সন্ধ্যা নামলে উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। মানুষের তেমন বিচরণ থাকতো না ক্যাম্পের অভ্যান্তরে। যার ফলে বেশ কিছু সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একের পর এক খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন ক্যাম্পে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এপিবিএন’কে।
ক্যাম্পে এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সৃজনশীল চিন্তা মাথায় এনে প্রথম স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের পাহারার ব্যবস্থা চালু করেন ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম। এরপর থেকে পাল্টে যেতে শুরু করে ক্যাম্পের পরিস্থিতি। স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালুর পর থেকে অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৮.২৪ মাসে বিভিন্ন মামলায় ৭৫৪ জন দুষ্কৃতিকারী গ্রেফতার হয়। ১৩টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৩৩ রাউন্ড গুলি, ১৪১টি দেশীয় অস্ত্র, ১৫,৩৭,০১৫ পিস ইয়াবা ও ৪৯ ভরি ১৫ আনা ৪ রতি স্বর্ণ উদ্ধার হয় এবং ক্যাম্প ইতিহাসে প্রথম ক্লুলেস মার্ডার ডিটেকশন হয়।
তবে স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালুর পূর্বের এবং পরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বেচ্ছায় পাহারা চালুর পর একই সময়ে দুষ্কৃতিকারী গ্রেফতার বেড়েছে ৩.৬৩ গুণ, মাদক উদ্ধার বেড়েছে ৩.৬৬ গুণ, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার বেড়েছে ৬.৫ গুণ, গুলি উদ্ধার ৫৯.২২ গুন ও স্বর্ণ উদ্ধার বেড়েছে সাড়ে ২.৭৪ গুণ। এফডিএমএন সদস্যদের অভিমত, স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালুর পরে ক্যাম্পগুলোতে ৯৫ শতাংশ অপরাধ কমে গেছে।
৮ এপিবিএন এর আওতাধীন ১১টি এফডিএমএন ক্যাম্পে ৬৪টি ব্লকে ৭৭২টি সাব-ব্লক রয়েছে। মোট লোকসংখ্যা ৩ লাখ ৬২ হাজার ২১৮ জন।
প্রতিটি সাব-ব্লকে গড়ে স্বেচ্ছায় পাহারা সক্ষম পুরুষের সংখ্যা ৮০-১০০ জন। প্রতিরাতে একটি সাব-ব্লকে ৫/১০ জন করে পাহারা দিচ্ছেন। প্রত্যেকটি ক্যাম্পের এক্সিট এন্ট্রি পয়েন্টে পুলিশের সাথে ১৫/২০ জন এফডিএমএন সদস্য স্বেচ্ছায় পাহারা দেয়। এই হিসেবে প্রতিরাতে স্বেচ্ছায় পাহারা দিচ্ছে ৩,৮৬০ জন। ১৫-২০ দিন পর একজন পাহারাদারের পাহারা পড়ে।
অর্থাৎ এক রাত পাহারা দিলে ১৫-২০ দিন শান্তিতে ঘুমানো যায়। প্রতিদিন ক্যাম্পের চীফ মাঝির (এফডিএমএন ক্যাম্পের প্রধান নেতা) মাধ্যমে নির্ধারিত ফরমে পাহারাদারদের তালিকা পুলিশ ক্যাম্পে প্রেরিত হয়।
এ ব্যবস্থায় পুলিশ ৩ স্তরে ক্যাম্পের পাহারা দায়িত্ব মনিটরিং করে। প্রথম স্তর-ক্যাম্পের নির্দিষ্ট ডিউটি পার্টি, দ্বিতীয় স্তর-ক্যাম্পের নিজস্ব তদারকি পার্টি যা পুলিশ পরিদর্শক/এসআই এর নেতৃত্বে তদারকি হয়। তৃতীয় স্তর-এএসপি/এডিশনাল এসপির নেতৃত্বে সকল ক্যাম্পে পাহারা দায়িত্ব তদারকি করা হয়। সার্বিক তদারকি অধিনায়ক করে থাকেন। ৮ এপিবিন কর্তৃক প্রবর্তিত এই স্বেচ্ছা পাহারা ব্যবস্থা কক্সবাজারে অবস্থিত অন্য সকল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চালু হয়েছে। এখন ৩৩ টি ক্যাম্পের ১,৭৭৩ টি সাব-ব্লকে ৫ জন করে মোট ৮,৮৬৫ জন স্বেচ্ছাপাহারাদার পাহারা দেয়।
