ১২টার পর থেকেই গুলির শব্দ এগিয়ে এলো। ছেলেমেয়েদের জানালা বন্ধ করতে যেয়ে দেখতে পেলাম পাশের বাড়ীতে সৈন্যরা ঢুকে পগেছে। স্পস্ট মনে আছে এ সময় আমি বাজের মতই এক ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছিলাম— গো অন, চার্জ —-
সেই সাথে সাথেই শুরু তলে অঝোরে গোলাবর্ষণ। এই তীব্র গোলাগুলির শব্দের মধ্যেও অনুভব করলাম – সৈন্যরা এবার আমার বাড়ীতে ঢুকেছে। নিরুপায় হয়ে বসেছিলাম আমার শোবার ঘরটাতে। বাইরে থেকে, মুসলধারে গোলাবর্ষন হতে থাকলো এই বাড়ীটা লক্ষ্য করে। ওরা হয়ত এই ঘরটার মাঝেই এমনিভাবে গোলাবর্ষণ করে হত্যা করতে ছেয়েছিল আমাদেরকে। এমনভাবে গোলাবর্ষিত হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল সমস্ত বাড়ীটা বোধহয় ধ্বসে পড়বে। বারুদের গন্ধে মুখচোখ জ্বলছিল। আর ঠিক সেই দুরন্ত মুহুর্তটাতে দেখছিলাম ক্রুদ্ধ সিংহের মত সমস্ত ঘরটার মাঝে অবিশ্বাস্যভাবে পায়চারী করছিলেন শেখ সাহেব। তাঁকে ঐভাবে রেগে যেতে কখনও আর দেখিনি।
রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে ওরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে উপরে উঠে এলো। এতক্ষণ শেখ সাহেব, ওদের কিছু বলেননি। কিন্তু এবার অস্থিরভাবে বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সামনে। পরে শুনেছি সৈন্যরা সেই সময়ই তাঁকে হত্যা করে ফেলতো যদি না কর্ণেল দু’হাত দিয়ে তাঁকে আড়াল করতো । ধীর স্বরে শেখ সাহেব হুকুম দিলেন গুলি থামাবার জন্য । তারপর মাথাটা উঁচু রেখেই নেমে গেলেন তিনি নীচের তলায়। মাত্র কয়েক মুহুর্ত। আবার তিনি উঠে এলেন উপরে। মেজ ছেলে জামাল এগিয়ে দিল তার হাতঘড়ি ও মানিব্যাগ। স্বল্প কাপড় গোছানো সুটকেস আর বেডিংটা তুলে নিল সৈন্যরা যাবার মুহুতে একবার শুধু তিনি তাকালেন আমাদের দিকে । পাইপ আর তামাক হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সাথে। সোফার নীচ থেকে, খাটের নীচ থেকে, আলমারীর পাশ থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকজন দল কর্মী। ওরাও আস্তে আস্তে বললো-মাগো আমরা আছি। আমরা আছি। ওদের সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে সে রাতে কেঁদে ফেলেছিলেন বেগম মুজিব। বলেছিলেন-খোদার কাছে হাজার শোকর তোদের অন্তত: ফেরত পেয়েছি। তোরা অন্তত ধরা পড়িসনি। এ পর্যন্ত বলেই তিনি শেষ করলেন সেই রাত্রের কথা।”
সংকলক: মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ।