এসি আকরামের জবানবন্দিঃ বাড়ির ক্রেতা সেজে বাচ্চু ডাকাতকে আটক

প্রথম প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২১ইং

আশির দশকের প্রথম দিকের কথা। মিরপুর তখন ঢাকার পার্শ্ববর্তী পৌরসভা। এই পৌরসভার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ছিলেন হারুন অর রশিদ মোল্লা। যিনি হারুন মোল্লা নামেই পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে মিরপুর ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়, হারুন মোল্লা সংসদ সদস্য হন। বর্তমানে তার একছেলেও সরকার দলীয় আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য। বলছিলাম, ঢাকার মিরপুরের কথা। আকরাম হোসাইন লালবাগ থানায় কর্মরত ছিলেন। মিরপুর, পুরান ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জে ডাকাতির উপদ্রব বেড়ে গিয়েছিলো। এনিয়ে জনমনে আতংক তৈরী হয়ে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলো।

বিভিন্ন সূত্রে সংবাদ আসলো এই ডাকাতির মূল হোতা বাচ্চু ডাকাত। তার বাড়ি মিরপুরে। চিরিয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন পার হয়ে একটি গ্রামে বাচ্চু ডাকাতের বাড়ি। যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক থেকে খুবই নাজুক এলাকা। বেশীর ভাগই মাটির কাচা রাস্তা। গাড়ি চলাচলের চিন্তাই করা যায় না। আকরাম হোসাইন বাচ্চু ডাকাতের সব খোঁজখবর নেয়া শুরু করলেন। ওই গ্রামে লোক নিয়োগ করলেন বাচ্চু ডাকাতের গতিবিধির উপর নজরদারীর জন্য। সব ঠিকঠাক থাকলেও তাকে আটক করে নিয়ে আসতে গ্রামের লোক বাধা হয়ে উঠতে পারে। এমন তথ্য ছিলো সোর্সের। কারণ বাচ্চুর ডাকাতি কর্মকান্ড সম্পর্কে গ্রামবাসী ভালোভাবে জানতেন না। তাই তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান হারুন মোল্লার সঙ্গে দেখা করে বাচ্চু ডাকাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে তার সহযোগিতা চান। হারুন মোল্লা সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। নজরদারি চলতে থাকলো বাচ্চু ডাকাতের ওপর। এরই মধ্যে খবর আসলো বাচ্চু ডাকাতের বাবা তাদের বাড়ি বিক্রি করতে ক্রেতা খোঁজছেন। শিকার হাতছাড়া হওয়ার আশংকা। তাই কি করা যায় ভাবতে শুরু করলেন। এতো দুর এগিয়ে আর পিছ পা হতে রাজী নন কাজ পাগলা পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইন। সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়ির ক্রেতা সেজেই বাচ্চু ডাকাতের বাড়িতে যাবেন। মিরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান হারুন মোল্লাকে অবহিত করলেন।

একদিন দুপুরের পরই দালালকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ক্রেতা সেজে মিরপুরের বাচ্চু ডাকাতের বাড়ি দেখতে গেলেন। সিভিল পোশাকে একদল পুলিশ আশেপাশে রাখা হয়েছিলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবার পরনে লুঙ্গি শার্ট বা গেঞ্জি। বাড়ির ক্রেতা আকরাম হোসাইন প্যান্ট আর শার্ট পরিহিত ছিলেন। বিকেলেই পৌঁছে গেলেন বাচ্চু ডাকাতের বাড়িতে। ঘুরে ঘুরে বাড়িটি দেখলেন এবং পছন্দ হয়েছে জানিয়ে বায়না বাবদ ১০হাজার টাকা বাচ্চু ডাকাতের বাবার হাতে দিলেন। এরপর আকরাম হোসাইন তার কয় ছেলে মেয়ে, বিষয়াদি ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইলেন। তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে থাকলেও বড় ছেলে বাচ্চু বাহিরে থাকায় তার দেখা পাচ্ছিলেন না আকরাম হোসাইন। তাই তিনি কৌশল খুঁজছিলেন কিভাবে বাচ্চুকে তার সামনে আনা যায়। এসময় তিনি বাচ্চুর বাবাকে বলছিলেন, আপনার বড় ছেলে যদি বাড়ি বিক্রিতে আপত্তি করে তাই তার মতামত আমার জানা দরকার। তার মতামত না জেনে আমার বাড়ি কেনা ঠিক হবে না। এভাবেই সময় পার করে শিকারের অপেক্ষা করছিলেন। বাচ্চুর বাবা বার বার বলছিলেন, বড় ছেলে কোন আপত্তি করবে না। এভাবে কয়েক ঘন্টার বেশী সময় চলে যাওয়ার পরও বড় ছেলে বাচ্চুর দেখা পাচ্ছিলেন না। তাই সন্ধ্যার আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসলেন। এসময় একটি চায়ের দোকানে সবাই চা পান উপলক্ষে একত্রিত হচ্ছিলেন। এমন সময় সোর্স জানালো বাচ্চু ডাকাত এ দিকেই হেটে হেটে আসছে।কাংখিত শিকার হাতের নাগালে চলে আসছে বুঝতে পেরে তিনি সতর্ক হলেন। এসময় আকরাম হোসাইনের শরীর শিহরিত হয়ে উঠলো। সুযোগ যেনো হাতছাড়া না হয়। তাদের নিকটে আসতেই চারপাশ থেকে অপ্রস্তুত বাচ্চু ডাকাতকে ঘিরে ফেলে আকরাম হোসাইনের দলটি। পুলিশ পরিচয় দিয়েই দ্রুত বাচ্চুর হাতে হাতকড়া পরিয়ে গ্রাম থেকে রওনা দেন। তখন পৌরসভার চেয়ারম্যানের লোকেরা গ্রামবাসীদের কোন ঝামেলা না করতে অনুরোধ করেন। এভাবেই কুখ্যাত বাচ্চু ডাকাতকে আটক করা হয়।

সন্ধ্যা গড়িয়ে বাচ্চু ডাকাতকে নিয়ে পুলিশের টিমটি যখন মিরপুর থানায় প্রবেশ করে তখন মসজিদ গুলোর মাইকে মাগরিবের আজান হচ্ছিল। এর কিছুক্ষণ পরই বাচ্চু ডাকাতের বাবা মিরপুর থানায় এসে ছেলের কৃতকর্মের জন্য আকরাম হোসাইনের কাছে ক্ষমা চান এবং বাড়ি ক্রয়ের জন্য আকরাম হোসাইন যে বায়না করেছিলেন সেই ১০ হাজার টাকা ফেরত নিতে অনুরোধ করেন। মোবাইল ট্র্যাকিং বা আধুনিক প্রযুক্তি নয় মেধা, বুদ্ধি আর কৌশলে আকরাম হোসাইন কুখ্যাত বাচ্চু ডাকাতকে আটক করে ঢাকার মানুষের নিরাপদ ঘুম নিশ্চিত করে পুলিশ বিভাগকে গৌরবান্বিত করেন।

আরও পড়ুন