দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্মার্ট সিটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর

জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেত এসব চরের জমি। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে শুকনো মৌসুমেও সেসব জমিতে ফসল উৎপাদন হতো না। পতিত এসব চরে গবাদিপশুর অবাধ চারণভূমি ছিল। হাজার হাজার একর চরের জমি পাশের বঙ্গোপসাগর থেকে বালি এনে ভূমি উন্নয়ন করা হয়। এখন সেখানে হচ্ছে দেশের সর্ববৃহত পরিকল্পিত শিল্পনগর। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কারখানা উৎপাদনে গেছে, উৎপাদনে যেতে অপেক্ষমান রয়েছে আরো বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানা। সব মিলিয়ে যেন সাগরের বুকে জেগে উঠছে এক টুকরো বাংলাদেশ। বলছি দক্ষিন এশিয়ার বৃহত্তম স্মার্ট সিটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের কথা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই থেকে ১০ কিলোমিটার এবং বন্দর শহর চট্টগ্রাম থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের উপক‚লীয় মিরসরাই, সীতাকুন্ড ও সোনাগাজীর ইছাখালী, সাহেরখালী, মুরাদপুর, সৈয়দপুর, সোনাগাজী ও চর চান্দিনা ইউনিয়নের ১৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে এই শিল্পনগর। ৩৩ হাজার ৮০৫ একর আয়তনের এই শিল্পনগরে ৪১ শতাংশ বা ১৪ হাজার একরে শুধু শিল্পকারখানা হবে। বাকি ৫৯ শতাংশ এলাকার মধ্যে থাকবে খোলা জায়গা, বনায়ন, বন্দও সুবিধা, আবাসন, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও বিনোদন কেন্দ্র। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অন্তত ২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলোর অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি-বিদেশি আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে আগ্রহী। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। তারা আশা করছে, এই মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫-২০ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হবে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে শিল্পনগর উন্নয়নে কাজ শুরু করে বেজা।

যেভাবে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’ নামকরণ :: ৩৩ হাজার একর জমি নিয়ে গড়ে উঠা দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক বলয়টি ২০১৬ সালে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল নামেই এর উদ্বোধন করা হয়। সেখানে জমি বরাদ্দের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে আবেদন নেওয়া শুরু করে বেজা। বেজার প্রথম বোর্ড সভায় মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চতুর্থ বোর্ড সভায় ফেনী অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে দুইটি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেয়েছিল। ষষ্ঠ বোর্ড সভায় সীতাকুÐ নামে আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পায়। পরে ২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে মিরসরাই-সীতাকুন্ড ও সোনাগাজীর সীমানাজুড়ে গড়ে উঠা তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে একত্রিত করে এর নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর’ করেছে বেজা। এর আগে ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ আগস্ট ট্রাস্ট নাম ব্যবহারের প্রস্তাবে সম্মতি দেয়।

শেখ হাসিনা সরণি:: দেশের লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে ১০ কিলোমিটার দূরত্বে গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। আর এই শিল্পনগরের সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংযোগ সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা সরণি। প্রথমে সড়কের নাম বড়তাকিয়া (আবু তোরাব) থেকে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল সংযোগ সড়ক প্রকল্প হলেও পরবর্তীতে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১২.৩০ মিটার প্রশস্তের এই সড়ক শেখ হাসিনা সরণি নামকরণ করা হয়। প্রকল্পের লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরকে ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের (এন-১) তথা চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সংযুক্তকরণ।

প্রথমবারের মতো রপ্তানি:: বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর থেকে প্রথমবারের মতো রপ্তানি হলো পণ্যের চালান। চালানটিতে ছিল প্রায় ৩ লাখ ৪৯৩ হাজার মার্কিন ডলারের ইভা শিট (জুতা তৈরির সামগ্রী)। চলতি বছরের ৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো এই শিল্পনগর থেকে শুরু হয়েছে পণ্য রপ্তানি। চায়না কোম্পানি কেপিএসটি শু (বিডি) কোম্পানি লিমিটেড প্রায় ৮.০৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গত ৩ নভেম্বর কার্যক্রম শুরু করে। এখন পর্যন্ত ৩.৪৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি এই চায়না কোম্পানি ৩ লাখ ৪৯৩ হাজার মার্কিন ডলারের ইভা শিট তৈরি করে। ৮ নভেম্বর পণ্য রপ্তানির অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ। তবে রপ্তানির এই পণ্য বিদেশে পাঠানো হচ্ছে না। বেপজা কর্তৃপক্ষ বলছে, একটি বন্ডেড প্রতিষ্ঠান থেকে আরেকটি বন্ডেড প্রতিষ্ঠানে পণ্য রপ্তানিকে ডিমড এক্সপোর্ট (প্রচ্ছন্ন রপ্তানি) বলা হয়। তাই বিদেশি বায়ারের (ক্রেতা) মনোনীত কোম্পানি হিসেবে কেপিএসটি শু থেকে বøু ওশান ফুটওয়্যার জুতার অ্যাক্সেসরিজ নিচ্ছে।

বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক এনামুল হক জানান, ‘এই চালান বিদেশে না পাঠালেও বিদেশে পণ্য পাঠাতে যেসব নিয়ম বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়, এখানেও তা করা হয়েছে। তবে চালানটি যায় ঢাকার গাজীপুরের বøু ওশান ফুটওয়্যার নামের একটি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে। পাশাপাশি চীনের মালিকানাধীন ফ্যানকুন কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল কোং বিডি লিমিটেড ও কাইশি লিঙ্গারি বাংলাদেশ কোং লিমিটেড নামে আরও দুইটি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করবে।’

দেশের প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির কারখানা:: দেশে গড়ে তোলা হচ্ছে ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির কারখানা। বাংলাদেশে প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির কারখানা স্থাপনে ম্যাংগো টেলি সার্ভিসেসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে অবস্থিত এই কারখানাটি আগামী বছরের মার্চ নাগাদ বাজারে ইলেকট্রিক গাড়ি নিয়ে আসবে। মোট বিনিয়োগের প্রায় ৭৫ শতাংশ গাড়ির বডি, ব্যাটারি, মোটর ও চার্জার উৎপাদন কাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ করা হবে। বাকি ২৫ শতাংশ খরচ হবে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের উপকরণ বাইরে থেকে আমদানি করার জন্য। সেডান, এসইউভি ও বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের বডি এ কারখানাতেই তৈরি করা হবে। বাংলাদেশ লিথিয়াম ব্যাটারি লিমিটেড নামে আরেকটি আলাদা কারখানাও তৈরি করা হবে। এ কারখানায় উৎপাদিত ব্যাটারি শুধু ইলেকট্রিক যানবাহনেই ব্যবহার করা হবে না বরং সৌরশক্তি, ডেটা সেন্টার ও ইউপিএসেও ব্যবহার করা হবে। ম্যাংগো টেকনোলজিস লিমিটেড নামে আরেকটি কারখানায় মোটর কন্ট্রোল ও চার্জিং সিস্টেম নির্মাণ করা হবে।

এই উৎপাদন কারখানাগুলো প্রাথমিকভাবে দেড় হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবে। পরবর্তীতে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ৫ হাজার পর্যন্ত জনবল বাড়ানো হতে পারে। এই কারখানায় বর্তমানে পরিকল্পনা অনুযায়ী বছরে ৬০ হাজার টু হুইলার, ৪০ হাজার থ্রি হুইলার ও ৩০ হাজার ফোর হুইলার নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানান, এই বাহনগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব ব্র্যান্ডের অধীনে বাজারজাত করা হবে। পরিকল্পনার মধ্যে দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় পেট্রোল স্টেশনে চার্জিং সুবিধার প্রচলনও অন্তর্ভুুক্ত করা হয়েছে। এই যানবাহনগুলো ব্যবহারকারীদের জন্য সর্বোচ্চ স্বাচ্ছন্দ্য দেবার মতো করে নির্মাণ করা হবে। প্রাথমিকভাবে বিদেশ থেকে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের পণ্য আমদানি করা হবে এবং এই উপকরণগুলোর নির্ভুল সমন্বয় ঘটানোর মাধ্যমে কোম্পানিটি বিশ্বসেরা গাড়ি তৈরি করবে।

সূচিত হবে সবুজ শিল্পবিপ্লব:: পরিবেশ সহনশীল গ্রিন অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরকে। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্পে’র মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা (গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি) গড়ে তোলে এই বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা)। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ঋণ ৩ হাজার ৯৬৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং সরকারি অর্থায়ন হবে ৩৭৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। শিল্পনগরী সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই সবুজ শিল্পবিপ্লব দেশের শিল্প খাতের জন্য মডেল হিসেবে কাজ করবে।

বেজা সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির মাধ্যমে ৯৯০ দশমিক ৪১ একর ভ‚মি উন্নয়ন, ১ দশমিক ২৭ লাখ বর্গমিটার বৃক্ষরোপণ ও ট্রি-গার্ড, ইনভেস্টর ক্লাব নির্মাণ, ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার, মসজিদ নির্মাণ, ইমার্জেন্সি রেসপন্স সেন্টার, দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র, শিশু পরিচর্যা ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ড্রেনেজ অবকাঠামো (স্টর্ম ওয়াটার), ৪০ কিলোমিটার স্যানিটেশন ও পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক, ২৮ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন নেটওয়ার্ক, নিরাপত্তা ব্যবস্থাদি এনভায়রনমেন্টাল ল্যাব ও মনিটরিং সিস্টেম, বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (সিইটিপি), ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট, স্টিম নেটওয়ার্ক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, ওয়েস্ট সোর্টিং ফ্যাসিলিটি, রুফটপ ও ফ্লোটিং সোলার ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হবে।

বেজার নির্বাহী সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ ইরফান শরীফ বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্পটি স্বপ্নের। এটি বাংলাদেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করে দেবে। সব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমেই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্প’ সবুজ শিল্পবিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হবে। শিল্পনগরকে পরিবেশ সহনশীল গ্রিন অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে লক্ষ্য হচ্ছে-টেকসইকরণ এবং পরিবেশ সহনশীলতা নীতি ব্যবহারের উপকারিতাসম‚হ প্রদর্শন করা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘গ্রিন ইকোনোমিক জোন’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরকে।

