মিয়ানমার অভ্যন্তরে সংঘাতের জেরে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি, সেনা সদস্য, কাস্টমস কর্মী ও সাধারণ নাগরিকসহ আরও ১১৬ সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ নিয়ে দেশটির মোট ২২৯ সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিল।
মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টা পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ১১৩। একই সঙ্গে আট রোহিঙ্গাও অনুপ্রবেশ করেছে।
মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, সর্বশেষ মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত পালিয়ে আসা ২২৯ জন বিজিবির হেফাজতে রয়েছে। যার মধ্যে সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ৭ জন বিজিপির সদস্য প্রবেশ করে। যার ফলে সংখ্যা ছিল ১১৩। পরে সকাল ৯টার দিকে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতবিল সীমান্ত দিয়ে আরও ১১৪ জন এবং ঘুমধুম,টেকনাফের সীমান্ত দিয়ে আরও ২ জন পালিয়ে আসে। এখানে শুধু বিজিপি সদস্য না, সেনাবাহিনীর সদস্য, কাস্টমস সদস্য ও আহত মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিক রয়েছে। এ মূহুর্তে কতজন আহত রয়েছে বলা যাচ্ছে না। বিজিবি এদের হেফাজতে নিয়ে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নিচ্ছে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সামরিক বাহিনী ও দেশটির বিদ্রোহী গ্রুপের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের পারদ ছড়িয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে। মর্টাল শেল ও গুলি এসে পড়ছে উখিয়া ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর ভেতর। এসব এলাকার বাসিন্দাদের হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে গুলাগুলির ঘটনায় আতঙ্কে জীবন বাঁচাতে স্থানীয়রা উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৭টি পরিবারের ১১৭ জন আশ্রয় নিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিপন বড়ুয়া। এছাড়া আত্মীয়-স্বজনের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন আরও ২৪০ পরিবার।
মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে সীমান্তের সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারাদিনে গুলিবিদ্ধ পাঁচজনের মধ্যে চারজন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। অপরজন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা।
মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির (এএ) সংঘর্ষ শুরু হয় দেড় বছর আগে। ২০২২ সালে জুলাই থেকে শুরু হয়ে টানা ছয় মাস যুদ্ধ চলে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও সম্প্রতি আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়েছে।
তীব্র লড়াইয়ের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করেছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যা। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এই সংখ্যা ২২৯ জন বলে নিশ্চিত করেছে বিজিবি। দেশটির অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী এলাকার গোলাগুলির মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে। নিহত হয়েছে এক বাংলাদেশি ও এক রোহিঙ্গা।
পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, তার এলাকায় চারজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারা হলেন, নলবনিয়া এলাকার বাসিন্দা আয়ুবুল ইসলাম, রহমতেরবিল এলাকার আনোয়ার হোসেন, পুটিবনিয়া এলাকার মোবারক হোসেন ও মো. কালাম।
তুমব্রু সীমান্তে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির নাম সৈয়দ আলম। বিকাল ৪টার দিকে তুমব্রু পশ্চিমকুল পাহাড় পাড়া থেকে আশ্রয়কেন্দ্র উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
আহত সৈয়দ আলম জানান, মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি প্রথমে একটি গাছে লেগে তার কপাল ঘেঁষে চলে যায়। কপালে হাত দিয়ে স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।
জানা যায়, ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকুবুনিয়া সীমান্তচৌকি চৌকি দখলকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) মধ্যে গুলি বিনিময় ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এর ফলে আতঙ্ক বেড়ে যায় সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে।
লাগাতার গোলাগুলি, মর্টারশেল নিক্ষেপ ও রকেট লঞ্চার বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু এলাকা। গুলির অংশ ও রকেট লঞ্চারের ভগ্নাংশ উড়ে এসে পড়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘুমধুম-তুমব্রু এলাকায় বসতঘরের ওপর।
নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম ইউনিয়নে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী জলপাইতলী, বাজার পাড়ার এলাকার মানুষ এখন আতঙ্কে ঘরছাড়া। ফাঁকা পড়ে আছে তুমব্রু বাজার, বেতবুনিয়া বাজার এলাকার ৬টি স্কুল ও ১টি মাদ্রাসা। এছাড়া এই এলাকার ২৭টি পরিবার নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘আজ থেকে টানা ৫-৬ দিন ধরে সীমান্তে মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলির কারণে আতঙ্কে আছে এলাকাবাসী। দিন ও রাতভরও ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যতটুকু শুনেছি, ঘুমধুম ইউনিয়নের সম্মুখে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিজিপি) ক্যাম্প ও ফাঁড়ি আরাকান আর্মিরা দখলে নেওয়ার পর এখন ঢেঁকিবুনিয়া বিজিপি ক্যাম্প দখলের যুদ্ধ চলছে, গোলাগুলি চলছে। কখনও থেমে থেমে আবার কখনও লাগাতার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা স্থানীয়রা নিরাপদ আশ্রয়ে খোঁজে বিভিন্ন এলাকার আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।’
এমন পরিস্থিতিতে গতকালও বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে চলে গেছেন।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ার হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নে ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাইশ পারি তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ার ২০টি পরিবার, ভাজাবনিয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ার ৩০টি, তুমব্রু কোনার পাড়ার ৩০টি, ঘুমধুম পূর্বপাড়ার ২০টি, তুমব্রু হিন্দুপাড়ার দশটি পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য উখিয়া, মরিচ্যা, কোট বাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গতকাল সোমবার বিকাল থেকেই আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবান জেলা প্রশাসক মুজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন। জেলা প্রশাসক সীমান্তবর্তী গ্রামের লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছন। এছাড়া উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।
বান্দরবান পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, সীমান্তে গত কয়েকদিন ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি র্যাবও কাজ করছে। তাই এলাকার লোকজন আতঙ্কিত না হয়ে নিরাপদ কেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান জানান, মিয়ানমারে সংঘাত বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি, মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে বসতঘরে। সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের মানুষকে নিরাপদে আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।
বিজিবি মহাপরিচালক মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, দেশটির দুই বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হলে এদিকে কিছু শেল এসে পড়ছে। দুর্ভাগ্যবশত একজন রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি নারী মারা গেছেন। এই মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা প্রতিবাদলিপি দিয়েছি। আমরা বারংবার বলছি। আজকেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি বড় মিটিং হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা ধৈর্য ধারণ করে মানবিক দিক এবং আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনাও সেরকমই। তিনি আমাদের ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি।