প্রথম প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ইং
ঘটনার সময়কাল ১৯৮২। ফেব্রুয়ারী মাসের ৮ তারিখ। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার সরকার ২৭ নভেম্বরে নতুন মন্ত্রী সভা গঠন করেছে। নতুন মন্ত্রী সভার বয়স মাত্র দুই মাস হবে। সাত্তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন তৎকালীন পাবনার সংসদ সদস্য দেশের বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ডাঃ এম এ মতিন। তার শ্যালক বর্তমান বিএনপির স্হায়ী কমিটির সদস্য ও আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিমের বেয়াই সাবেক মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
এর আগে জিয়াউর রহমান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন লেঃ কর্ণেল অবঃ আবু সালেহ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান। তার স্থলে ডাঃ এমএ মতিনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পরই সন্ত্রাস দমন ও সন্ত্রাসী গ্রেফতারে কঠোর অবস্থান নেন তিনি।সন্ত্রাসীদের যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখান থেকেই গ্রেফতার করার নির্দেশনা দেয়া হয়। তৎকালীন বৃহত্তর ঢাকা জেলায় ছিলো আজকের গাজীপুর, টঙ্গী, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী পর্যন্ত। বিশাল এই জেলার আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব ছিলো ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এএফএম মাহমুদ আল ফরিদের উপর। ওই সময়ে তিনি একজন সৎ ও সাহসী পুলিশ অফিসার হিসেবে প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলে পরিচিত ছিলেন। মাত্র একদিন আগেই নতুন আইজিপি হিসেবে যোগদান করেছেন এএমআর খান।
৮ ফেব্রুয়ারী দুপুর ১২টায় ঢাকা জেলার সুপার এসপি ফরিদ আকরাম হোসাইনের সঙ্গে ল্যান্ড ফোনে (তখন মোবাইল ছিলো না) যোগাযোগ করেন। আকরাম হোসাইন তখন পুরান ঢাকার লালবাগ থানার ওসি। আগে থেকেই ব্যক্তিগতভাবে ঢাকার এসপির সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিলো। মাহমুদ আল ফরিদকে একজন সৎ ও পেশাদার পুলিশ হিসেবেই আকরাম হোসাইন জানেন। ঢাকার এসপি তাকে জানালেন, নরসিংদীর একটি হত্যা মামলাসহ বহু খুনের কুখ্যাত আসামি ইমদু যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের মিন্টু রোডের সরকারি বাসভবনে অবস্থান করছেন। তাকে গ্রেফতারে তার সহযোগিতার চান। এসপি মাহমুদ আল ফরিদ আরো বলেন, গতরাত থেকেই সিভিল পোশাকে তার বাহিনী বাড়িটির চারপাশে অবস্থান নিয়ে রেখেছে। বাড়ির ভেতরে খুনী ইমদুর অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে।কিন্তু মন্ত্রীর বাড়ি হওয়ায় রমনা থানাসহ ঢাকার কোন পুলিশ তাকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে না। তার সহযোগিতাই ইমদুকে মন্ত্রীর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসা সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
আকরাম হোসাইন একমাস আগেই গালকাটা কামালকে আটক করে আলোচনায় এসেছিলেন। তাই ঢাক জেলার এসপি ফরিদ আকরাম হোসাইনের সহযোগিতা চেয়েছেন। এ অবস্থায় ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার এফএফএম মাহমুদ আল ফরিদকে সহযোগিতার জন্য আকরাম হোসাইন তার থানার ফোর্স নিয়ে বের হয়ে পড়েন। ৩০ মিনিটের মধ্যেই পৌছে যান। এসময় এসপি জানালেন, সকালেই মন্ত্রী বের হয়ে গেছেন। বিকালে মন্ত্রী ফেরার আগেই ইমদুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে হবে। এরপর এসপি মাহমুদ আল ফরিদের সঙ্গে পরামর্শ করে কৌশল ঠিক করেন। এর মধ্যেই মন্ত্রীর বাড়ির চারপাশে সিভিল পোশাকে পুলিশের অবস্থান বাড়ানো হয়।যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকল পুলিশ সদস্যদের প্রস্তুত করা হয়।
পুলিশ বাড়িটির চারপাশে অস্ত্র তাক করে রাখে। হ্যান্ড মাইক বা হেলারের সাহায্যে বার বার ইমদুকে আত্মসমর্পণ করার কথা বলা হয়।তৎক্ষণে মিন্টু রোডের মন্ত্রী পাড়ার সকল রাস্তাগুলোর নিয়ন্ত্রণ পুলিশ নিয়ে নেয়। যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। হ্যান্ডমাইকে বার বার বলা হচ্ছিলো বাড়িটি চারপাশ থেকেই পুলিশ ঘিরে রেখেছে, কোন ছলচাতুরী না করে ইমদুকে দু হাত উঁচু করে ঘরের বাইরে লনে চল আসার আহবান জানানো হয়। তাকে গ্রেফতারে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশ রয়েছে। তাই পালানোর কোন চেষ্টাই সফল হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দই আসছিলো না। সব জায়গায় যেনো পিন পতন নিস্তব্ধতা। মাঝে মধ্যে দুরে চলাচলকারী গাড়ির হর্ন নিরবতা ভেঙ্গে দিচ্ছিলো। গাছগুলোতে থাকা পাখিগুলোর কিচিরমিচির শব্দ রহস্যময় নিরবতা পালন করতে থাকে।