শেখ হাসিনা সরোবর:: প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের অনুমোদনের প্রাক্কালে প্রতিটি জোনে প্রাকৃতিক জলাধার নির্মাণ ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশনা অনুসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ২১২ একর জমিতে দৃষ্টিনন্দন ‘শেখ হাসিনা সরোবর’ নামে কৃত্রিম লেক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া উক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকায় নদী-নালা, খাল, ছড়া ইত্যাদি সমন্বয়ে প্রায় ১ হাজার একর জমি প্রাকৃতিক লেক হিসেবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বেজা সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৪ মার্চ শেখ হাসিনা সরোবর নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের ২১২ একরের মধ্যে ১০০ একরে থাকবে জলাধার বা হ্রদ। অবশিষ্ট ১১২ একরে নির্মাণ করা হবে আন্তর্জাতিক মানের পাঁচতারকা হোটেল ও রিসোর্টসহ কয়েকটি স্থাপনা। হোটেলের উচ্চতা হবে ২২ তলা। এসব হোটেল ও রিসোর্টে থাকবে বিনোদনের ব্যবস্থা। সরোবরের মধ্যে থাকবে হাউস বোটসহ ওয়াটার ট্যুরিজমের ব্যবস্থা। সরোবরের পাড়ে স্থাপন করা হবে জাদুঘর, শপিং কমপ্লেক্স, সিনেমা হল ও বিনোদন কেন্দ্র। বর্ষা মৌসুমে থাকবে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা। শুষ্ক মৌসুমে তা অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্যান্য অংশের কাজে ব্যবহৃত হবে। সরোবরের দুই ধারে বনায়ন থাকবে। থাকবে বন্যপ্রাণী ও পাখির অভয়াশ্রম। থাকবে হাঁটার পথ ও ব্যায়ামাগারসহ আনুষঙ্গিক নানা ব্যবস্থা। থাকবে ৩৫০ ফুট উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।

এগিয়ে যাচ্ছে বিজিএমইএ গামের্ন্টস পল্লীর কাজ:: বেজা এবং বিজিএমইএ’র মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর একটি বিশেষায়িত গার্মেন্টস পল্লী স্থাপনে ৪১ প্রতিষ্ঠানের সাথে ২৩৯ একর জমির ইজারা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এসব প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যার মাধ্যমে প্রায় ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমসমূল্যের উৎপাদন ও রপ্তানির পথ সুগম হবে। বিজিএমইএ মূলত গার্মেন্টস এবং গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সেক্টরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী সেই লক্ষ্যে বেজার আওতাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ৫০০ একর জমি বরাদ্দ প্রদানে বেজা সম্মত হয়। এবিষয়ে ২০১৮ সালে ২১ মার্চ বেজা ও বিজিএমইএর মধ্যে একটি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর হয়। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১৭ মার্চ বেজা ও বিজিএমইএর ৪১ প্রতিষ্ঠানের সাথে জমি বরাদ্দের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সমঝোতা স্মারক হলেও বেজা বিজিএমইএ গামের্ন্টস পল্লী এলাকায় দীর্ঘ দিন উন্নয়ন কাজ করেনি। অবশেষে চলতি বছরের ২১ জুলাই উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করা হয়।

বেজা সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের টু-এ এর আওতাধীন ৯৪০ একর এবং টু বি এর আওতাধীন গার্মেন্টস পল্লীর ৫০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ওই দুই এরিয়ায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয়েছে ইন্টারনাল সড়ক ও ড্রেনেজ নির্মাণ কাজ। শুধু তাই নয় আগামী ৬ মাসের মধ্যে এসব এলাকায় গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ দেবে বেজা। পর্যায়ক্রমে ইটিপিসহ অন্যান্য ইউটিলিটি সেবা নিশ্চিত করবে। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় শীঘ্রই সেখানে কারখানা নির্মাণ করতে পারবে বলে আশা করছে বিনিয়োগকারীরা। আগামী ২ বছরের মধ্যে শেষ হবে প্রকল্পের কাজ। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের টু-এ এরিয়ায় রয়েছে ৯৪০ একর। ওই এলাকায় বরাদ্দযোগ্য ৭০০ একর জায়গার মধ্যে প্রায় সবগুলো জায়গা বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টু-বি এরিয়ায় ৫০০ একর জায়গায় গড়ে উঠবে বিজিএমইএ গার্মেন্টস ভিলেজ। সেখানে প্রায় ৩২১ একর জায়গা গার্মেন্টস কারখানা নির্মানের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাকি জমিতে সবুজায়ন, ইন্টারনাল সড়ক, ড্রেন, ইটিপি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার অবকাঠামো নির্মিত হবে। গার্মেন্টস পল্লীর উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারস লিমিটেড এবং টু-এ এরিয়ায় উন্নয়ন কাজ করছে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন। প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই দুই প্রকল্পে ২৩ কিলোমিটার ২ লেনের রাস্তা ও ২৯ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করা হবে।

