এসি আকরামের জবানবন্দিঃ ১৯ ঘন্টার অভিযানে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের মালামাল উদ্ধার

প্রথম প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২১ইং

দেশে সামরিক শাসন চলছে। সবকিছুতেই স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিচারপতি সাত্তারের নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে সরিয়ে ৮২’র ২৪ মার্চ সেনা প্রধান হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছেন। এর কয়েক মাস পরের ঘটনা ১১ জুলাই।ঠিক সন্ধ্যার পূর্ব মূহুর্ত। তৎকালীন লালবাগ থানার ওসির কক্ষে দায়িত্বপালনকালীন সময়ের।বিদেশি একজন ভদ্র মহিলা আরও চারজনসহ আমার কক্ষে প্রবেশ করেন। সবার মুখেই আভিজাত্যের ছাপ।একজন বললেন, l CARL W.SCHMIDT AMBASSADOR OF THE UNITED STATE OF AMERICA DHAKA, BANGLADESH. আমি দাঁড়িয়ে উনাদেরকে বসার জন্য আহবান জানাই, উনারা বসলেন। বলে রাখা দরকার যে, আমেরিকার অ্যাম্বাসেডরের সরাসরি কোন থানায় যাওয়ার নজির নাই, তাই আমি কিছুটা বিচলিত হই।

বিনয়ের সঙ্গেই উনাদের আগমণের কারণ জানতে চাইলাম। তিনি ইংরেজিতে যা বলেছিলেন, বাংলায় অনুবাদ করলে অর্থ হয় “লালবাগ থানাধীন বকশিবাজারে হোসেনী দালান নামে খ্যাত শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম উপাসনালয় ইমাম বারা দেখতে এসেছিলেন, বাইরে গাড়ি রেখে ভিতরে ঢুকেন, পরিদর্শন শেষে গাড়িতে এসে দেখেন তাদের সাথে ভদ্র মহিলা যিনি অ্যাম্বাসেডরের সচিব, তার ক্যামেরা, ব্যক্তিগত কিছু ডুকুমেন্ট ও পার্সটি নাই। উক্ত পার্সে মূল্যবান কাগজপত্র ছাড়াও ভদ্রমহিলার একটি রিডিং গ্লাস (চশমা) ছিলো। উনারা মামলা করবেন এবং তাদের দাবি, যাতে হারানো জিনিসগুলো দ্রুত উদ্ধার হয়। সঙ্গে আরও বলেন, তাদের দেশে হলে নাকি ইতোমধ্যে চোরাই মালামাল উদ্ধার হয়ে যেত। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলি, SIR I MUST TRY, BUT WE HAVE VERY OLD METHOD IN INVESTIGATION. এরপর উনি ওনার কয়েকটি ফোন নাম্বার আমাকে দেন। আমেরিকার অ্যাম্বাসেডর বার বার বলছিলেন, তার সেক্রেটারির পার্সে থাকা রিডিং চশমা ও কিছু ডকুমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর তিনি চলে যান।

