দুর্ঘটনায় ২ছেলে হারানো শামসুদ্দিনের আহাজারীতে নিস্তব্দ মিরসরাই

দুই ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছে শামসুদ্দীন। তার ৩ ছেলের মধ্যে দুই ছেলে শেখ ফরিদ ও শেখ সুমন অনন্তকালের যাত্রায় পাড়ি দিল পিচঢালা পথে রক্ত ঝরিয়ে। মর্মান্তিক এই মৃত্যু দেখে পথচারীরাও চমকে উঠছিল। বেপরোয়া গতির মিনি কাভার্ড ভ্যান তাদের শরিরকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায়। কি করে ভুলবে এমন দৃশ্য বাবা শামসুদ্দীন। দু’ছেলের জন্ম এক বছরের ব্যবধানে কিন্তু পরপারে পাড়ি দিল একসাথে। বাবা শামসুদ্দীন পেশায় সিএনজিঅটোরিকশা চালক। তিন ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে নিহত শেখ ফরিদ বড় ও শেখ সুমন মেঝ। অপর ছেলে লিটন সবার ছোট। তারা তিন জনই পরিবারের ভরনপোষণ নির্বাহ করতে বাবার পেশাকেই বেছে নেয়।

আকস্মিক দুর্ঘটনায় নিমেষেই বিষাদ নামে শামসুদ্দীনের পরিবারে। উপার্জনক্ষম বড় দুই ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল আবার কখনো নির্বাক। ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৩ টা। এসময়টাই গ্রামীণ জনপদ থাকে গভীর ঘুমে। কিন্তু বুধবার তার ব্যত্যয় ঘটে। সেই রাতেই রাতের নির্জিবতা নামেনি, কান্নার রোলে ভারী হয়ে উঠেছিল আকাশ বাতাস। দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল সেই কান্নার রোল। বাবা শামসুদ্দিন এবং মা অজিবা খাতুনের আদরের ছেলেদের রেখে যাওয়া ৪ নাতি-নাতনী শেখ ফরিদের তাসফিয়া (৫) ও শেখ রাহিন (২) এবং সুমনের নিশাত (৭) ও মারিয়া (৪) নামে সন্তানদের বুকে জড়িয়ে কান্নার বিলাপ যেন থামছেই না।

এদিকে স্বামীদের হারিয়ে বারবার হুশহারা হচ্ছিল তাদের স্ত্রীরা। আর বাবা হারিয়ে চার শিশু অপলক তাকাচ্ছিল এদিকওদিক, তাদের চাহনী যেন মনেই করতে পারছেন না পৃথিবীতে থেকে হারিয়ে গেছে বাবা নামের মানুষটি। নিহত দুই সহোদর মিরসরাই উপজেলার ৯ নং মিরসরাই সদর ইউনিয়নের গড়িয়াইশ গ্রামের শামসুদ্দীন ড্রাইবার বাড়ির শামসুদ্দীনের পুত্র।

বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯ টায় উপজেলার মিরসরাই সদর ইউনিয়নের গড়িয়াইশ গ্রামে একসাথে জানাযা শেষে দুই সহোদরকে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়েছে। দুই ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা শামসুদ্দীনের আহাজারিতে জানাযা পড়তে আসা মুসল্লীদের চোখের পানি আটকাতে পারেনি। এভাবে আমার বুক খালি করে দুই ছেলে চলে যাবে কখনো চিন্তা করতে পারিনি, আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো। কে ছোট ছোট নাতি-নাতিনদের মুখে খাবার তুলে দিবে এসব বলে বিলাপ করছেন বাবা শামসুদ্দিন।

বুধবার রাত ৩ টায় শেখ ফরিদ ও সুমনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাদের লাশ ঘিরে রেখেছেন পাড়া প্রতিবেশীসহ বন্ধুবান্ধব। সন্তানদের হারিয়ে পাগলপ্রায় তাদের বাবা-মা। ঘরের ভেতর থেকে স্ত্রীদের গুমরে কাঁদার আওয়াজ আসছে। ফরিদ ও সুমনের সন্তানদের বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে বাবা শামসুদ্দীন। তিন কক্ষবিশিষ্ট টিনশেডের ঘরে স্ত্রী, তিন ছেলে ও তাদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন শামসুদ্দীন ড্রাইভার।

সন্তানদের হারিয়ে নাতি-নাতনিদের কথা ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়া শামসুদ্দিন বলেন, আমি ও আমার দুই ছেলে ফরিদ এবং সুমনসহ সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাই। প্রতিদিন রাত ১০ টার মধ্যে ছেলেরা গাড়ি গ্যারেজে রেখে বাড়িতে চলে আসে। বুধবার রাত ১১ টারপরও তারা বাড়ি আসেনি। রাত সাড়ে ১১ টার সময় খবর পাই কাভার্ড ভ্যানের চাপায় আমার সোনামণিরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। এখন তাদের পরিবার ও সন্তানদের কে দেখবে?’ এসব বলতে বলতে তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন।

স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল মোস্তফা বলেন, সুমন-ফরিদ একসঙ্গে চলাচল করতো। এলাকার কারো সঙ্গে কোনদিন দুই কথা হয়নি। দুই ভাইকে একসঙ্গে খৎনা করা হয়, বিয়েও হয় একসঙ্গে। বুধবার রাতে একসঙ্গে তারা মারাও গেলো। এভাবে চলে যাবে কখনো ভাবতে পারিনি।

মিরসরাইয়ে বুধবার রাত ১১ টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ের ৮ নং দুর্গাপুর ইউনিয়নের রায়পুর এলাকার চলমান ফিলিং স্টেশন এলাকায় বাস-লরি ও কাভার্ড ভ্যান সংঘর্ষে ৪ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৩ জন সিএনজি অটোরিকশা চালক, তম্মধ্যে ২ জন আপন ভাই; অপর জন চৈতন্যেরহাট বাজারের নাইট গার্ড হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। আহত ৬ জনের মধ্যে ২ জন জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশের সদস্য।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রামমুখী লেনে একটি কনটেইনারবাহী লরি (চট্টমেট্টো চ-৮১-২২৪৬) সড়কের বাম পাশ ধরে চলছিল। হঠাৎ করে সেটি সড়কের মাঝখানে চলে এসে। একই সময়ে দ্রæত গতিতে আসছিল জোনাকি পরিবহনের (লক্ষীপুর ব-১১-০০২০) বাসটি। হঠাৎ টার্ণ করায় লরিটির সঙ্গে বাসটির ধাক্কা লাগলে বাসের সামনের একাংশের গøাস ভেঙে যায়। তখন গাড়ি দুইটি থামিয়ে চালক-হেলপাররা তর্কবিতর্ক করছিল। এমন সময় জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশ এবং সংঘর্ষের ঘটনায় বিকট শব্দ শুনে এগিয়ে যায় পাশ্ববর্তী মস্তাননগর বিশ^রোড় বাইপাস সিএনজি অটোরিকশা স্টেশনের কয়েকজন চালক ও স্থানীয়রা। তারা উপস্থিত ঘটনার মীমাংসা করার চেষ্টা করে। আশপাশের অনেক মানুষও ঘটনাস্থলে জড়ো হয়, অবস্থান করছিল দুর্ঘটনার শিকার বাসযাত্রীরা। তখন পেছন থেকে বেপরোয়া গতির একটি মিনি কাভার্ড ভ্যান (ঢাকা মেট্টো ন-১৫-১০৭৭) এসে জড়ো হওয়া মানুষের উপরে উঠিয়ে দিয়ে পূর্বে দুর্ঘটনার শিকার লরির সাথে কাভার্ড ভ্যানটি ধাক্কা খায়। এতে কাভার্ড ভ্যান চাপায় ঘটনাস্থলেই ৪ জনের মৃত্যু হয় এবং ৬ জন আহত হয়।

নিহতরা সবাই মিরসরাইয়ে ৮ নং দুর্গাপুর ও ৯ নং মিরসরাই সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা। তারা মূলত দুর্ঘটনার শিকার যাত্রীদের উদ্ধারে সহায়তা করার জন্য ছুটে যায়। নিহতরা হলো মিরসরাই সদর ইউনিংয়নের গড়িয়াইশ গ্রামের শামসুদ্দিনের পুত্র সুমন (২৮) ও তার বড় ভাই শেখ ফরিদ (৩০), দুর্গাপুর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের হারুনের পুত্র মেহেদী হাসান (২২), একই ইউনিয়নের পূর্ব রায়পুর গ্রামের আবুল কাশেম (৬০)।

আহতরা হলো জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশের এএসআই গোলাম মোস্তফা (৪৫), কন্সটেবল শেখ আহম্মদ (৪৫), জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার গোলাম মাহমুদের পুত্র রফিক (২৫), ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থানার ঈশ্বরগ্রামের নুরুল ইসলামের পুত্র শাহ আলী (২৬), মিরসরাইয়ের দুর্গাপুরের রায়পুর গ্রামের আফাজ উদ্দিনের পুত্র আব্দুল আউয়াল (৫০), মিরসরাইয়ের আবুরহাট এলাকার মৃত নুরুল আলমের পুত্র নোমান (১৮)। আহত ৬ জনকে প্রাথমিকভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মস্তাননগর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুর্ঘটনার শিকার ৩ টি গাড়ি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। এই ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং-৩৫৭) করা হয়েছে। খবর পেয়ে জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশ, জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ ও মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা চালায়।

মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মস্তাননগর হাসপাতালের উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার ডা. পলাশ কুমার দে জানান, নিহত ৪ জনকে হাসপাতালে আনা হয়। এছাড়া আহত ৬ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা ইমাম হোসেন পাটোয়ারী বলেন, খবর পেয়ে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। আহত এবং নিহতদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই।

জোরারগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খায়রুল আলম বলেন, ‘একটি কনটেইনারবাহী লরি সড়কের বাম পাশ ধরে চলছিল। হঠাৎ করে সেটি সড়কের মাঝখানে চলে এসে। একই সময়ে দ্রুত গতিতে আসছিল জোনাকী পরিবহনের বাসটি। হঠাৎ টার্ণ করায় লরিটির সঙ্গে বাসটির ধাক্কা লাগে। যার কারণে বাসের গ্লাস ভেঙে যায়। তখন গাড়ি দুইটি থামিয়ে চালক-হেলপাররা তর্ক করছিল। এমন সময় হাইওয়ে পুলিশ উপস্থিত হয়ে ঘটনার মীমাংসা করার চেষ্টা করে। আশপাশের অনেক মানুষ ঘটনাস্থলে জড়ো হয়। তখন পেছন থেকে একটি মিনি কাভার্ড ভ্যান এসে জড়ো হওয়া মানুষের উপরে উঠিয়ে দেয়। উঠিয়ে কাভার্ড ভ্যানটি লরির সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে চাপায় পরে ঘটনাস্থলেই ৪ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া হাইওয়ে পুলিশের এএসআই মোস্তফা কামালসহ ৬ জন আহত হন।’

জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেন, ব্যস্ততম মহাসড়কে একটি লরি ও বাস দুর্ঘটনার শিকার হলে গাড়িগুলোর চালকরা কোনো বিষয়ে তর্কাতর্কি করছিলেন। ওই সময় পেছন থেকে একটি মিনি কাভার্ড ভ্যান গাড়ি দুইটিকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন পুলিশসহ ৫ জন। লাশ পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়া হস্তান্তর করা হয়েছে। দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ীগুলো থানায় আনা হয়েছে।

আরও পড়ুন