বিজিএমইএ গামের্ন্টস পল্লী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ড্রেন ও সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করেছে বেজা। সড়ক নির্মাণের জন্য এস্কেভেটর দিয়ে মাটি ভরাট করা হচ্ছে। ড্রেনেজ ও সড়ক নির্মাণের পর উদ্যোক্তারা কারখানা নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারবেন। বিজিএমই গামের্ন্টস পল্লী এরিয়ায় উদ্যোক্তাদের জন্য ৩৩ একর, ৩০ একর, ২০ একর, ১০ একর, ৮ একর, ৬ একর, ৭ দশমিক ৫ একর, ৩ একর, ৪ একর, ২ একর এবং সর্বনিম্ম ১ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বিজিএমইএ গার্মেন্টস পল্লীতে কারখানা নির্মাণের জন্য ৪০ জন বিনিয়োগকারীকে ২৩৭ একর জায়গাও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বিজিএমইএ’র পরিচালক ও ক্লিপটন গ্রুপের সিইও এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ইন্টারনাল সড়ক না থাকায় গার্মেন্টস ভিলেজে এতদিন কারখানা নির্মানের কাজ শুরু করা যায়নি। যেহেতু সেখানে সড়ক, ড্রেন নির্মাণের কাজ শুরু হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক বলেন, শিল্পনগরের বিজিএমইএ গামের্ন্টস পল্লীসহ দুইটি জোনে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীরা চাইলে এখনই কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারে।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন ‘বেজা বিনিয়োগকারীকে সব ধরনের সেবা প্রদানে বদ্ধপরিকর’ উল্লেখ করে বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগকারীদের পরিষেবা প্রদানে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও বেজা তা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে সব সরকারি সংস্থার সঙ্গে সুসমন্বয়ের মাধ্যমে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ নিশ্চিত করছে।’

কেন্দ্রীয়ভাবে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপন করে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় আন্তর্জাতিকমান নিশ্চিত করতে বেজা উন্নয়ন অংশীদারের সঙ্গে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।

বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ:: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে দেশি-বিদেশি ১৫২টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করছে। যার মধ্যে ৮০ শতাংশ দেশি-বিদেশি যৌথ এবং পুরোপুরি বিদেশি মালিকানার প্রতিষ্ঠানও আছে। বার্জার বাংলাদেশ তাদের তৃতীয় এবং সবচেয়ে বড় কারখানা স্থাপন করতে চায়। এ জন্য তারা বিনিয়োগ করবে ২০০-২৫০ কোটি টাকা, যে কারখানার কাজ ৫ বছরের মধ্যে সমাপ্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। শিল্পনগরের ৩৩ হাজার একর জায়গায় পর্যায়ক্রমে ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা, এখানে প্রায় ২০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হবে। এই শিল্পনগরে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল, কেমিক্যাল, ফার্মাসিটিক্যাল, বিদ্যুৎ ও গ্যাস, খাদ্য ও কৃষি, চামড়া, ইস্পাত, ইলেক্ট্রনিক্স, হোটেল এবং পর্যটন, সিরামিকস ও অন্যান্য। ভারত, নেদারল্যান্ড, চীন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর কোরিয়া, আমেরিকা, জাপান, জার্মানি, ইউনাইটেড কিংডম, থাইল্যান্ডসহ দেশি-বিদেশী যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ফন ইন্টারন্যাশনাল, বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন লিমিটেড, আরব বাংলাদেশ ফুডস লিমিটেড, গ্যাস-১ লিমিটেড, অনন্ত এপারেলস লিমিটেড, বিআর-পাওয়ারজেন লিমিটেড, এশিয়ান পেইন্টস লিমিটেড, এসিআই লিমিটেড, ইনটিগ্রা এপারেলস (বাংলাদেশ) লিমিটেড, হামকো করপরেশান লিমিটেড, ওভারসিজ মার্কেটিং করপরেশান (প্রাইভেট) লিমিটেড, যমুনা স্পেকটেক জেভি. লিমিটেড, আরমান হক ডেনিমস লিমিটেড, গ্রিন হেলথ লিমিটেড, রেজা ফ্যাশান লিমিটেড, নাফা এপারেলস লিমিটেড, বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেড, চিটাগাং পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, ফখরুদ্দিন টেক্সটাইল লিমিটেড, রাতুলস এপারেলস লিমিটেড, ম্যাংগো টেলিসার্ভিস লিমিটেড, মেট্টো নিটিং ও ডাইং মিলস লিমিটেড, জুহানা টেক্সটাইলস লিমিটেড, পিএইচপি ষ্টিল ওয়ার্কস লিমিটেড, রাকুয়েফ এপারেলস ওয়াশিং ও প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, আলিফ এমব্রয়ডারি ভিলেজ লিমিটেড, অসওয়াদ কম্পোজিট মিলস লিমিটেড, অষ্ট-বাংলা (জেভি) এক্সেসরিস ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড, অসওয়াদ কম্পোজিট মিলস লিমিটেড, আমান স্পিনিং মিলস লিমিটেড, ম্যাকডোনাল্ড ষ্টিল বিল্ডিং প্রোডাক্ট লিমিটেড, জাহাঙ্গীর ষ্টিল মিলস লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, হেল্থকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, ওয়েল কম্পোজিট নিট লিমিটেড, মাহিন ডিজাইন এটিকেট (বাংলাদেশ) লিমিটেড, ইউরেশিয়া ফুড প্রোসেসিং (বাংলাদেশ) লিমিটেড, জুজুট জিনইয়ান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি লিমিটেড, কারমো ফোম ও এডহেসিভ ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড, মডার্ন সিনট্যাক্স লিমিটেড, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, কোয়ালিটি ফ্যাশান ওয়্যার লিমিটেড, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশান কোম্পানি, বিডিকম অনলাইন লিমিটেড, মার্চেন্ট মেলবোর্ন প্রাইভেট লিমিটেড, সুরজিন টেক কোম্পানি লিমিটেড, স্টার এলাইড ভেঞ্চার লিমিটেড (জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড), টেকনো ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড, ভিকার ইলেকট্রিক্যালস, ইস্ট এশিয়ান কক্স, এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস (ইসিফোরজে), জিয়াংসু ইয়াবাং ডাইইস্তাফ কোম্পানি লিমিটেড, এইচএ টেক লিমিটেড, এসটেক লিমিটেড, সামুদা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি), মেট্টো স্পিনিং লিমিটেড, ম্যাক্সনস স্পিনিং লিমিটেড, ম্যাক্সনস টেক্সটাইলস লিমিটেড, সিসিইসিসি বাংলাদেশ লিমিটেড, সিসিইসিসি বাংলাদেশ লিমিটেড, এপারেল গ্যালারি লিমিটেড, কলম্বিয়া গার্মেন্টস লিমিটেড, কলম্বিয়া এপারেল লিমিটেড, কলম্বিয়া গিয়ার্স লিমিটেড, আরডিএম এপারেল লিমিটেড, মারস স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড, ব্যাবিলন গার্মেন্টস লিমিটেড, ব্যাবিলন ক্যাজুয়াল ওয়ার লিমিটেড, ফোর এইচ ফ্যাশনস লিমিটেড, চামর্স ফ্যাশন, শিন শিন অ্যাপারেলস লিমিটেড, ভিজ্যুয়াল নিট ওয়ার্স লিমিটেড, স্যামস অ্যাট্রি লিমিটেড, ইউরেনাস এপারেল লিমিটেড, টিবিএইচ ফ্যাশন টেক্স (প্রাইভেট) লিমিটেড, অ্যাডভান্স ওয়ার্ল্ড লিমিটেড, আল-ইত্তেফাক টেক্সটাইল লিমিটেড, বি.এল.পি. ওয়ার্ম ফ্যাশন লিমিটেড, চৌধুরী ফ্যাশন ওয়ার লিমিটেড, ওয়েল ফ্যাশন লিমিটেড, পিলিয়ন স্টাইল লিমিটেড, গ্রাফিক্স টেক্সটাইল লিমিটেড, এস এফ ডেনিম পোশাক লিমিটেড, এসকিউ সেলসিয়াস লিমিটেড, ইম্প্রেসিভ নিট কমপোজিট লিমিটেড, আফরাহ ড্রেসস লিমিটেড, ডেনিম ফ্যাশনস লিমিটেড, এনার্জিপ্যাক ফ্যাশনস লিমিটেড, ইএইচ ফ্যাব্রিক্স লিমিটেড, গেøাবাল শার্টস লিমিটেড, প্যাসিফিক কটন লিমিটেড, ক্লিফটন কটন মিলস লিমিটেড, ক্লিফটন এপারেলস লিমিটেড, করিম টেক্সটাইল লিমিটেড, অ্যাভেন্ট গার্মেন্টস লিমিটেড, শমসের রেজিয়া ফ্যাশন লিমিটেড, আল্পস অ্যাপারেলস লিমিটেড, ইমেজ গার্মেন্টস লিমিটেড, মাস্ক ট্রাউজার্স লিমিটেড, ডেলিকেট গার্মেন্টস লিমিটেড, আর. ও টেক্সটাইল মিলস (প্রাইভেট) লিমিটেড, ট্রেড ডিজাইন সলুইশান লিমিটেড, উত্তরা মোটরস লিমিটেড, এসবিজি, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস অথরিটি (বেপজা), মারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড।

উৎপাদনে যেসব কারখানা:: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের মিরসরাই অংশে বৃহৎ ৫ টি কারখানায় পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। কারখানাগুলো হলো ভারতের এশিয়ান পেইন্টস, জাপানের নিপ্পন স্টিল, ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, টিকে গ্রæপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামুদা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও ম্যারিকো। এছাড়া বসুন্ধরা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ও মডার্ন সিনটেক্স শিগগিরই উৎপাদনে যাবে। তবে এই জোন থেকে বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর রেলওয়ে ব্রিজের স্প্যান বসানোর জন্য ২০২২ সালের মার্চে সর্বপ্রথম পণ্য সরবরাহ করে ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রডাক্টস লিমিটেড।