আমি আমার পেশাগত দায়িত্ব এবং দেশের মর্যাদার কথা ভেবে প্রস্তুতি নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে থানা থেকে বের হয়ে যাই। প্রথমে হোসনী দালান গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সকল তথ্য সংগ্রহ করি। ওই সময়ে ওই এলাকার পৌর কমিশনার এবং চেয়ারম্যান ছিলেন মরহুম গোলাম মোরশেদ সাহেব। ভদ্রলোক আমার খুব স্নেহের ছিলেন। তার সহযোগিতা চাইলে কিছু সহায়ক তথ্য পাই। তার ছোট ভাই গোলাম কিবরিয়াও এ বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়ে সহায়তা করলেন। বিশেষ করে হোসনী দালান এলাকায় কারা টানা পার্টি বা চোর, কারা এই কাজ করতে পারেন এমন সন্দেহভাজন কয়েকজনের নাম বললেন। তালিকা তৈরী করে দুইজনকে আটক করলাম। এরপর একটানা উনিশ ঘন্টা অভিযান চালিয়ে কেরানীগঞ্জের শুভাইড্ডা থেকে তৃতীয় অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে শতভাগ চোরাই মাল উদ্ধার করি। বিদেশীদের চুরি হওয়া মালামাল শতভাগই উদ্ধার করতে পেরে মনে হয়েছিল জাতি, দেশ ও পুলিশ বিভাগের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে পারলাম। দেশে সেনা শাসন চলাকালে দিনে-দুপুরে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের মালামাল গাড়ি থেকে চুরি হয়ে যাওয়ায় দেশের ভাবমূর্তির বিষয়টি সামনে চলে এসেছিলো। থানায় ফিরে তাদের দিয়ে যাওয়া দূতাবাসের কয়েকটি নাম্বারের একটি নাম্বারে ফোন করি। অ্যাম্বাসেডর মহোদয় নিজেই ফোন ধরেন। আমি খবর জানিয়ে বলি, মালগুলি উদ্বার হয়েছে। স্যার, অনুমতি দিলে নিয়ে আসব। তিনি বললেন NO NO NO, I AM COMMING SOON. পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই তিনি থানায় আসেন। তিনি আমাকে বলেন, MR. OC,YOU ARE A LIAR, OTHER DAY YOU TOLD, YOU HAVE VERY OLD METHOD IN INVESTIGATION, BUT YOUR OLD METHOD IS BETTER THAN OUR NEW METHOD. অ্যাম্বাসেডর বলছিলেন, তুমি মিথ্যাবাদী। কারণ তুমি আমাদের আমেরিকার মতো আধুনিক প্রযুক্তি নাই বলে উদ্ধারের চেষ্টার কথা বলেছিলে। এখন দেখলাম তোমাদের পুরাতন কৌশল আমাদের আধুনিক প্রযুক্তির চেয়ে এগিয়ে। সেদিন আমেরিকার অ্যাম্বাসেডরের কথায় বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম বলছিলেন, আকরাম হোসাইন। পরদিন দুপুর তিনটায় তৎকালীন আইজিপি এম এম আর খান ফোনে তাৎক্ষনিক ওনার অফিসে ডাকলেন। পুলিশ সদর দপ্তরে পৌঁছে ওনার কক্ষে ঢুকতেই তিনি দাড়িয়ে হাত মিলিয়ে বললেন, WE ARE PROUD OF YOU. টেবিল থেকে তিনটি টাইপ করা কাগজ হাতে দিয়ে পড়তে বললেন, পড়লাম বেশ পুলকিত হলাম।

এইচ এম এরশাদ সাহেব ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তার স্বাক্ষর করা একটি চিঠি। প্রধান সামরিক আইন প্রসাশক হোসেন মোহাম্মদ এরশাদকে আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর রাষ্ট্র ও পুলিশ প্রধানকে পত্র দিয়ে তার দেশ ও তার পক্ষ থেকে আমাকে অভিনন্দন জানাতে অনুরোধ করেছেন। আইজিপি মহোদয় আমেরিকান দূতাবাস থেকে পাঠানো আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদ সাহেবের চিঠিগুলো আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পরে আমেরিকার অ্যাম্বাসেডর তার লেডি সেক্রেটারির মাধ্যমে খুব দামী গিফটও পাঠিয়েছিলেন পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইনকে।

পুলিশ কর্মকর্তা আকরাম হোসাইন আমেরিকান অ্যাম্বাসেডরের চুরি হওয়া মালামাল উদ্ধারের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে পুলিশ বাহিনীর সাফল্যের কথা। আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর তার চিঠিতে লিখেছিলেন, আমাদের আমেরিকার আধুনিক প্রযুক্তির চেয়ে তোমাদের পুরান কৌশল অনেক কার্যকরী। তোমাদের সাফল্যে আমরা মুগ্ধ। তিনি চিঠিতে পুলিশের বিশেষ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার ভূইয়াকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছিলো ঘটনার দিন ১১ জুলাই উল্লেখ করেছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম ও থানার সকল পুলিশ সদস্যদের ধন্যবাদ দিয়েছিলেন।

দাপুটে পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইন এর সাফল্যের কথা দেশের ক্ষমতাধর সেনা শাসক এরশাদ সাহেবও আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের চিঠির মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। আকরাম হোসাইন কর্মময় জীবনের কোন সাফল্যের ঘটনা মনে পড়তেই আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন। চাকরি জীবনে ষড়যন্ত্র ও ব্যর্থতার ঘটনাগুলো ভুলে যেতে তার এই সাফল্যের ঘটনাগুলো তাকে বেঁচে থাকার সাহস যোগাতো। তাই যখনই শরীর ও মন ভালো থাকতো, তিনি পুরোনো ফাইলগুলো খুঁজে বেড়াতেন। হারিয়ে যাওয়া গৌরবগাঁথা সোনালী স্মৃতির সন্ধানে।

আরও পড়ুন