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ভিন্নভাষা ও সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীকে প্রতিকূল পরিবেশে কিভাবে দুষ্কৃতিকারী, চাঁদাবাজ, অপহরণকারী, মুক্তিপণ দাবিকারী, নারী নির্যাতনকারীদের নির্যাতন ও নিষ্পেশন থেকে শান্তির বলয়ে নিয়ে আসা যায় তা ভাবতে গিয়ে মাথায় এলো এই স্বেচ্ছায় পাহারার চিন্তা। ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর আমার দায়িত্বাধীন শফিউল্লাহ কাটা ক্যাম্প-১৬ ও জামতলি ক্যাম্প-১৫ এর সকল অফিসার ও মাঝিদের সাথে স্বেচ্ছায় পাহারা নিয়ে সভা করি। অতঃপর দুইটি ক্যাম্পে স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালু করি। এ দুইটি পুলিশ ক্যাম্পের ১৪৭টি উপদলে পাঁচজন করে মোট ৭৩৫ জন স্বেচ্ছায় পাহারা দিতে থাকে। ১৫ দিন পর এই স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থার ফলাফল মূল্যায়ন করে দেখা গেল দুষ্কৃতিকারীদের অপরাধ সংঘটন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আমাদের সহজ বক্তব্য ছিল- তোমরা ৫ জন আজকে পাহারা দিচ্ছ, এতে ক্যাম্পের প্রায় ৫০০ জন মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারছে। আগামীকাল অন্য ৫ জন পাহারা দেবে, তোমরা শান্তিতে ঘুমাবে। এভাবে ১৫-২০ দিন পর তোমাদের পাহারা পড়বে।
রবিউল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গারা এটিকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন এবং তা বাস্তবায়নে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। শান্তিকামী এফডিএমএন সদস্যরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে পাহারা দিতে থাকল। এর সুফল সম্পর্কে অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মহোদয়কে অবহিত করি। তিনি সেই বছরের ৮ নভেম্বর থেকে আমার চালু করা স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা অন্য আটটি এফডিএমএন ক্যাম্পে চালু করার জন্য ক্যাম্প কমান্ডারদের নির্দেশ দেন।
৮ এপিবিএন এর অধিনায়ক মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান বলেন, বিভিন্ন ব্লক, সাব ব্লক থেকে রোহিঙ্গা নিয়ে স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালু করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল, কিন্তু তা কেটে উঠে দ্রুত সময়ের মধ্যে সফলতার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। সেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থার কারণে ক্যাম্পে অপরাধ প্রবণতা কমে এসেছে। প্রতিনিয়ত দুষ্কৃতিকারীরা ধরা পড়ছে। মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ উদ্ধার বেড়েছে বহু গুণ। সব মিলিয়ে ক্যাম্পে শান্তি সুবাতাস বইতে শুরু করেছে।
সেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা রোহিঙ্গাদের কতটুকু কাজে এসেছে এমন প্রশ্নের জবাবে উখিয়ার জামতলী ১৫ ক্যাম্পের এইচ ব্লকের হেড মাঝি মো. বশির বলেন, পাহারা ব্যবস্থা চালু হওয়ায় চুরি-ডাকাতি, মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ, মানবপাচার, খুনের মতো ঘটনা অনেকাংশে কমে গেছে। কিছু দুষ্কৃতিকারী পরিকল্পিত ভাবে ক্যাম্পে আগুন দিয়ে যে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করতো তা এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
একই ক্যাম্পের জি-ব্লকের হেড মাঝি মো. আয়াছ বলেন, ক্যাম্পে আগে যে পরিমাণ অপরাধ কর্মকান্ড সংঘঠিত হতো, পাহারা ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর তা এখন কমে এসেছে। জামতলী ১৫ নাম্বার ক্যাম্পে ৫১০ জন পাহারাদার রয়েছে, তাদের কারণে ৫২ হাজার রোহিঙ্গা শান্তিতে ঘুমাতে পারছে। এই পাহারা ব্যবস্থা বলবৎ থাকলে ক্যাম্পের অপরাধ শূণ্যের কোটায় নেমে আসবে বলে তিনি দাবি করেন।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে এসে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেয়। এর আগেও কয়েক দফা রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করেছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। বর্তমানে এসব রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)।