বেজা জানায়, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হওয়া ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বিনিয়োগ করেছে ৩৫ মিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠানটির ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাবনা রয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৫০ জনের। নিপ্পন অ্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বিনিয়োগ করেছে ১৫ মিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠানটির ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাবনা রয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ১০০ জনের। এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড বিনিয়োগ করেছে ৩৪ মিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠানটির ৩৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাবনা রয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ১৩৫ জনের। সামুদা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড বিনিয়োগ করেছে ৮.২ মিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠানটির ৮.২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাবনা রয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ৩০ জনের। ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড বিনিয়োগ করেছে ২৬.৭২ মিলিয়ন ডলার। কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০১ জনের।

বিনিয়োগে না আসা প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ বাতিল:: চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর পরিদর্শনে আসেন। এসময় তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে। আগামী বছর আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাবে। তবে জায়গা বরাদ্দ নিয়ে বিনিয়োগে আসছে না এমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিনিয়োগে না আসা প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ বাতিল করা হবে। নতুন বিনিয়োগকারীকে ওই জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হবে।

তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর ঘিরে বিশাল ব্যাপ্তিতে শিল্পায়নে স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ন ঘটতে চলেছে। যা এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এবং বিশেষ মডেল ইকোনমিক জোন হিসেবে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়। পরিবেশকে ঠিক রেখেই সমস্ত উন্নয়ন কাজ পরিচালিত হবে। ইতিমধ্যে ১৮ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব এসেছে। শিল্পনগরে প্রথম ধাপে ৭ লাখ, প্রকল্প সম্পন্ন হলে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের টার্গেট রাখা হয়েছে।

পানি সরবরাহে বেজার মহাপরিকল্পনা:: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রথম পরিকল্পিত শিল্পনগর। এ বিশাল শিল্প নগরে দৈনিক পানির চাহিদা প্রক্ষেপণ করা হয়েছে প্রায় এক হাজার ১৩ মিলিয়ন লিটার। শিল্প নগরে পানির সমস্যা সমাধানে বেজার সঙ্গে কাজ করছে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডবিøউএম), জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই), চট্টগ্রাম ওয়াসা ও ওয়ারপো। শিল্প নগরে পানির সরবরাহে বেজা ইতিমধ্যে আইডবিøউএমের সহযোগিতায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শেষ করেছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুযায়ী এ শিল্পনগরের জন্য সেক্টর অনুযায়ী প্রতিদিন পানির চাহিদার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী পানি সরবরাহের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিনিয়োগকারীদের বর্তমান চাহিদা বিবেচনা করে বেজা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ৪০ টি গভীর নলক‚প স্থাপনের মাধ্যমে ২০ এমএলডি পানি উত্তোলন করা এবং ফেনীর মুহুরি রিজার্ভার থেকে ৫০ এমএলডি সারফেস ওয়াটার উত্তোলন। প্রাথমিক পর্যায়ে মুহুরি রিজার্ভার থেকে ৫০ এমএলডি সারফেস ওয়াটার সরবরাহে বেজা কাজ করেছে।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বিনিয়োগকারীদের আগামীতে পানির কোনো সমস্যা হবে না, বেজা গুণগতমানের ভালো পানি সরবরাহে বদ্ধপরিকর। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্পকালীন পানির চাহিদা মেটানোর জন্য গ্রাউন্ড ওয়াটার ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীতে সারফেস ওয়াটার ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় সুপার ডাইক

দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ সড়ক কাম বেড়িবাঁধ প্রতিরক্ষা এবং নিষ্কাশন প্রকল্প ‘সুপারডাইক’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর এলাকার পার্শ্ববর্তী সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার ২৩ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটির অধীনে ১৮.৯৪২ কি.মি উক‚লীয় বাঁধ নির্মাণ ছাড়াও ৬টি ¯øুইচ গেট নির্মাণ এবং ২০.৩২০ কি.মি খাল খনন করা হবে। ২৩ কিলোমিটার বাঁধটিকে ২ লেন সড়ক হিসেবে ব্যবহারের জন্য সড়কও নির্মাণ করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরের ২০ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে বাস্তবায়িত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর -প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শনে আসেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম এমপি। এসময় তিনি বলেন, ‘মিরসরাই উপজেলায় প্রায় ১৬ হাজার একর পতিত, বেড়িবাঁধের বাইরে জোয়ার-ভাটা প্রবণ জমি শিল্পাঞ্চলের জন্য সুপারডাইকের মাধ্যমে রক্ষা করার জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পটির আওতায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ বাস্তবায়নাধীন ২৩ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণের ফলে সুরক্ষা পাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে প্রকল্প এলাকা বন্যা ও জলোচ্ছ¡াস হতে রক্ষা পাবে, ভ‚মিক্ষয় দূরিভ‚ত হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হবে। বাণিজ্যিক বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ঘটবে। সামগ্রিকভাবে প্রকল্প এলাকায় আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। যা আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতিতে যুগান্তকারী অবদান রাখবে।’

মিরসরাই উপকূলে নির্মিত হবে স্বতন্ত্র বন্দর:: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরকে কেন্দ্র করে মিরসরাই উপক‚লে একটি স্বতন্ত্র বন্দর নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। এশিয়ার সবচেয়ে বড় এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতি বিশ্বের বড় বড় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করতে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাতেই এই উদ্যোগ নিচ্ছে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় এই বন্দর প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা করবে। মিরসরাই সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করেছে ।

