কবি আইউব সৈয়দ :: পঞ্চাশ দশকের আঞ্চলিকগান ও প্রান্তিক নবনাট্য সংঘের গণসংগীত শিল্পী অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী’র জন্ম ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে মিয়ানমারের আকিয়াবে অর্থাৎ মুলীপাড়া কালীবাড়িতে। বাবা চন্দ্রকুমার চক্রবর্তী আকিয়াব শহরে ডাক বিভাগে চাকুরী করতেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রকুমার চক্রবর্তী সবকিছু হারিয়ে চট্রগ্রামের বাঁশখালী পালেগ্রামে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ ইংরেজী স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্রগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কবিতা ও সংগীত চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে চট্রগ্রাম থেকে প্রকাশিত সীমান্ত সাহিত্য পত্রিকাতে নিয়মিত কবিতা লিখতেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী ন্যাশনাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে চাকুরী নেন। ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনে জড়িয়ে থাকার কারণে পরে চাকুরীচ্যুত হন এবং কিছুকাল কারাবরণ করেন। এই সময়ে তার বাবার মৃত্যু হয়। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে চট্রগ্রামের প্রগতিশীর ব্যক্তিদের উদ্যোগে স্থানীয় মোমিন রোডস্থ হরি খোলা মাঠে সাংস্কৃতিক সম্মেলনে নিজের লেখা ও সুরারোপিত গান গেয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তাঁর বিখ্যাত কিছু আঞ্চলিক গান এখনও বর্তমান প্রজন্মের শিল্পী ও শ্রোতাদের মুখে মুখে শোনা যায়। যেমনঃ চাড্গাঁইয়া নওজোয়ান আঁরা হিন্দু মুসলমান/সিনাতে সিনাই লাগাই ভাই /ঠেগাই ঝড়-তুয়াঁন। বদর বদর বদর বদর হেইঁয়ো/শোন যত দেশের মা-বইন/সূর্য ওডের লে ভাই লাল মারি ইত্যাদি। চট্রগ্রাম বেতারের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি গীতিকার,সুরকার ও শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন। অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী সংগীত শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতাকে। প্রথমদিকে ফতেয়াবাদ,গৈরলা ও কালারপোল হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর বাঁশখালীতে বৈলছড়ি নজমুননেছা হাইস্কুলে। সবশেষে কালিপুর এজহারুল হক উচ্চবিদ্যালয়ে গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার সময় অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ পাশ করেন।শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি একজন হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকও ছিলেন। চট্রগ্রামের সাংস্কৃতিকসেবীদের অকৃত্রিম বন্ধু ডাক্তার কামাল-এ-খান অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। একমাত্র কন্যা কাবেরী,স্ত্রী ও বিধবা বড় বোনকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তায় তিনি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ষ্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এমতাবস্থায় ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে একমাত্র মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর থেকে জামাতা প্রকৌশলী হিরন্ময় ভট্রাচার্য্য এ শিল্পী পরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহন করেন। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ বেতার নিজস্ব শিল্পী সংস্থা সহ বহু সংগঠন শিল্পীকে সম্মাননা ও পদকে ভূষিত করে। চট্রগ্রাম আঞ্চলিক গানের অন্যতম পুরোধা মেধা, মনন ও জীবনাচরণের একজন পরিপূর্ণ সংগীত শিক্ষক অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী দীর্ঘ ১৭ বছর নির্বাক জীবন কাটিয়ে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। বাঁশখালী পালেগ্রামে বাড়ি সংলগ্ন রাস্তার পাশেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। সমাধিতে তাঁরই লেখা কবিতার একটি পংক্তি স্মৃতিফলক হিসেবে শোভা পাচ্ছে-
” বেঁচে আছি
আজো বেঁচে আছি
আমার এ মৃত্তিকার কাছাকাছি
মৃত্তিকার স্বাদে গন্ধে
জীবনের ঘ্রাণ নিয়ে বেঁচে আছি”
সম্পাদনায় : কবি আইউব সৈয়দ, উপদেষ্টা সম্পাদক, সিটিজি সংবাদ.কম।