রাউজানে গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষ শূণ্য পঞ্চপাড়া গ্রাম

চট্টগ্রামের রাউজানের মেধাবী কলেজ ছাত্র ও একটি ডিমের খামারের তত্ত্বাবধায়ক শিবলী সাদিক হৃদয়ের খন্ডিত লাশ নিয়ে ফেরার পথে স্থানীয় জনতা পুলিশের গাড়ি অবরুদ্ধ করে। পুলিশের গাড়ি থেকে জোর করে ছিনিয়ে নেয় হত্যাকান্ডের মূলপরিকল্পনাকারী আসামিকে উত্তেজিত জনতা হত্যার প্রধান আসামীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেন। এসময় পুলিশের গাড়ি ভাংচুর এবং পাঁচ সদস্যকে আহত করে। এঘটনায় পুলিশের গাড়ি ভাংচুর, আসামি ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা ও পুলিশকে হামলার অভিযোগ এনে ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা রাউজান থানার উপ—পরিদর্শক (এসআই) আজিজুল হাকিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেন।

মামলার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে গ্রেপ্তার এড়াতে রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়া গ্রামে এখন পুরুষ শূণ্য হয়ে পড়েছে। অনেকের বাড়িঘরে ঝুলছে তালা। যে দিকে পারছেন সরে যাচ্ছেন। বর্তমানে গ্রামটিতে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সবার মনে কাজ করছে গ্রেপ্তারের ভয়।

খুন হওয়া শিবলী সাদিক নিহত রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়া গ্রামের মুহাম্মদ শফির ছেলে। তার বাবা পেশায় পিকআপ ভ্যানের চালক। শফির দুই ছেলের মধ্যে বড় শিবলী সাদিক হৃদয়।

বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পঞ্চপাড়া গ্রামজুড়ে বিরাজ করছে সুনশান নীরবতা। রাস্তা—সড়কে তেমন পুরুষ নেই। ঘটনার পর থেকে গ্রামের বাসিন্দারা গ্রেপ্তার ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বন্ধ রয়েছে আশরাফ শাহ মাজার গেটের পাশে দোকানপাট। আড্ডা নেই পাশের বড় বাজার ঈশানভট্টের হাটেও। সেখানে কিছু দোকান খোলা হলেও নেই আগের মতো লোকজন। এলাকায় গিয়ে অনেক খোঁজাখুজির পর কিছু নারী ও শিশুর দেখা গেলেও তাদের সবার মনে বিরাজ করছে আতঙ্কের ছাপ। তারা বলছেন, পুলিশ নাকি ধরে ধরে মানুষ নিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই অনেক ভয়ের মধ্যে আছি। দুশ্চিন্তায় তাদের চোখে ঘুম হারাম হয়ে পড়েছে। এলাকাজুড়ে এখনো থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। অনেক মহিলাও গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে।

এইদিকে হত্যাকান্ডের ঘটনা আদালতে বর্ণনা করেন উপজাতি দুই আসামি। তারা দুইজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। গত মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টে্রট শাহরিয়ার ইকবাল ও নুরুল হারুনের আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানান রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল হারুন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া ওই দুই আসামি হলেন সুইচিংমং মারমা (২৪) ও অংথুইমং মারমা (২৫)। আসামি সুইচিংমং মারমা রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার বড়ইছড়ির বাসিন্দা এবং অংথুইমং মারমা রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বাসিন্দা। চট্টগ্রাম সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টে্রট তৃতীয় আদালতের বিচারক শাহরিয়ার ইকবাল সুইচিংমংয়ের এবং ষষ্ঠ আদালতের বিচারক নুরুল হারুন অংথুইমংয়ের জবানবন্দি গ্রহণ করেন।

স্বীকারোক্তির বিষয়ে রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল হারুন বলেন, “গ্রেপ্তারকৃত দুই আসামি আদালতে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তিনি বলেন, শিবলী সাদিককে ঝগড়া—বাকবিতণ্ডার জেরে শায়েস্তা করতে ২৮ আগস্ট খামারের পেছনের পাহাড়ের প্রায় আট কি.মি দূরে নিয়ে যাওয়া হয়। পাহাড়ে তাকে হাত—পা বেঁধে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে তার পরিবারে ফোন করে ১৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।”

ওসি জানান, “অপহরণের একদিন পর অর্থাৎ ২৯ আগস্ট তাকে গলা কেটে হত্যা করে তারা। হত্যার পর শরীর থেকে হাত—পা, মাথা আলাদা করে পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে দেয় তারা। তখনো শিবলী সাদিকের পরিবারে জানতো না তাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপরে আসামিরা আবার মুক্তিপণ দাবি করলে তার বাবা বান্দরবানে গিয়ে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ তুলে দেন দুই ব্যক্তির হাতে। মুক্তিপণের পরেও তাকে ফেরত পাননি পরিবার। কারণে তাকে আগে হত্যা করা হয়।”

ওসি আরও বলেন, “স্বীকারোক্তিতে দুই আসামি জানান, হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনা করেন উমংচিং মারমা (২৬)।” তারা তিনজনকে গত রোবাবার চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যাকান্ডে আরও কয়েকজন জড়িত আছে বলে তারা জানান। তাদের দ্রুত গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে।

জানা যায়, গত সোমবার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে হৃদয়ের মরদেহ উদ্ধারের পর অভিযুক্ত উমংচিং মারমাকে নিয়ে ফেরার পথে উত্তেজিত জনতার রোষানলে পড়ে। তারা ওই যুবককে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। ভাঙচুর করা হয় পুলিশের গাড়ি। গণপিটুনিতে নিহত উমংসিং মারমা রাঙামাটির বেতবুনিয়া ইউনিয়নের রঙ্গিপাড়া গ্রামের উথোয়াইমং মারমার ছেলে।

স্থানীয় কদলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, গত সোমবার পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নিয়ে উত্তেজিত জনতা গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেন। হত্যার ঘটনায় পুলিশ মামলা করেছে।

রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল হারুন জানান, হৃদয়ের লাশ নিয়ে ফেরার পথে পুলিশের গাড়িতে হামলা, পুলিশের উপর হামলা ও আসামি ছিনিয়ে নিয়ে হত্যার ঘটলা মামলা দায়ের হয়। মামলায় আসামির সংখ্যা বা কারও নাম রাখা হয়নি। সবাই অজ্ঞাতনামা রাখা হয়েছে। আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করবো। তারপরে অভিযান পরিচালনা শুরু করবো। এখানে নিরপরাধ কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না।

আরও পড়ুন