২০১৬ সালের ১০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা হয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), পিপিপি কর্তৃপক্ষ এবং হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনার লক্ষ্যে। সেখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর ঘিরে নতুন সমুদ্র বন্দর নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা হয়।

বন্দর নির্মাণের বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর সংলগ্ন সমুদ্র উপক‚লীয় এলাকায় পানির গড় গভীরতা ৬-৭ মিটার, যা ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ৮-৯ মিটারে উন্নীত করার মাধ্যমে ওই মাত্রার ড্রাফটের জাহাজ সার্বক্ষণিক বার্থিং করা যাবে। তবে প্রস্তাবিত বন্দর কার্যকর করতে হলে বহির্নোঙর থেকে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত চ্যানেল ড্রেজিং করতে হবে।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ বেজার পক্ষ থেকে সমুদ্র বন্দর নির্মাণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে একটি মতামত দিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) প্রধান করে ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি সমুদ্র উপক‚লীয় সংশ্লিষ্ট এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনসহ কয়েক বছরের উপক‚লীয় পানির গভীরতা এবং সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর এলাকায় সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করার বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদনে ইতিবাচক মতামত দেয়। ওই প্রতিবেদনের ভ‚মিকায় বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের জন্য দ্রæত আমদানি-রপ্তানির স্বার্থে উক্ত এলাকায় একটি বন্দরের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ হ্রাস করার জন্য হলেও মিরসরাই এলাকায় সমুদ্র উপক‚লে নতুন আরেকটি বন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সম্ভাব্য বন্দরের যোগাযোগ সুবিধা সম্পর্কে বলা হয়, প্রস্তাবিত বন্দর এলাকা ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন বিশিষ্ট মহাসড়কের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে থাকায় যোগাযোগ খুবই সহজ হবে। তাছাড়া মহাসড়কের ৫০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ থাকায় সড়ক ও রেলপথে সারাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ করা যাবে। প্রস্তাবিত সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হলে দেশীয় লাইটারেজ জাহাজ এবং বিদেশি বড় জাহাজ ওই এলাকায় বার্থিং করার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের চাপ কমে যাবে। সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ফলে পুরো এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এবং কর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত হবে এবং বেকারত্ব কমে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি প্রস্তাবিত সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন সহজ হবে।

রেল সংযোগ স্থাপিত হবে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে:: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে রেল সংযোগের পরিকল্পনা নিয়েছে রেলওয়ে। ইতিমধ্যে রেল সংযোগ প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি এবং ডিটেইল ডিজাইনিংয়ের কাজও শেষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীতে রেল সংযোগ দেওয়ার জন্য সাড়ে ১৩ কিলোমিটার রেললাইন নতুন করে নির্মাণ করতে হবে রেলওয়েকে। ঢাকা-–চট্টগ্রাম রেল লাইনের বড়তাকিয়া স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীর দূরত্ব সাড়ে ১৩ কিলোমিটার। চলতি বছরের ১০ জুলাই রেল সংযোগের বিষয়টি নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর পরিদর্শন করেন।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা বলেন, ইতোমধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ আমরা করেছি। এটা নিয়ে ২০১৯ সালে সম্ভ্যাতা যাচাই হয়েছিল। এটাকে এখন আরো আপডেট করতে হবে। ঢাকা-–চট্টগ্রাম রেল লাইনের মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়ায় আমাদের স্টেশন আছে। এই বড়তাকিয়া থেকে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীতে সংযোগ স্থাপিত হবে। চট্টগ্রাম বে–টার্মিনাল থেকে মালবাহী ট্রেনে পণ্য বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে আসবে। সেখান থেকে আবার মালবাহী ট্রেনে ঢাকায় চলে যাবে। আবার বে–টার্মিনাল থেকেও ট্রেনে করে সরাসরি ঢাকায় এবং বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরী থেকেও সরাসারি ঢাকায় পণ্য যাবে। চট্টগ্রাম বে–টার্মিনাল থেকে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে নদীর পাশ দিয়ে আলাদা সরাসরি সংযোগ করা যায় কিনা সেটাও ভাবা হচ্ছে। যদিও এটা অনেক ব্যয়বহুল হবে এবং কতটুকু টেকসই হবে সেটা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যদিও এটি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁঁকি মোকাবিলায় দুইটি আধুনিক ফায়ার স্টেশন:: অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকি মোকাবিলায় দুইটি আধুনিক ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরীতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিশাল এই শিল্প নগরীতে অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি হবে বলে মনে করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে দুইটি আধুনিক ফায়ার স্টেশন স্থাপন’ প্রকল্পটি ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উদ্যোগী মন্ত্রণালয় হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হলেও এটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। দুইটি ফায়ার স্টেশন নির্মাণে ব্যয় হবে ১২২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের মিরসরাই উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে ৬ হাজার ৯০২ ঘনমিটার ভ‚মি উন্নয়ন, অনাবাসিক স্থাপনা নির্মাণ (৩ তলা বিশিষ্ট ফায়ার স্টেশন ভবন, ২ তলা বিশিষ্ট কিচেন ও প্রেয়ার ভবন), ৬ তলা বিশিষ্ট স্টাফ কোয়ার্টার্স নির্মাণ, ভ‚-গর্ভস্থ পানি সংরক্ষণাগার নির্মাণ, পাম্প হাউজসহ ১ টি গভীর নলক‚প স্থাপন, ফুয়েল স্টোর, স্যালুটিং ডায়াস, ফ্লাগ স্ট্যান্ড নির্মাণ, ৩৭০.৮২ বর্গমিটার পেভমেন্ট ও অভ্যন্তরীণ সড়ক নির্মাণ, ২০৮১.৭৮ বর্গমিটার বাগান ও ৬২৮.৪৪ বর্গমিটার ট্রেনিং প্র্যাকটিস এরিয়া নির্মাণ, কার ওয়াশ র‌্যাম্প ও হোজ ওয়াশ হাউজ নির্মাণ, ২৪১.৩৯ মিটার বাউন্ডারি ওয়াল ও মেইন গেট নির্মাণ, ১৫০ মিটার অভ্যন্তরীণ ড্রেন নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জাম ক্রয় ইত্যাদি।

