বৃষ্টিতে পোয়াবারো চবি’র গাছ পাচার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। পাহাড় ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রেয়েছে সবুজের সমারোহ বন, পাহাড়, পুকুর, গিরিপথ ও প্রশস্থ একটি ঝিরিপথ। বৃষ্টি হলেই ঝিরিতে তীব্র স্রোত দেখা দেয়। স্রোতের সাহায্যে অসংখ্য কাঠের গুড়ি ভেসে আসতে দেখা যায় প্রায়শই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাহাড়ি অঞ্চলে হওয়ায় এখানে অসংখ্য গাছপালা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম সীমানা জুড়ে বন, জঙ্গল আর পাহাড়ের সমারোহ। খুব বেশি একটা জনবসতি চোখে পড়েনা বললেই চলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে এসব পাহাড়ী জায়গাগুলো সরকার স্থানীয়দের কাছে দীর্ঘমেয়াদে ইজারা প্রদান করে থাকে। এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের তোয়াক্কা না করেই নিজেদের ইচ্ছেমতো গাছ কেটে পাচার করা হচ্ছে এসব দেশীয় সম্পদ। গাছ পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে ঝিরিপথগুলোকে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের পানি গড়িয়ে এসব ঝিরিতে পড়লে তীব্র স্রোতের সৃষ্টি হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গাছের গুড়িগুলোকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় এবং নির্দিষ্ট স্থান থেকে সেগুলো সংগ্রহ করা হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ধারা ৬ এর (খ) স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কতৃর্ক সরকারী বা আধা-সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্বিচারে গাছে কেটে দেশীয় বনজ সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। যা জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
গত ৯ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হল সংলগ্ন ব্রিজের নিচে অসংখ্য গাছ ভেসে আসতে দেখলে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা বিষয়টি প্রক্টরকে অবহতি করে। প্রক্টরিয়াল বডি ঘটনাস্থলে এসে ২৩ পিস গাছের গুড়ি উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরে নিয়ে যায়। ওইদিন ঘটনাস্থলে এসে গাছের গুড়িগুলোর উৎপত্তি এবং এগুলো বৈধ কিনা এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে বলে সংবাদমাধ্যমকে জানান প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার।
এই ঘটনার রেশ যেতে না যেতেই (৫অক্টোবর) আবারও ঝিরিতে ভাসিয়ে গাছ পাচার হতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তা শেখ মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জানান, বঙ্গবন্ধু বহল সংলগ্ন ব্রীজের নিচ থেকে যে গুড়িগুলো উদ্ধার করা হয়েছিলো সেগুলো আমার নিরাপত্তা দপ্তরে নিয়ে আসলে গুড়ির মালিক নিরাপত্তা দপ্তরে এসে তার জমির দলিলসহ মেম্বার, চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে গুড়িগুলো নিয়ে যায়।
পাহাড় কাটা বা পাহাড়ি গাছ কাটা ফৌজদারি অপরাধ হওয়ার পরেও তাদেরকে গুড়িগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তনি বলেন, গাছের গুড়িগুলো জীববিজ্ঞান অনুষদের পিছনের পাহাড় হতে কাটা হয়েছে যা বিশ্ববিদ্যালয় সীমানার বাইরে। তাছাড়া তারা আমাদেরকে দলিল দেখিয়েছে এবং গাছগুলো পাহাড় হতে সমতলে নিয়ে আশা বেশ কষ্টকর হওয়ায় তারা ঝিরিপথ ব্যবহার করছে।
২০২০ সালে প্রথম আলোয় এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্ন স্থাপনা, রাস্তাসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রায় সাড়ে ৭হাজার গাছ কেটেছে। যা পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন ইটের ভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
বর্তমানে হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে, ঝিরি দিয়ে গাছের গুড়ি ভেসে আসে। বিষয়টি নিয়ে সচেতন শিক্ষার্থীদের মাঝে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। কেউ বুঝে উঠতে পারছেন না, গাছ কারা কাটছে বা এর সাথে কারা জড়িত এবং এগুলো বৈধ না অবৈধ।
বনবিদ্যা বিভাগের ২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী ও লেখক কারিশমা ইরিন এ্যামি ভোরের দর্পণকে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকা থেকে বৃক্ষ নিধনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরেই একটি অসাধু চক্র জড়িত। ভয়ংকর এই সমস্যাটি সমাধান করতে হলে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে, সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকাগুলোতে এ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং অগোচরে বৃক্ষ নিধনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন প্রশাসনকে জানানোর ব্যবস্থা করে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেহেতু গাছ কাটার পর সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঝিরি দিয়ে পাচার করা হয়, সেহেতু গাছগুলো পাচারে ঝিরির কোন উৎসপথ ব্যবহার করা হয় তা চিহ্নিত করতে হবে এবং সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়াতে হবে, তাহলে এই সমস্যা অনেকটা কমে আসবে।
আইন বিভাগের ২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রাব্বি তৌহিদের মতে, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের কয়েকটা বনাঞ্চল জেলার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু কোন উপযুক্ত কারণ ছাড়া এভাবে গাছ কাটা অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় তার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সুনাম হারাবে। একই সাথে গাছ কাটার ফলে বণ্য প্রাণীক‚ল হারাবে তাদের উৎকৃষ্ট বিচরণ ভ‚মি। আমরা যদি এসব গাছ কাটা বন্ধ করতে না পারি, তাহলে প্রাচ্যের রাণী উপাধী পাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অপমানজনক হবে।