মন্ত্রীর বাড়ির প্রধান ফটকেই এসপি মাহমুদ আল ফরিদ ও আকরাম হোসাইনের সতর্ক অবস্থান। যেকোন ঘটনা মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। গাছপালা ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই বাড়িটির গাছের ডালের ফাঁকফোকর দিয়ে সোনালী সূর্যের কিরন বাড়ির আঙ্গিনায় এক আলোক ঝলমল পরিবেশ তৈরী করেছে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইচ্ছা থাকলেও অবলোকনের কোন সুযোগ নেই অভিযানে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ও ফোর্সদের।প্রতিটি মূহুর্তই শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা, কখন এই দানবটা বের হয়ে আসবে। ৪০ মিন্টু রোডের যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাড়িটির দরজা- জানালা হতে শুরু করে সব দিকেই পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি। বার বার ইমদুকে সতর্ক করা হচ্ছিলো তিনি যেনো কোন ছলচাতুরীর আশ্রয় না নিয়ে নিজেকে পুলিশে সোপর্দ করে দেন।
ঘড়ির কাঁটা আর সূর্য তো থেমে নেই। সময় গড়িয়ে চললো। আকষ্মিক ভেতর থেকে ঘিয়া রংয়ের কাশ্মীরি শাল গায়ে সুঠাম দেহের অধিকারী এক যুবক বারান্দায় হেঁটে হেঁটে বাড়ির আঙ্গিনার দিকে আসতে শুরু করলো।মূহুর্তেই পরিবেশ বদলে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। এই সেই যুবক। যার দাপটে গাজীপুর থেকে নরসিংদী পর্যন্ত মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যেত। যার নাম শুনলেই টগবগে তরুণের রক্ত হিম হয়ে যেত। হ্যাঁ, তিনিই সেই ইমদু। কুখ্যাত ইমদু। যিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির পাশে বসতেন জনসভায় বক্তব্য রাখতেন। আজ সেই বাঘই বিড়ালে পরিনত হয়ে অসিম ক্ষমতার গুহা থেকে বের হয়ে আইনের শিকলের খাঁচার দিকেই এগিয়ে আসছেন।
ঘড়ির কাটায় তখন পুরো ৫টা বাজেনি। আকরাম হোসাইন হ্যান্ডমাইকে তার গায়ে থাকা শালটি খুলে মাটিতে ছুড়ে ফেলতে বললেন।এরপর তার দিকে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে গেলেন। দু’হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, তিনিই সেই ইমদু। যার জন্য গত এক সপ্তাহ তৎকালীন ঢাকা জেলার একদল পুলিশ সিভিল পোশাকে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।
হাতে হ্যান্ডকাপ পরা ইমদুকে কঠোর পুলিশ প্রহরায় তুলে দেয়া হয় এসপি এএফএম মাহমুদ আল ফরিদের জিপে। এভাবেই গত এক সপ্তাহের নজরদারি ও ২৪ ঘন্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের সমাপ্তি ঘটে। দেশের এক ভয়ংকর খুনীকে মন্ত্রী”র সরকারি বাসভবন থেকে গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে একটি বার্তা পৌছে দেয়া হয়, সন্ত্রাসীরা যেখানেই থাকুক তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে।
এসি আকরাম হোসাইন সেই দিন ইমদুকে গ্রেফতারের বর্ণনা দিতে গিয়ে আরো জানালেন, আমরা সর্বক্ষণই সতর্ক ছিলাম ভয়ংকর এই খুনী কোন ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয় কিনা। ভেতরে সে একাই অবস্থান করছিলো। তার কোন সঙ্গী ছিলো না। আর যুবমন্ত্রী আবুল কাশেম জেনে গিয়েছিলেন তার বাড়িতে ইমদুকে গ্রেফতার অভিযানের কথা। তাই তিনি আর সচিবালয় থেকে বাড়ি মুখি হননি। বিকেল ৫ টার মধ্যেই অভিযান শেষ হয়ে যায়। ভয়ংকর খুনী ইমদু যে বাড়িতে বাঘের বেশে প্রবেশ করতেন আর দাপিয়ে বেড়াতেন সারা দেশ, সেই ইমদু বিড়ালের মতো সরকারের মন্ত্রীর বাড়ি থেকে আইনের কাছে নিজেকে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এসি আকরাম মনে করেন, সন্ত্রাসীদের জীবনটাই এমন। সব কিছুরই শেষ আছে। বাংলাদশের ইতিহাসে বিশাল ক্ষমতার অধিকারী অপরাধ জগতের এই সম্রাটকেও আইনের কাছে পরাজিত হতে হয়েছিলো, এটাই ইতিহাস ও বাস্তবতা।
এসি আকরাম হোসাইন বলেন, মন্ত্রীর বাড়ি থেকে ইমদুকে গ্রেফতারের ঘটনাটি ছিলো সকল সন্ত্রাসীদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা। রাতেই তিনি জানতে পারেন, ইমদু তার ভয়ংকর জীবনের ইতিহাস বর্ননা শুরু করেছেন। আকরাম হোসাইন মিন্টু রোডে মন্ত্রী আবুল কাশেমের বাড়ির আঙ্গিনায় দুর্ধর্ষ ইমদুর হাতে যে হাতকড়াটি পরিয়েছিলেন সেই গ্রেফতারই ইমদুকে ফাঁসির মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিলো।
১৯৮২ সালের আগষ্ট মাসে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢাকার “ক” অঞ্চলের ১নং সামরিক আদালতের রায়ে ইমদুর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সেই সঙ্গে ঢাকা, কালিগন্জ, জয়দেবপুর, টঙ্গী,নরসিংদী”র এক ভয়ংকর মানুষরূপী দানব ইমদুর রাজত্বের অবসান ঘটে।