৫০ কিলোমিটার পাইপ বসানোর কাজ করেছে কেজিডিসিএল:: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পাঞ্চলের জন্য এবং চট্টগ্রাম, ফেনী ও বাখরাবাদ গ্যাস সংযোগ লাইনে হুকআপ সংযোগ চলছে। এতে ২৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০ কিলোমিটার পাইপ বসানোর কাজ শুরু করেছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। আগামী বছর ডিসেম্বরের আগে কাজ শেষ করে গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিউল আজম খান।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, পুরো লাইনে পাইপের আকার হবে ২০ ইঞ্চি। এ লাইন দিয়ে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। সরবরাহ হওয়া গ্যাসের একটা অংশ যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে, বাকিটা শিল্পকারখানায়। শিল্পনগর পুরোদমে চালু হলে গ্যাসের চাহিদা হতে পারে সাড়ে ৭শ’ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত। এতে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহে কেজিডিসিএলের কোনো সমস্যা হবে না। প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের জুলাইয়ে, মেয়াদ ছিল চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত। তবে মালামাল আমদানিতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় প্রকল্প মেয়াদ আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

পাইপ লাইন প্রকল্পটি গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের বাস্তবায়নাধীন ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৮১ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইনের শীতলপুর ও মিরসরাই অংশে নির্মিতব্য দুইটি টিবিএস (টাউন বর্ডার স্টেশন) এর সাথে সংযোগ করা হবে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১৫০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সংযোগ দিয়েছে কেজিডিসিএল।

এরআগে এই শিল্পাঞ্চলে ২৮৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন বসায় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। প্রাথমিক চাহিদা নিশ্চিতে একটি ২০০ মিলিমিটার ঘনফুটের সিজিএস ও ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের দুইটি ডিআরএস বসায় কেজিডিসিএল। সীতাকুÐের বড় দারোগাহাট এলাকার মূল সরবরাহ লাইন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করে কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ। নির্মিত পাইপলাইন দিয়ে দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব। ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ উদ্বোধন করা হয়।

যা জানালেন বেজার চেয়ারম্যান:: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন জানান, দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের একটি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এই শিল্পনগর স্থাপনের জন্য জমি বন্দোবস্ত ও অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। এরপর চলতে থাকে নানা পরিকল্পনা। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর শিল্পনগর স্থাপনের মহাপরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত হয়। সে অনুযায়ী একে কয়েকটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এরপর বিনিয়োগ উপযোগী করে গড়ে তুলতে শুরু হয় অবকাঠামো নির্মাণের যাবতীয় কাজ, যা এখনও চলমান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের বিষয়ে তিনি জানান, এই শিল্পনগরকে দেশের প্রথম পরিকল্পিত ও বৃহৎ শিল্পনগর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে, যাকে আমরা স্মার্ট নগরী বলছি। শিল্প ছাড়াও একটি পূর্ণাঙ্গ শহরের সম্ভাব্য সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেই সেটিকে গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে হালকা, মাঝারি, বৃহৎ ও ভারী সব ধরনের শিল্পকারখানা থাকবে। জনজীবনে প্রয়োজন এমন সব ধরনের পণ্যই উৎপাদন হবে সেখানে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও সেখানে থাকবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, নগর কেন্দ্র, বিজনেস হাব, সার্ভিস জোন, প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও পুনর্বাসন এলাকা। পরিকল্পনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানির জন্য শিল্পনগরে অত্যাধুনিক জেটি এবং লজিস্টিকস সুবিধা দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে আলাদা এলাকা। এ শিল্পনগর হবে সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। মাল্টিমোডাল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব কারণে দিন দিন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর।

শিল্পনগরে উৎপাদন কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি জানান, বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ দ্রæত গতিতে এগিয়ে চলছে। উদ্যোক্তাদের জমি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। বর্তমানে ২১ টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন। গত বছরের ২০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ৫ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো নির্মাণের উদ্বোধন করেছেন। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করবে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বসুন্ধরা কেমিক্যাল, এসকিউ, মডার্ন সিনটেক্স ও বাংলাদেশ অটো।

আরও পড়ুন