চিকিৎসা সেবায় নেই ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া
দৃশ্যপট-১: আপনার বাসায় কেউ অসুস্থ। ডাক্তার দেখানো জরুরি। পরিচিত কয়েকজনের সাথে আলাপ করে খোঁজখবর নিয়ে ডাক্তার নির্বাচন করলেন। এবার হচ্ছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। সিরিয়াল নিতে হবে। সকাল ১০টায় একটা নির্দিষ্ট নাম্বারে কল দিয়ে সিরিয়াল দিতে হবে৷ নাম্বার সচল থাকবে কেবল ২০-৩০ মিনিট। রোগীও দেখবেন ৩০ জন। এরমধ্যেই আপনাকে কাঙ্ক্ষিত সিরিয়াল পেতে হবে। কিন্তু আপনার মতো এরকম শতশত মানুষ একই মানসে অপেক্ষমান। পরিবারের সকলের সঙ্গে বন্ধু-স্বজন আরও দুই-চারজনকে নাম্বারটা দিলেন সিরিয়াল পাইয়ে দেওয়ার জন্য। যেহেতু সময় ৩০ মিনিট, আর হাজারো কলের ভিড়ে আপনি সংযোগ পাবেন তো? বাসার পরিবেশ থমথমে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় টানটান উত্তেজনা। প্রথমদিনে সফল না হলে বিমর্ষ বদনে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করে পরদিন আবারও একই কায়দায় চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এভাবে দিনের পর দিন লাগাতার মিশন আনস্টপেবল চালিয়ে অবশেষে কোনো একদিন সফল হবেন। সিরিয়াল নাম্বার কতো সেটা মূখ্য নয়, ডাক্তার দেখাতে পারাটাই যেন এখানে যুদ্ধজয়ের মতোই আনন্দের। ফাঁকতালে সিরিয়াল প্রদানকারী অ্যাসিস্ট্যান্টের ১০০-২০০ টাকা উৎকোচের লোভে কতরকমের কারসাজি যে চলে তা নাহয় বাদই দিলাম।
দৃশ্যপট-২: এবার পরম আরাধ্য সিরিয়াল নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাবেন। ওহ হ্যাঁ, দেশের মোটামুটি অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই দিনে চেম্বার করেন না, সবাই বসেন সন্ধ্যা-রাতে। মফস্বলের বাসিন্দা হলে আপনি আসা-যাওয়া মিলিয়ে ১০০-১৫০ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে চেম্বারে গেলেন। রাতে বাড়ি ফেরার তাড়াও মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকবে। সিরিয়াল বেশি দূরে হলে তো কথাই নেই। রাত ১২-০১ টা পর্যন্ত রোগী দেখেন এমন ডাক্তারের সংখ্যাও এই শহরে কম নেই। আবার দেখা যাবে ডাক্তার আসার সময় ৭ টা, উনি ৮টা-সাড়ে ৮টায়ও চেম্বারে আসেননি। যাও আসেন, শুরু হয় রাজ্যের তাড়াহুড়ো। সবকিছু শেষে যখন ডাক্তার দেখালেন, এবার তো ঘটবে মহাবিপত্তি। ডাক্তার একগাদা টেস্ট ছাড়া (ব্যতিক্রমও আছে, বেশিরভাগই এমন) আপনাকে কোনো ওষুধই প্রেসক্রিপশনে লিখবেন না। যতই অনুরোধ করা হোক; আপনার বাসা কোথায়, আপনি কতদূর মাড়িয়ে কিংবা বাসায় কতো ঝামেলা রেখে এসেছেন অথবা আপনার জন্য একদিন ডাক্তার দেখানো, আরেকদিন টেস্ট করানো, আবার একদিন পর রিপোর্ট সংগ্রহ করে ফের ডাক্তার দেখিয়ে তারপরই ওষুধ শুরু করার মতো সময় কয়টা নিম্নবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আছে সেটা এখানে মূখ্য নয়। ডাক্তার দেখাতে হলে আপনাকে অতিশয় ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। আর ডাক্তারের ফি, রিপোর্ট দেখানো ফি এবং ৭/১০/১৫ দিন পরে ফলোআপ ফি এসব মিলিয়ে ঠিক কত টাকা সাথে নিয়ে গেলে আপনি সম্মান নিয়ে ডাক্তার দেখানোর প্রথম পর্ব সেরে আসতে পারবেন তাও অসংজ্ঞায়িত।
যবনিকা: প্রতিবেশী দেশ ভারত যখন কেবল মেডিকেল ট্যুরিজম (পুরো টুরিজম শিল্প নয়) দিয়ে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার আয় করছে আমরা তখনও টুরিজমকে পরিপূর্ণ শিল্প হিসেবে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা করছি মাত্র। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে ভারতের মেডিকেল পর্যটকের প্রায় অর্ধেকের বেশি (৫৪.৩ শতাংশ) মানুষ হচ্ছে বাংলাদেশি। ২০১৭ সালেও সেই সংখ্যাটা ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে হারটা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। আর বাংলাদেশীরা প্রতিবছর ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজম খাতে খরচ করছে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা। এটি কেবলই সম্ভব হয়েছে ভারতীয় চিকিৎসকদের আন্তরিকতা, সেবার মানসিকতা এবং প্রযুক্তির আধুনিক প্রয়োগ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে। বিপরীতে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার এমনই বেহাল দশা। ডিজিটাল যুগে বসবাস করেও কেন আমাদের এখনও ডাক্তারের সিরিয়াল নিতে ২০ মিনিটের ম্যাজিক কলের পেছনে ছুটতে হয়? কেন অনলাইনে বিকাশ-রকেটে পেমেন্টপূর্বক নিজের সুবিধামত ডাক্তারের সিরিয়াল পদ্ধতি চালু করা যাচ্ছে না? কেন ই-মেইলের মাধ্যমে (যেগুলো সম্ভব) রিপোর্ট প্রদান সর্বজনীন করা যাচ্ছে না? কেন ফলোআপ ট্রিটমেন্টের জন্য ডাক্তারের সাথে ই-মেইল/হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করা যাচ্ছে না? কেন রোগীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় ডাক্তাররা আরও মানবিক হতে পারেন না? কেন? কেন?? কেন???
লেখক : মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।